রবিবার, ১৯ নভেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

কথায় বড় হওয়ার প্রতিযোগিতা

বিভুরঞ্জন সরকার

কথায় বড় হওয়ার প্রতিযোগিতা

আমাদের দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি। এ দুই দলের মধ্যে বনিবনা নেই, সদ্ভাব নেই— এটা কোনো গোপন তথ্য নয়, সবারই জানা। এ দুই দল পালাক্রমে একাধিকবার দেশ শাসন করলেও জাতীয় কোনো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে এ দুই দলের মধ্যে ঐক্য ও সমঝোতা নেই, অচিরেই কোনো ধরনের সমঝোতা হবে তারও কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। এখন শাসন ক্ষমতায় আছে আওয়ামী লীগ। টানা দুই মেয়াদে ক্ষমতায় থেকে আওয়ামী লীগ একটি রেকর্ড তৈরি করেছে। আবার ক্ষমতায় থেকে জন্ম নেওয়া রাজনৈতিক দল বিএনপি ১০ বছরের বেশি সময় ধরে ক্ষমতার বাইরে আছে এবং দলটি দাপটের সঙ্গেই টিকে আছে— এটাও কম কথা নয়। কোনো কোনো রাজনৈতিক পণ্ডিত মনে করেন, বেশিদিন ক্ষমতার বাইরে থাকলে বিএনপি অস্তিত্ব সংকটে পড়বে। আমি অবশ্য তা মনে করি না। বিএনপি যে রাজনৈতিক ধারার প্রতিনিধিত্ব করে সে রাজনীতি অর্থাৎ আওয়ামী লীগ ও ভারতবিরোধিতার রাজনীতি দেশে তত দিন বহাল থাকবে, যত দিন আওয়ামী লীগ থাকবে।

একটি গণতান্ত্রিক দেশে একাধিক রাজনৈতিক দল থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক। গণতন্ত্রকেই বর্তমানে সেরা শাসনব্যবস্থা বলে মনে করা হয়। পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেওয়া কিংবা নিজে নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার একটি বৈশিষ্ট্য, কিন্তু একমাত্র বৈশিষ্ট্য নয়। আমাদের দেশে অবশ্য ভোটাভুটির অধিকারকেই গণতন্ত্রের বড় মাপকাঠি হিসেবে দেখা হয়। আমরা ভোট দিয়ে আমাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করাকেই গণতন্ত্রচর্চা বলে মনে করে স্বস্তি অনুভব করি। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতায় এলেও দুই দলের গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য এক নয়। অনেকেই অবশ্য এ দুই দলকে মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ বলে মনে করেন। দুই দলের পার্থক্যও উনিশ-বিশের বেশি নয় বলে বলা হয়। কিন্তু এ ধারণা ঠিক নয়। এ নিয়ে লম্বা রাজনৈতিক বিতর্ক করার সুযোগ আছে।

সাদা চোখে দেখলে সাধারণভাবে দুই দলের আচার-আচরণ প্রায় এক বলে মনে হলেও দুই দলের আদর্শিক অবস্থানে ভিন্নতা আছে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে স্বজনপ্রীতি, ঘুষ-দুর্নীতি, দলবাজি-দখলবাজি করে— বিএনপি ক্ষমতায় গেলেও তাই করে। দুর্নীতি এবং ক্ষমতা সম্ভবত হাত ধরাধরি করে চলে। এটা শুধু বাংলাদেশের বিষয় নয়, পৃথিবীর অনেক দেশেই দুর্নীতি এখন একটি বড় বিষয়। ক্ষমতা থাকলে দুর্নীতিও থাকবে। দুর্নীতির মাত্রা কী হবে বিতর্কের বিষয় হতে পারে সেটা। কিন্তু দুর্নীতি করে বলেই আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এক হয়ে গেল— এ সিদ্ধান্ত অতি সরলীকরণ দোষে দুষ্ট এবং রাজনৈতিক বিবেচনায় ভ্রান্ত। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে সাধারণ মানুষের স্বার্থের অনুকূলে যতটা নীতি-পদক্ষেপ গ্রহণ করে, বিএনপি কি তা করে? বাঙালির ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতিচর্চার সুযোগ কি দুই শাসনামলে এক হয়? কৃষকসহ শ্রমজীবী মানুষের স্বার্থ কোন আমলে বেশি রক্ষিত হয়? জাতীয় অগ্রগতির জন্য জরুরি উন্নয়ন কর্মকাণ্ড কোন আমলে অগ্রাধিকার পায়? একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, সাম্প্রদায়িক উগ্রবাদী, জঙ্গিবাদী শক্তির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি— এগুলো কি বিএনপির কাছে আশা করা যায়? ১৫ আগস্টের বর্বর হত্যাকাণ্ডের বিচার, প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন এবং বছরের পর বছর ঝুলে থাকা বিরোধ নিষ্পত্তিতে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির অবস্থান কি এক?

আমাদের দেশে একটি মতলববাজ গোষ্ঠী আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে এক পাল্লায় মাপতে চায়, বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়েই। এটা প্রতিষ্ঠিত করতে পারলে সুবিধা এটাই যে, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও চেতনাকে তাহলে ম্লান করা যায়। আওয়ামী লীগকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবাহী দল বললে কেউ কেউ আপত্তি করেন এ কথা বলে যে, আওয়ামী লীগ এখন আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনাগত অবস্থানে নেই। মুক্তিযুদ্ধের একটি অন্যতম উপাদান ছিল অসাম্প্রদায়িকতা, ধর্মকে রাজনীতির উপজীব্য না করা। কিন্তু আওয়ামী লীগ এখন ধর্ম নিয়ে যারা রাজনীতি করে তাদের সঙ্গে আপসের পথে হাঁটছে। আওয়ামী লীগে আশ্রয় পাচ্ছে জামায়াতে ইসলামীর মতো দলের নেতা-কর্মীরা। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী কারও কারও রাজনৈতিক শেল্টারও আওয়ামী লীগে হয়েছে। এ অভিযোগগুলো অসত্য নয়, মিথ্যাও নয়। আওয়ামী লীগের মধ্যে ত্রুটি-দুর্বলতা-দোদুল্যমানতা সবই আছে। তার পরও বিএনপির চেয়ে আওয়ামী লীগকে যে কারণে এগিয়ে রাখতে হবে সেটা হলো, এই দলের নেতা ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং এখনো এই দলের হাল ধরে আছেন জননেত্রী শেখ হাসিনা।

কেউ হয়তো বলবেন, ব্যক্তিকে অতিরিক্ত গুরুত্ব দিয়ে সবকিছু বিচার করলে তার ফল ভালো হয় না। ব্যক্তি নয়, ইতিহাসের নির্মাতা ও নিয়ন্তা হলো জনগণ। মানুষের ঐক্যবদ্ধ ও সম্মিলিত শক্তির কাছে ব্যক্তি তুচ্ছ। বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে এটা নিশ্চয়ই ঠিক। তবে ইতিহাসে ব্যক্তির ভূমিকাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। অনেক সময় ব্যক্তি যে ইতিহাসের অনিবার্য রূপকার হয়ে ওঠেন, তার অনেক নজির ইতিহাস থেকেই দেওয়া যাবে। একজন ব্যক্তি যখন বলেন, ‘আমি যদি হুকুম দিবার না-ও পারি’— এবং সম্মিলিত জনতা তাতে উদ্বেলিত হয়ে ওঠে তখন তিনি আর ব্যক্তিমাত্র থাকেন না, হয়ে যান সমষ্টির একজন। ব্যক্তি শেখ মুজিব যেমন বাংলাদেশ নামক স্বাধীন ভূখণ্ড প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে অদ্বিতীয় হয়ে উঠেছিলেন, তেমনি ব্যক্তি শেখ মুজিবের নির্মম হত্যাকাণ্ড একটি জাতির বিপর্যয়েরও কারণ হয়েছিল। নির্দিষ্ট একজন ব্যক্তির থাকা-না থাকার গুরুত্ব তাই খাটো করে দেখার বিষয় নয়। বর্তমান পর্যায়ে শেখ হাসিনার উপস্থিতি এবং নেতৃত্বদান আওয়ামী লীগের জন্য একটি বড় সম্পদ। এটা অস্বীকার করা যাবে না যে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের পুঁজি এবং সম্পদ অফুরন্ত। প্রায় সাত দশকের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতায় পোড় খাওয়া এই দল। তবে এও ঠিক, আওয়ামী লীগ তার পুঁজি ও সম্পদ যথাযথ সংরক্ষণের ব্যবস্থার পরিবর্তে তার অপব্যবহার ও অপচয় করেছে এবং করছে।

আওয়ামী লীগ যদি তার পুঁজি ও সম্পদের সদ্ব্যবহার করতে পারত তাহলে বিএনপির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় সব সময় এগিয়ে থাকত। আজ ক্ষমতার রাজনীতিতে টিকে থাকার জন্য বিএনপির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নেমে আওয়ামী লীগ যেভাবে ক্রমাগত তার নিজের জায়গা ছাড়ছে তাতে মানুষের পক্ষে এ দুই দলের মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ করা আরও কঠিন হয়ে পড়বে। মানুষ আওয়ামী লীগকে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে দৃঢ় দেখতে চায়। বিএনপি যেটা করে মানুষের সমর্থন ও সহানুভূতি পায়, আওয়ামী লীগ সেটা করলে হয় বিরূপ প্রতিক্রিয়া। আওয়ামী লীগের কাছে মানুষের প্রত্যাশা বেশি। বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে দলের নেতৃত্বে সে দল জনপ্রত্যাশার বিপরীতে যাবে না— এটাই মানুষ চায়।

দুঃখ ও পরিতাপের বিষয় এটাই যে, ভোটের রাজনীতিতে এগিয়ে থাকার লোভ আওয়ামী লীগকে বিএনপির অনুসারী করে ফেলছে। বিএনপির রাজনীতি ধার করার প্রবণতা আওয়ামী লীগকে দ্রুত পরিহার করতে হবে। বিএনপি আর আওয়ামী লীগ যে এক নয়, সেটা মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে হবে। বিএনপির কাছ থেকে একটি বিষয় আওয়ামী লীগকে শিখতে হবে এবং সেটা হলো, রাজনীতিতে নিজস্ব অবস্থান বা জায়গা ছাড়তে নেই। তাহলে বিশ্বাসযোগ্যতার সংকট তৈরি হয়। এত ঝড়ঝাপটা সত্ত্বেও বিএনপি কিন্তু তার রাজনীতির মূল ধারা থেকে সরে আসছে না। ভারতবিরোধিতা বাদ দিচ্ছে না। জিয়াউর রহমানকে মুক্তিযুদ্ধের ‘ঘোষক’ বলে দাবি করলেও মুক্তিযুদ্ধকে দলীয় রাজনীতিতে সেভাবে সামনে আনছে না। নতুন প্রজন্মের মধ্যে যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে প্রবল ঘৃণা তৈরি হলেও বিএনপি কিন্তু তার অবস্থান বদলাচ্ছে না।

বিএনপি মনে করে রাজনীতিতে ‘মুক্তিযুদ্ধ’ তার সম্পদ নয়। ওটা আওয়ামী লীগের সম্পদ। ওই সম্পদের মালিকানা দাবি করলে তার সমর্থকগোষ্ঠীর মধ্যে বিরোধ তৈরি হবে, ভুল বোঝাবুঝি তৈরি হবে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষে অবস্থান নিলে বিএনপির জনসমর্থন বাড়ত বলে অনেকে মনে করলেও বিএনপি দলীয়ভাবে সেটা মনে করেনি। আবার জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা-না রাখা নিয়েও বিএনপির অবস্থানের ধারাবাহিকতা বজায় আছে। জামায়াত ছাড়লে বিএনপির জনপ্রিয়তা বাড়বে— এ প্রচারণায় বিএনপি প্রলুব্ধ হয়নি। আওয়ামী লীগ থেকে নিজেদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখার ক্ষেত্রে বিএনপি যতটা যত্নবান, আওয়ামী লীগ যেন বৈশিষ্ট্য খোয়াতে ততটাই বেশি আগ্রহী।

খারাপের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করাই যেন আমাদের রাজনীতির নীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। কাজে বড় না হয়ে কথায় বড় হওয়ার প্রবণতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। চারদিকে শুধু কথার ফুলঝুরি। মানুষ বিভ্রান্ত হচ্ছে। বিভ্রান্ত মানুষকে বিপথগামী করা সহজ। বাস্তবে হচ্ছে তাই। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপিকে যদি উনিশ-বিশ মনে করা হয় তাহলে আওয়ামী লীগের মর্যাদাহানি হয়। আওয়ামী লীগ তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় ফেরার আশা করছে। বিএনপিও আর ক্ষমতার বাইরে থাকতে চাচ্ছে না। এভাবে চললে নেতাদের রসদে টান পড়বে। কথায় আছে, বসে খেলে লক্ষ্মীর ভাণ্ডারেও টান পড়ে। তাই ক্ষমতায় ফেরার জন্য বিএনপি এবার মরিয়া চেষ্টা করবে।

যে কোনো কারণেই হোক, বিএনপি মনে করছে আওয়ামী লীগের চেয়ে এখন তারা বেশি জনপ্রিয়। মানুষ স্বাধীনভাবে ভোট দেওয়ার সুযোগ পেলে বিএনপিই জয়লাভ করবে। আর আওয়ামী লীগ ভাবছে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গত কয় বছরে দেশে এত দৃশ্যমান উন্নয়ন হয়েছে যে, মানুষ এ উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য আবার আওয়ামী লীগকেই ভোট দেবে। আসলে কী ঘটবে তা জ্যোতিষীর মতো বলে দেওয়া যাবে না। তবে ক্ষমতায় থাকা এবং ক্ষমতায় যাওয়ার প্রতিযোগিতা তীব্র উত্তেজনাকর হবে বলেই মনে হচ্ছে। এ বিষম প্রতিযোগিতায় রাজনীতিতে নীতিহীনতা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে সেটাই এখন দেখার বিষয়।

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।

সর্বশেষ খবর