সোমবার, ১৩ নভেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

পাঠকের দিলের কানে পৌঁছুক কলমের আজান

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

পাঠকের দিলের কানে পৌঁছুক কলমের আজান

আল্লাহতায়ালা মানুষ সৃষ্টি করেছেন তার ইবাদতের জন্য। কথাটি সত্য। প্রশ্ন হলো, ইবাদত তো ফেরেশতারাও করে। তাহলে একই কারণে কেন নতুন আরেকটি জাতি সৃষ্টি করলেন তিনি? না, প্রশ্নটি আমার নয়। প্রশ্নটি করেছিলেন ফেরেশতারা। জবাবে আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ইন্নি আ’লামু মা লা তা’লামুন। ‘নিশ্চয়ই,  আমি যা জানি, তোমরা তা জানো না।’

আল্লাহতায়ালা জানতেন, মানবীয় দোষ-ত্রুটি থাকা সত্ত্বেও মানুষের মাঝে এমন কিছু গুণ তৈরি হবে যা ফেরেশতাদেরও হার মানিয়ে দেবে। এমনই সব গুণের সমাহার ঘটেছিল পূর্ববতী সুফি-সাধক, আলেম-ওলামাদের মাঝে। আফসোস! এখন আলেম আছে, কিন্তু সেই গুণগুলোর চর্চা নেই। কীভাবে যেন আমরা সালফে-সালেহিনদের আদর্শ ভুলে নিজেদের ধ্বংসের পথ তৈরি করে নিয়েছি। পূর্ববর্তী মনীষীরা সারা রাত আল্লাহর ইবাদতে কাটিয়ে দিতেন, দিনে রোজা রাখতেন, মানবসেবায় নিজেকে উৎসর্গ করতেন, কিন্তু এসব ইবাদত কেউ জানা দূরের কথা টেরও পেত না। কখনো যদি কেউ জেনেও ফেলত, তারা খুব পেরেশান হয়ে যেত এই ভেবে যে, হায়! না জানি আমার মাঝে রিয়া এসে যায়। না জানি আমার ইবাদতের কবুলিয়াত প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। এসব ভেবে তাদের কান্নাকাটি-ইবাদতের মাত্রা আরও বেড়ে যেত। এমনই একজন সাধক ছিলেন হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মোবারক (রহ.)। তার জীবনী থেকে একটি ঘটনা বলছি।

আবদুল্লাহ ইবনে মোবারক ছিলেন তখনকার সময়ের শ্রেষ্ঠ আলেম ও সুফি। তিনি এখানে-ওখানে ঘুরে মানুষকে ইলমে মারেফাত ও শরিয়ত শিক্ষা দিতেন। একদিন তিনি বাগদাদ থেকে তারতুস শহরে ভ্রমণের উদ্দেশ্যে বের হলেন। পথে ছিল রেক্কা নামক একটি সরাইখানা। এ সরাইখানাটি তিনি খুব পছন্দ করতেন। প্রায় সময়ই তিনি এখানে বিশ্রাম নিতেন।

এক যুবক ছিল তার খুব ভক্ত। যেই শুনত আবদুল্লাহ ইবনে মোবারক রেক্কায় এসেছেন, ওমনি সে ছুটে আসত। বলত, ‘হুজুর! আমাকে উপদেশ দিন।’ ইবনে মোবারকও দরদের সঙ্গে যুবককে নসিহত করতেন। কিন্তু এবার আর ওই যুকের দেখা মিলল না। দরবেশ খোঁজ নিয়ে জানলেন, যুবকটি ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে এখন হাজতে আছে। তিনি সঙ্গে সঙ্গে ছুটে গেলেন হাজতে। ঋণদাতার ঠিকানা জেনে যুবকের সব ঋণ পরিশোধ করে বললেন, ‘ভাই! ছেলেটিকে ছাড়ানোর ব্যবস্থা করুন। সেই যুবক নিতান্তই গরিব মানুষ। আমাকে খুব ভালোবাসে। আমিই যে তাকে ঋণমুক্ত করেছি, এ কথাটি যেন সে জানতে না পারে।’

ইবনে মোবারক ফিরে এলেন। গভীর রাত। ঝিমানো চাঁদ। জায়নামাজে বসে তিনি কাঁদছেন। হঠাৎ মনে হলো, কোনোভাবে যদি যুবকটি জানতে পারে আমিই তার ঋণ পরিশোধ করেছি, তখন তো আর আমার আমলটি গোপন রইল না। আর ওই যুবকের কাছে আমার ভিন্নরকম ভাব প্রকাশ হয়েও যেতে পারে। এসব ভাবতে ভাবতেই শুনতে পেলেন মসজিদের মিনার থেকে ভেসে আসছে ফজরের আজানের সুর। তিনি নামাজ পড়ে দ্রুত সরাইখানা ছেড়ে রওনা করলেন আসল গন্তব্যে। যেন ওই যুবকের সঙ্গে কোনোভাবে দেখা হয়ে না যায়।

এদিকে যুবক ছাড়া পেয়েই শুনতে পেল, গত রাতে দরবেশ ইবনে মোবারক এসেছিলেন। সে সরাইখানায় এসে জানতে পারল অনেক আগেই ইবনে মোবারক তারতুসের উদ্দেশে রওনা হয়ে গেছেন। যুবক ইবনে মোবারকের সঙ্গে দেখা করার জন্য তারতুসের পথ ধরল। একপর্যায়ে ইবনে মোবারকের সাক্ষাৎ পেয়ে গেল। ইবনে মোবারককে দেখে যুবকের চোখে-মুখে আনন্দের ঝিলিক ছড়িয়ে পড়ল। সে বলল, ‘হুজুর! আমি গত রাতে হাজতে বন্দী ছিলাম। তাই আপনার সঙ্গে দেখা করতে পারিনি। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, আল্লাহর কোনো এক নেক বান্দা আমার ঋণ পরিশোধ করে আমাকে ছাড়ানোর ব্যবস্থা করেছেন। আমি ছাড়া পেয়েই আপনার কাছে ছুটে এসেছি।’ ইবনে মোবারক এমনভাবে কথা বললেন, যেন ঘুণাক্ষরেও যুবকটি বুঝতে না পারে তিনিই সেই নেক বান্দা।

এই ছিল আমাদের পূর্বসূরিদের আমল। সম্পূর্ণ প্রচারবিমুখ জিন্দেগি ছিল তাদের। তাই তো আল্লাহতায়ালা তাদের প্রচার-প্রসার ছড়িয়ে দিয়েছেন বিশ্বময়। আর আজ আমরা নিজেরাই নিজেদের প্রচারের দায়িত্ব নিয়েছি। বানিয়ে নিয়েছি ফেসবুক-টুইটার, আরও কত কী। এখন আমাদের আমল হয়ে পড়েছে প্রচারসর্বস্ব। হে আল্লাহ! কবে আমরা এ প্রচারসর্বস্ব আমল থেকে মুক্তি পেয়ে শুধু আপনার জন্যই ইবাদত-বন্দেগি করব? কবে শুধু আপনার জন্যই আমরা মানুষের পাশে দাঁড়াব? হে আলেমসমাজ! আমার এ আজান কি আপনার দিলের কানে পৌঁছেছে?

লেখক : বিশিষ্ট মুফাসসিরে কোরআন ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব।

www.selimazadi.com

সর্বশেষ খবর