নিপুণ কারিগর আল্লাহতায়ালার সৃষ্টিরাজ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হলো মানুষ। আল কোরআনে আল্লাহ বলেছেন, ‘ওয়ালাকাদ কাররাম না বানি আদাম।’ ‘আমি আদম সন্তানকে সবার চেয়ে সম্মানিত করেছি।’ এ কথাটিই বাংলার একজন সাধক বলেছেন এভাবে, ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।’ সুফি কবি নজরুল বলেছেন, ‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান!’ মানুষের এই বড়ত্ব-মহত্ত্বের কারণ হলো, সৃষ্টিরাজ্যে সে-ই একমাত্র আল্লাহর প্রতিনিধি। আল্লাহর প্রতিনিধি হওয়ার কারণেই তাকে বিশেষ প্রশিক্ষণ দিয়ে পৃথিবীরাজ্যে পাঠানো হয়েছে। শুধু কি প্রশিক্ষণ? একটি স্মরণিকাও দিয়ে দিয়েছেন, যাতে সে ভুলে গেলেও তাকে বার বার মনে করিয়ে দেয় তার মহান দায়িত্বের কথা। সঙ্গে পাঠিয়েছেন একজন করে সতর্ককারী। সেই সতর্ককারীই হলেন নবী-রসুল। নবী-রসুল শব্দের অর্থ হলো সতর্কের বাণীবাহক। আর স্মরণিকা হলো কিতাবুল্লাহ। আল কোরআনুল কারিম। এজন্যই কোরআনের আরেকটি নাম ‘জিকির’। জিকির মানে স্মরণিকা। যেমন আল্লাহ বলেছেন, ‘নাহনু নাজজাল নাজজিকরা’, ‘এ স্মরণিকা আমিই নাজিল করেছি।’ কেন এই স্মরণিকা? আর মানবাত্মাকেই বা কী প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে? এই প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে কোরআন। আল্লাহ বলছেন, ‘রুহের জগতে আমি সব আত্মাকে জিজ্ঞাসা করলাম, আলাসতু বিরব্বিকুম? বান্দা! আমি তোমার রব নই? একসঙ্গে সবাই বলে উঠেছে, অবশ্যই! আপনি আমাদের রব।’
আল্লাহ আগে থেকেই জানতেন, রুহের জগতের সেই ওয়াদা আমরা ভুলে যাব দুনিয়ার মায়ায় পড়ে। তাই আল্লাহতায়ালা আমাদের পাঠানোর সঙ্গে সঙ্গে নবী ও কিতাবও দিয়ে দিলেন। কিতাব পড়ে আমরা জানব আমাদের আত্মাকে। শুনব আত্মার আহ্বানকে। বুঝব আত্মার মিনতিকে এবং সংশোধন করে নেব আমাদের নিজেদের। যারা আত্মাকে জানেন, আত্মার মিনতি শোনেন, তাদের হৃদয় হয়ে যায় পবিত্র-নূরানি। কোরআনের ভাষায় যাকে বলে ‘কালবে সালিম’— ‘বিশুদ্ধ আত্মা’। আর যারা কোরআন পড়ে না, নবীর আদর্শ জানে না, তারা নিজের আত্মাকেও চেনে না। দেহের খাঁচায় বন্দী রুহু পাখিটিরও দেখা পায় না। পাখিটির কিচিরমিচির সতর্কবাণীও শুনতে পায় না। আপনি যখন কোনো পাপ করেন, তখন আপনার ভিতরে থাকা রুহু পাখিটি ডানা ঝাপটাতে থাকে আর চিৎকার করে বলে, ‘আল্লাহকে ভয় কর। ভুলে যেও না তোমার রব কে। তুমি কার প্রতিনিধি। তার প্রতিনিধি হয়ে এ ধরনের জঘন্য কাজ তোমার শোভা পায় না। ফিরে এসো! এসো ফিরে। সত্যের পথে। আলোর পথে। কোরআনের পথে। আল্লাহর পথে। হায়! এভাবেই রুহু পাখি মাটির দেহধারীকে ডাকতে থাকে। আফসোস! দিলের কান না থাকায় আমরা শুনতে পাই না। মনের চোখ না থাকায় আমরা দেখতে পাই না। আল্লামা রুমি কত চমৎকারভাবে বলেছেন, ‘চুঁ গরজ আমদ হুনর পুশিদা শুদ সদ হিজাব আজ দিল বসুয়ে দিদা শুদ। অর্থাৎ, তোমার আত্মায় পাপের ধুলা পড়েছে, স্বার্থের পরদা ঝুলেছে, তাই তুমি আজ আত্মার মিনতি-আহাজারি-রোনাজারি শুনতে পাও না।’ আত্মভোলা হে মানুষ! তোমার হাত-পা, চোখ-মুখ, পেট-পিঠ— এককথায় পুরো দেহটিই পাপে জর্জরিত হয়ে পড়েছে। পাপের এই দেহ খাঁচায় পবিত্র রুহু পাখিটি ছটফটাচ্ছে। বার বার তোমাকে বলছে, ফিরে এসো, ফিরে এসো...। বার বার মনে করিয়ে দিচ্ছে, ‘আলাসতু বিরব্বিকুম? কালু বালা’— ‘আমি কি তোমার রব নই? অবশ্যই! অবশ্যই।’ হায়! আত্মায় মিনতি যদি তুমি শুনতে! আত্মার ছটফটানি যদি তুমি দেখতে! আল্লাহ বলেন, ‘ইয়া আইয়্যুহাল ইনসান! মা গাররকা বিরব্বিকাল কারিম।’ ‘হে মানুষ! কোন মায়ায় কার ধোঁকায় তুমি আত্মার মিনতি শুনছ না? কীসের স্বার্থে তোমার মহান প্রভুকে তুমি ভুলে বসে আছো?’
‘সেদিন জাহান্নাম ক্রোধে ফেটে পড়বে। যাদের এতে নিক্ষেপ করা হবে তাদেরই জিজ্ঞাসা করবে, তোমাদের কাছে কি কোনো সতর্ককারী, স্মরণিকা ও আত্মার মিনতি পৌঁছেনি? তারা বলবে, হ্যাঁ! পৌঁছেছিল। কিন্তু এতই পোড়া কপাল আমাদের, আমরা তা মিথ্যা মনে করে আমাদের পাপের পথেই রয়ে গেছি। হায় আফসোস! যদি আমরা নবীর বারণ শুনতাম, জীবনে কোরআন ধারণ করতাম, আত্মার মিনতি শুনে পাপের সাম্রাজ্য না গড়তাম তাহলে আজ আমাদের জাহান্নামে পুড়তে হতো না। এভাবেই আত্মভোলারা আফসোস করবে এবং তাদের ভুলের স্বীকরোক্তি করবে। কিন্তু তখন ধ্বংস ছাড়া আর কিছুই বাকি থাকবে না।’ (সূরা মূলক : ৮-১১)।
লেখক : বিশিষ্ট মুফাসসিরে কোরআন ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব।