সোমবার, ২৭ নভেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

অবিচল সতর্কতাই স্বাধীনতার মূল মন্ত্র

অধ্যাপক ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত

অবিচল সতর্কতাই স্বাধীনতার মূল মন্ত্র

মহাত্মা গান্ধী বা নেহরুর মতো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ফ্যাসিবাদ এবং সাম্প্রদায়িকতাকে ঘৃণা করতেন। চলনে-বলনে আচারে-ব্যবহারে তিনি সত্যিই ছিলেন একজন মহামানব। নিঃস্বদের জন্যও তিনি ভেবেছেন। আমার মতে, ধর্ম ও কর্ম অনেকাংশেই অভিন্ন, সুতরাং সত্যিকার একজন ধার্মিক কখনো তার কর্মকে তুচ্ছজ্ঞান করতে পারেন না। শুধু দরকার অবিচল সতর্কতা। এই অবিচল সতর্কতা রাষ্ট্র তথা স্বাধীনতাকে দৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে পারে। শিক্ষা এবং সংস্কৃতি অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত— একটি ছাড়া অপরটি চলতে পারে না। পুঁথিগত জ্ঞানের বাইরে সামাজিক এবং পারিবারিক শিক্ষা মানুষকে আরও বলীয়ান এবং পণ্ডিত ব্যক্তিত্বে রূপান্তরিত করে। ধর্মের খুঁটিনাটি বিষয়গুলোকে বিশ্লেষণ করায়। ধর্ম যখন সঠিক পথে চলে কর্ম তখন সঠিক পথে চলতে বাধ্য। ধর্ম এবং কর্ম যখন পূর্ণাঙ্গ রূপ লাভ করে তখন ব্যক্তিও সার্বিকভাবে পরিপূর্ণ ব্যক্তিত্বে রূপলাভ করে। পরিপূর্ণ মানুষই পারে ব্যক্তি তথা সমাজকে সঠিক সেবা দিতে। সমাজসেবা, চিকিৎসাসেবার চেয়ে বৃহদাকার হলেও দুটোই মানবতার সেবা। ধর্মে বিশ্বাস, কর্মে আত্মপ্রত্যয়, শিক্ষায় নিবেদিত, সেবায় উদারহস্ত, আত্মত্যাগী মানুষ যেমন আমিত্বকে ভুলে যেতে পারে, তেমনি নিজেকে পীর-মুর্শিদ ও সন্ন্যাসীর কাছাকাছি নিয়ে যেতে পারে যার ফলশ্রুতিতে সমাজে হিংসা-বিদ্বেষ, লোভ-লালসা, চারিত্রিক কলুষতা হ্রাস পেতে বাধ্য।

মহাত্মা গান্ধী ১৯০৫ সালে The Seven deadly Social Sins of Society-তে যেভাবে বিশ্লেষণ করেছিলেন আজ তার ১১২ বছর পরেও পুরো বিশ্বে তার প্রতিচ্ছবি দেখতে পাওয়া যায়। যার প্রথমটি হলো—‘Wealth without Work’ অর্থাৎ ‘পরিশ্রম ছাড়া সম্পদের মালিক হওয়া’। আজকে আমাদের বাংলাদেশে, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশে তা শতভাগ স্বীকৃত। যে কোনো কেউ আর্থিক প্রতিষ্ঠানে সঞ্চিত গরিবের অর্থ শত শত কোটি টাকা লোনের নামে লুটপাট করে হঠাৎ করে বিনা পরিশ্রমে অবৈধ কোটিপতি বনে বিলাসবহুল জীবনযাপন করে ধনসম্পদের শ্রাদ্ধ করেন এবং নিজের নৈতিকতা বিসর্জন দেন। বিনা পরিশ্রমে অর্জিত অর্থের সঠিক মূল্যায়ন তাদের কাছে কখনো থাকে না। অহিংস নীতি এবং আত্মশুদ্ধির জন্য গান্ধীজির অনশন তাকে আত্মশুদ্ধি দিয়েছিল, ত্যাগের সুউচ্চ স্থানে প্রতিষ্ঠিত করে মহিমান্বিত ও অবিসংবাদিত করেছিল। বঙ্গবন্ধুও বার বার জেলে গিয়ে নিজেকে কষ্টিপাথরে যাচাই করে সোনার মানুষ, ত্যাগী মানুষ, বাঙালির বন্ধু এবং অসহায়ের সহায় হয়েছিলেন।

দ্বিতীয়তটি ছিল, ‘Pleasure without Conscience’ অর্থাৎ ‘বিবেকহীন আনন্দ একটি মহাপাপ’ এবং এই মহাপাপের সমুদ্রে আমাদের তরুণ সমাজ নিমজ্জিত। বিবেকশূন্য তরুণ সমাজ বন্ধুত্বের ছলনা করে, ভালোবাসার বাক্য শুনিয়ে ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধ করে, ভিডিও করেই খ্যান্ত হন না, তা ভাইরাল করে অপরাধী নিষ্পাপ তরুণীকে জনসমক্ষে শুধু হেয় করেন না বরং আত্মহননের মতো পথে ঠেলে দেন। তরুণীদের প্রতি অনুরোধ প্রতিবাদী হন। তাহলেই অপরাধীরা ভয় পাবে। আত্মহত্যা করে মহাপাপ না করে, প্রতিবাদী হয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করুন। যারা এসব ঘৃণ্য কাজ করেন, তারা পেশাদারি ধর্ষক নামের পশু। মানুষের সংজ্ঞায় তাদের স্থান হয় না। এ পি জে আবদুল কালামের ভাষায় প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে না চলতে পারলে উন্নতি স্বপ্নই থেকে যাবে, একই সঙ্গে প্রযুক্তি হলো দুদিকে ধারালো তরবারির মতো। সঠিক ব্যবহারে অগ্রগতি হাতের মুঠোয়, অপব্যবহারে ধ্বংস অনিবার্য।

তৃতীয়টি হলো— ‘Science without Humanity’ অর্থাৎ ‘মানবতা শূন্য বিজ্ঞান’ মানবতাশূন্য বিজ্ঞানের আবিষ্কারের জন্য আলফ্রেড নোবেল যিনি একাধারে প্রকৌশলী ও রসায়নবিদ তিনি ডিনামাইটের ধ্বংসলীলা দেখে, অপব্যবহার দেখে তার সমস্ত অর্থ দিয়ে নোবেল প্রাইজ ঘোষণা করে ডিনামাইট আবিষ্কারের ধ্বংসলীলার প্রায়শ্চিত্ত করেন।

চতুর্থটি হলো— ‘Knowledge without Character’ অর্থাৎ ‘চরিত্রহীন জ্ঞানী বা পণ্ডিত ব্যক্তি’। ধরুন বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, মাদ্রাসা বা স্কুলের সবচেয়ে ভালো শিক্ষকটি যদি চরিত্রহীন হন তাহলে জাতির সামনে কী ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করবে। সামান্য লোভ-লালসার মধ্যে পড়ে তারা মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীর স্থান পরিবর্তন করতেও দ্বিধা-বোধ করেন না। নৈতিকতা বিসর্জিত হলে, বিবেকের মৃত্যু ঘটে।

পঞ্চমটি হলো— ‘Politics without Principle’ অর্থাৎ ‘নীতি বিবর্জিত রাজনীতি’ যা আজকের উপমহাদেশের রাজনীতিতে এক অমর বাক্য। ষাট বছরের লালিত আদর্শ রক্তে নিয়ে নিজের দল থেকে নির্বাচনে মনোনয়ন না পেলে, চির জনম যে আদর্শের রাজনীতির বিরোধিতা করেছিলেন সেই দলের মনোনয়ন নিয়ে সংসদ সদস্য হওয়ার আপ্রাণ চেষ্টায় কখনো সফল বা বিফল হন। তারা নিজেরা যেমন রাজনৈতিক আদর্শে বলীয়ান হতে পারেন না, তেমনি যুবসমাজকে সুন্দর ও মঙ্গলজনক আদর্শে উদ্বুদ্ধ করতে ব্যর্থ হন। অর্থাৎ তাদের সামনে অনুকরণ করার মতো ব্যক্তিত্বের খুবই অভাব হয়। ষষ্ঠটি হলো— ‘Commerce without Morality’ অর্থাৎ ‘নৈতিকতা বিবর্জিত বাণিজ্য’। এটা নিত্যদিনের উদাহরণ। আজ পিয়াজের বাজার অশান্ত, আগামীকাল ডালের দর তার পরদিন হয়তো দেখা গেল চালের দামের দুর্বোধ্য মূল্য চালাচালির ফলে দরিদ্রের নাভিশ্বাস। আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম না বাড়লেও যখন-তখন পণ্যের দামের বৃদ্ধি ঘটানো হয় কৃত্রিমভাবে এটা যে কোনো ভোগ্যপণ্যের ব্যাপারেই হয়ে থাকে।

সপ্তমটি হলো—Worship without Sacrifice অর্থাৎ ‘আত্মউৎসর্গ ছাড়া পূজা-অর্চনা’ কখনো দেবতার কাছে গ্রহণযোগ্য হয় না। যার সঙ্গে কোরবানির যথেষ্ট মিল আছে। কোরবানি ত্যাগের মহিমাকেই উজ্জ্বলতর করে তোলে।

একজন পরিপূর্ণ মানুষ যখন সব ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলে, কর্মক্ষেত্রে সব উজাড় করে দেন এমন কী কারও প্রতি বৈরী ভাব পোষণ না করে দলগত বা সমষ্টিগতভাবে অবিচল সতর্কতার সঙ্গে কাজ করে যান, তাহলেই স্বাধীনতার মূল লক্ষ্যে পৌঁছানো যাবে। একজন সৎ মানুষকে হতে হবে ভাবের ভিখারী, জ্ঞান বিতরণ আর দানে উন্মুক্ত মন ও উদার হস্তের অধিকারী। ভক্তির কাঙ্গাল, দ্রব্যের বা সম্পদের কাঙ্গাল নয়। ফলাকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করে অনাসক্ত চিত্তে কর্ম করা উচিত। ত্যাগ থেকে পরম শান্তি লাভ হয়। সর্ব বিষয়ে সমত্ব বুদ্ধি জন্মে। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে তিনি বারবার বলেছিলেন, ‘মহৎ কিছু অর্জনের জন্য মহান ত্যাগের প্রয়োজন’ সবার প্রতিই মিত্রভাবাপন্ন, দয়ালু ও ক্ষমাবান, সমত্ববুদ্ধি ও অহংকার বর্জিত হওয়া উচিত। শত্রু-মিত্র, মান-অপমান, শীত-উষ্ণ, সুখ-দুঃখ, শুভ-অশুভ, নিন্দা-স্তুতি, হর্ষ-দ্বেষ ইত্যাদি দ্বন্দ্ব বর্জিত, সর্বত্র সমত্ব বুদ্ধি সম্পন্ন।

বলছিলাম ধর্ম অত্যন্ত পবিত্র, এটা অন্তরে লালন ও বাহ্যিকভাবে পালনের বিষয়। এ ব্যাপারে নোবেল জয়ী অমর্ত্য সেন বলেন, ‘নীতি হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের প্রকৃতিকে ব্যাখ্যা ও পরীক্ষা করা দরকার। আমার মতে ধর্মনিরপেক্ষতাকে তার বর্তমান সংজ্ঞার বাইরে বেরিয়ে ভাবার দরকার আছে। ধর্মীয় সংগঠন সংক্রান্ত অর্থে নয়, রাজনৈতিক অর্থে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ বিশেষ একটি ধর্মীয় সংস্থা থেকে রাষ্ট্রের বিচ্ছিন্নতা দাবি করে। এটিকে অন্ততপক্ষে দুভাবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে।

প্রথম দৃষ্টিভঙ্গিটির যুক্তিতে ধর্মনিরপেক্ষতা সব ধর্ম থেকে রাষ্ট্রের সমদূরত্ব দাবি করে—কোনো বিশেষ পক্ষের দিকে ঝোঁকার প্রবণতা প্রত্যাখ্যান করে সবার প্রতি নিরপেক্ষ মনোভাবের ওপর জোর দেয়। তুলনামূলকভাবে অধিক শক্তিশালী। দ্বিতীয় মতটি জোর দিয়ে বলে যে, রাষ্ট্রের কোনো ধর্মের সঙ্গেই কোনো সম্পর্ক রাখা উচিত নয়। অতএব সমদূরত্বের রূপ হবে সব ধর্ম থেকে সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে থাকা।’

যে সভ্যতা আমাদের পূর্ব পুরুষরা হাজার হাজার বছর ধরে সৃষ্টি করেছেন, বৈজ্ঞানিক শিক্ষা লাভের ফলে সেই সভ্যতা আরও সমৃদ্ধ হওয়ার কথা ছিল, ভ্রাতৃত্ব ও মানবতা বোধ সুদৃঢ় হওয়ার কথা ছিল। সেই মহান সভ্যতা-ধর্মীয় সহিষ্ণুতা যেখানে আরও কঠিন হওয়ার কথা, তা হিংসার দ্বারা বিপর্যয় বাধিয়ে ধ্বংস করতে পারি না। অহিংসা ও শান্তিপূর্ণ সহঅবস্থানের নীতি গ্রহণ করে সেই সভ্যতাকে আরও বিকশিত করা সম্ভব। আসুন অবিচল সতর্কতা দিয়ে বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত এই স্বাধীনতাকে সুদৃঢ় করে তুলি, দরিদ্রের কাছে স্বাধীনতার আস্বাদনে পৌঁছে দিতে পারি।

►লেখক : সাবেক উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।

সর্বশেষ খবর