সোমবার, ২৭ নভেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

সবাই মিলে দেব কর, দেশ করব স্বনির্ভর

হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ

সবাই মিলে দেব কর, দেশ করব স্বনির্ভর

কর হচ্ছে রাষ্ট্রের জনসাধারণের স্বার্থে রাষ্ট্রের ব্যয় নির্বাহের জন্য সরকারকে প্রদত্ত বাধ্যতামূলক অর্থ। এ প্রক্রিয়ায় দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষ রাষ্ট্রের স্বার্থে নিয়মিতভাবে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কর প্রদান করে থাকে। করের বাইরে সরকারের আরও বিবিধ আয়ের উৎস থাকলেও এটিই আয়ের প্রধান এক অবলম্বন। প্রায় সব দেশেই কর আদায়ের প্রচলিত পদ্ধতি চলমান। আমেরিকা, কানাডাসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশ জনগণ প্রদত্ত করের টাকা দিয়ে শুধু উন্নয়ন নয়, আর্থিক নির্ভরশীলতা ও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে অনেক আগেই। এশিয়ার জাপান, সিঙ্গাপুর, হংকং, ইন্দোনেশিয়া আয়করের সঠিক ব্যবহার করে এগিয়ে গেছে অনেকদূর। সে তুলনায় কর আহরণে আমরা এখনো বেশ পিছিয়ে।

আমাদের দেশে আয়কর প্রদান নিয়ে সাধারণ জনগণের মধ্যে একসময় বড় ধরনের ভীতি ও সংশয় ছিল। আগে দেখা যেত বিশেষ শ্রেণির মানুষই কেবল আয়কর প্রদান করত। কিন্তু সেই দুরবস্থা থেকে বাংলাদেশ আস্তে আস্তে বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। সম্প্রতি আমরা দেখছি, আর্থিকভাবে সক্ষমদের মধ্যে কর প্রদানের সংস্কৃতি প্রসার লাভ করেছে। অর্থাৎ যারা আয়কর প্রদানের আওতায় আসছে তারা আয়কর দিতে আগ্রহবোধ করছে। এবারের আয়কর মেলায় করদাতাদের উপচে পড়া ভিড় সেটি বেশ ভালোভাবেই প্রমাণ করেছে। মেলায় করদাতাদের সম্মান জানাতেও ভুল করেননি আয়োজকরা। আয়কর মেলায় তাই করদাতাদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে ‘ইনকাম ট্যাক্স আইডি কার্ড’। নিঃসন্দেহে এটি প্রশংসনীয় এক উদ্যোগ।

করমেলা শুরু হয়েছিল ১ নভেম্বর। বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্যে দিয়ে একটানা সাত দিন মেলা অনুষ্ঠিত হয়। দেশের মোট ১৮টি জেলার দুটি উপজেলাতে একযোগে করমেলা শুরু হয়। তবে সামগ্রিক আয়োজনে ছিল আটটি বিভাগীয় শহরে সাত দিন, ৫৬টি জেলায় চার দিন, ৩৪টি উপজেলায় দুই দিন এবং ৭১টি উপজেলায় এক দিন করে। এ বছর করমেলা আরেকটু বিকেন্দ্রীকরণ করা হয়। উপজেলা পর্যায়েও ছড়িয়ে দেওয়া হয় আয়কর মেলা। রাজধানী ঢাকাতে প্রথম দিন থেকেই ছিল নারী-পুরুষ নির্বিশেষে আয়কর দাতাদের উপচে পড়া ভিড়। উদ্বোধনী দিনেই গত বছরের তুলনায় বেশি মানুষ কর প্রদান এবং করসেবা নিতে আসে। এনআরবি প্রদত্ত তথ্য মতে, গত বছর মেলায় প্রথম দিনে কর আদায় হয়েছিল ১৯১ কোটি টাকার কিছু বেশি। এবার মেলার প্রথম দিনেই ২০৮ কোটি টাকার কর আদায় হয়। অর্থাৎ এবার প্রথম দিনেই গত বছরের তুলনায় ১৬ কোটি টাকার বেশি কর প্রদান করে সাধারণ জনগণ।

এনবিআর সূত্র মতে, এবার মোট কর আহরণ হয়েছে ২ হাজার ২১৭ কোটি ৩৩ লাখ ১৪ হাজার ২২১ টাকা। যা ২০১৬ সালের তুলনায় ৪.১২ শতাংশ বেশি। গত বছরের চেয়ে এবার আয়কর বেশি আহরণ হয়েছে ৮৭ কোটি ৬৫ লাখ ৩৮ হাজার ৪১০ টাকা। যা গত বছর ছিল ২ হাজার ১২৩ কোটি ৬৭ লাখ ৭৫ হাজার ৮১১ টাকা। এ ছাড়া এবার আয়কর মেলা থেকে সেবা নিয়েছে ১১ লাখ ৬৯ হাজার ৫৬৯ জন। গত বছর যা ছিল ৯ লাখ ২৮ হাজার ৯৭৩ জন। আর রিটার্ন দাখিল করেছেন ৩ লাখ ৩৫ হাজার ৪৮৭ জন। গত বছর এই সংখ্যা ছিল এক লাখ ৯৪ হাজার ৫৯৮ জন। এবার সেবা গ্রহণকারীর সংখ্যা বেড়েছে ২৫.০৯ শতাংশ। এ চিত্র থেকেই বোঝা যাচ্ছে, মানুষ প্রতিনিয়ত কর দিতে বেশ আগ্রহী হয়ে উঠেছে।

করমেলা নিয়ে মানুষের মাঝে এখন এক ধরনের ইতিবাচক মনোভাব তৈরি হয়েছে। দেখা যাচ্ছে, ২০১০ সাল থেকে আয়কর মেলা শুরু হওয়ার পর প্রতিনিয়ত মানুষের আগ্রহই বাড়ছে। আয়কর মেলার কারণেই ট্যাক্স বা কর দেওয়া নিয়ে সাধারণ মানুষের মাঝে যে বহুবিধ ভীতি ছিল তা অনেকটাই কমে এসেছে। সবার মধ্যে এখন দায়বদ্ধতারও বহির্প্রকাশ দৃশ্যমান। স্বউদ্যোগেই এখন মানুষ আয়কর প্রদান করছেন। সাধারণ মানুষ এটি বুঝেছে, সময়মতো আয়কর দেওয়া হলে যে কোনো ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনিয়োগে ভবিষ্যৎ ঝামেলা এড়ানো সহজ হয়।

এবার এনবিআরের পক্ষ থেকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকেও নিয়মিত করদাতা হিসেবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের ‘আয়কর পরিচিতি’পত্র প্রদান করা হয়। আয়কর মেলার শেষ দিনে সেরা করদাতা এবং কর বাহাদুর পরিবারের সম্মাননার আয়োজন সবার নজর কাড়ে। করবাহাদুর পরিবারের তালিকায় প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসি, সংসদ সদস্য এ কে এম রহমতুল্লাহ, ব্যবসায়ীদের মধ্যে বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান, এফবিসিসিআইর সাবেক সভাপতি আবদুল মাতলুব আহমাদ, ট্রান্সকম গ্রুপের চেয়ারম্যান লতিফুর রহমান, বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি কুতুব উদ্দিন আহমেদ ও আবদুস সালাম মুর্শেদী, ব্যবসায়ী আবদুল কাদের মোল্লা, সেরা করদাতা হাজী মো. কাউছ মিয়া, সৈয়দ আবুল হোসেনসহ আরও অনেকেই রয়েছেন। এ বছরই প্রথম ‘কর বাহাদুর’ হিসেবে সম্মাননা প্রদান করল এনবিআর। মোট ৮৪ পরিবারকে ‘কর বাহাদুর’ সম্মাননা প্রদান করা হয়েছে। কর বাহাদুরের মূল ধারণাটা হলো—যে পরিবারের একাধিক সদস্য কর প্রদান করছে, তারাই এই সম্মানে ভূষিত হয়েছে। আয়কর মেলার সমাপনী দিনে এবারই এই আয়োজন করা হয়েছিল এনবিআরের নতুন ভবনে। অনুষ্ঠানে অর্থমন্ত্রী, পরিকল্পনা মন্ত্রীসহ অভ্যন্তরীণ বিভাগের সিনিয়র সচিব ও এনবিআরের চেয়ারম্যান এবং অন্যরা উপস্থিত ছিলেন। শেষ দিনের ওই আয়োজনে এনআরবি চেয়ারম্যান মো. নজিবুর রহমান বলেন, মেলায় জনগণ কর দিয়ে হাসিমুখে ফিরে গেছেন। আয়কর মেলা জনগণের মাঝে এক নতুন আস্থা ও আত্মবিশ্বাস তৈরি করেছে। এনবিআর চেয়ারম্যান আরও বলেন, দেশে একটি রাজস্ববান্ধব পরিবেশ তৈরি হয়েছে। যা আমাদের অনুপ্রাণিত করেছে।

এনআরবি চেয়ারম্যান মো. নজিবুর রহমান তার প্রতিক্রিয়ায় যথার্থই বলেছেন বললে অতিশয়োক্তি হবে না। তিনি একজন সৃজনশীল, কর্মপ্রিয় মানুষ। দেশের সক্ষম জনগণের কাছ থেকে কর আহরণে তিনি যেসব নতুন নতুন পদ্ধতির ব্যবহার করছেন সেটি প্রশংসনীয়। আসলেই মেলায় এসে মানুষ কর দিয়ে হাসিমুখে ফিরে গেছে। আমরা দেখেছি মেলা শুরু হওয়ার পর অনেকেই ফেসবুকে সেরকম প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে স্ট্যাটাস দিয়েছেন। অনেকেই প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে সরাসরি বলেছেন, আয়কর মেলায় গিয়ে কর দিয়ে তিনি খুশি। আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা মঞ্জুর রশিদ ৪ নভেম্বর আয়কর মেলা থেকে ফিরে তার ফেসবুক ওয়ালে লিখেছিলেন এই বলে, ‘আয়কর মেলায় আসলাম, রিটার্ন জমা দিলাম, সুভেনির হিসেবে একটি চটের ব্যাগ পেলাম এবং স্মার্টকার্ড হাতে নিয়ে বাসার উদ্দেশে রওনা দিলাম। সব হলো মাত্র ১০ মিনিটে। সরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে জীবনের সেরা সেবা পেয়ে আমি মহাখুশি। ধন্যবাদ জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে এমন একটি সুন্দর আয়োজনের জন্য। তবে এই সুন্দর অনুভূতি যেন শেষ পর্যন্ত থাকে।’ ঠিক এরকম আরও অসংখ্য জনের প্রতিক্রিয়া সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখা গেছে। এটি তো সত্য যে, একটা বড় সময় পেরিয়ে গেলেও সরকার কর নির্ধারণ ও আহরণকে এখনো পূর্ণ নিয়মতান্ত্রিক জায়গায় আনতে পারেনি। দেশে করবান্ধব একটি গণতান্ত্রিক পদ্ধতি এখন গড়ে ওঠার পথে। ফলে কর আরোপ ও আদায় প্রক্রিয়ায় নানা ধরনের যে জটিলতা, হয়রানি দৃশ্যমান, তা কমিয়ে আনতে হবে।

একশ্রেণির কর কর্মকর্তার দুর্নীতি বরাবরই সুবিদিত। এখনো একশ্রেণির অসাধু কর্মকর্তা কর সংস্কৃতি গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা হিসেবে পরিগণিত। দেশের চেয়ে ব্যক্তিগত স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়ার কারণে কর দিতে সক্ষম ব্যক্তিদের তথ্য গোপন করতে সহায়তা করে তারা আত্মঘাতী কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে। আয়কর অফিসের কিছু কিছু কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ফাইল গায়েবের অভিযোগ রয়েছে। এসব কারণে সরকার বছরের পর বছর কোটি কোটি টাকা রাজস্ব হারিয়েছে। বিপরীতে আয়কর সংশ্লিষ্ট ছোটখাটো কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সরকারের কোষাগারে জমা দেওয়ার টাকা নিজেদের পকেটে নিয়ে রাতারাতি বিত্তশালী হয়েছে। যদি আগে থেকে এ দেশে একটা করবান্ধব সংস্কৃতি গড়ে তোলা যেত, তাহলে রাষ্ট্রই লাভবান হতো। সমসাময়িক সময়ে দেশের জনগণ বুঝতে সক্ষম হয়েছে, কর প্রদান করাটা নাগরিক দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। অবশ্য এর জন্য সর্বশেষ গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে সামান্য হলেও কৃতিত্ব দিতে হয়।

গত বছর দেশের অন্যতম গবেষণা সংস্থা সিপিডি বিবিসির কাছে বলেছিল, দেশে আয়কর দেওয়ার যোগ্য এমন মানুষের সংখ্যা ৮০ লাখের কম নয়। এই বিশালসংখ্যক মানুষ আয়করের বাইরে থাকায় উন্নয়নের ক্ষেত্রে যেমন আর্থিক সংকট তৈরি হচ্ছে, তেমনি অনেক ক্ষেত্রে বৈদেশিক সাহায্যের ওপর নির্ভরতাও বাড়ছে। এ সত্যকে সামনে রেখেই গত বছর সিপিডির সাবেক নির্বাহী পরিচালক ড. মুস্তাফিজুর রহমানের মন্তব্যটি উল্লেখ করতে চাই, ‘কর দেওয়া যে সুনাগরিকের দায়িত্ব সেটা মানুষকে সচেতন করা এবং করের টাকাটা কীভাবে ব্যবহার হচ্ছে এসব ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা দুটোই সমান্তরাল যেতে হবে।’ এটি হলে সক্ষম করদাতারা সবাই-ই কর দিতে উদ্বুদ্ধ হবেন, দেশ আরও স্বনির্ভর হবে।

এনবিআরের এরকম একটি পরিকল্পনা রয়েছে যে, আগামী ২০২১ সালের মধ্যে ৫০ লাখ মানুষকে করদানের আওতায় আনা হবে। এ জন্য দ্রুতই উপজেলা পর্যায়ে কর অফিস সম্প্রসারণ করা হচ্ছে। বর্তমানে দেশে ৩০ লাখ মানুষের ইলেকট্রিক কর শনাক্তকারী নম্বর (ইটিএন) থাকলেও করাদাতার সংখ্যা মাত্র ১২ লাখ। বিষয়টি নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। তবে কোনো কিছু যাচাই-বাছাই নিরূপণ না করে লক্ষ্য অর্জনের জন্য যখন-তখন কর বাড়ানোটাও সঠিক নয়। এর নেতিবাচক প্রক্রিয়া অনেক বেশি। এর চেয়ে উত্তম হলো কর বৃদ্ধির চেয়ে করের উৎসসমূহ বেশি করে চিহ্নিত করা এবং সেভাবে কাঠামো নির্ধারণ করা।

আয়কর প্রদানে জনগণের মাঝে যে উৎসাহ-উদ্দীপনা তৈরি হয়েছে সেই ধারাকে আরও এগিয়ে নিতে হবে। এই ধারাকে এগিয়ে নিতে না পারলে কর জিডিপি বাড়বে না। বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে কর জিডিপির অনুপাত বাড়ানো না গেলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করা কঠিন বিষয়। আইএফএমের মতে, গত পাঁচ অর্থবছরে জিডিপির অনুপাতে বাংলাদেশের গড় রাজস্ব আয়ের হার ১০.০৮ শতাংশ। এই হার না বাড়াতে পারলে দেশ স্বনির্ভরও হতে পারবে না। সবশেষে কর বাহাদুর সম্মাননা অনুষ্ঠানে এনআরবি চেয়ারম্যানের মূল্যবান বক্তব্য স্মরণ করব। তিনি বলেছিলেন, ‘আমাদের জন্য মূল শিক্ষা হলো আমরা যদি জনগণকে উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করে দিতে পারি, ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য উপযুক্ত ক্ষেত্র প্রস্তুত করে দিতে পারি তাহলে তারা রাজস্ব প্রদানে কখনই পিছ-পা হবে না।’ কর আদায়ের ক্ষেত্রে সরকারের এই দর্শনটি যথার্থ।

আর্থিকভাবে সক্ষম সবার কাছ থেকে কর আহরণ করা সম্ভব হলে অবশ্যই দেশ আরও উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাবে। তাই ‘সবাই মিলে দিব কর, দেশ করব স্বনির্ভর’—এই বার্তাটি সর্বসাধারণের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কর আহরণের সেই বার্তা নিয়ে জনগণের কাছে করবান্ধব পরিবেশ তৈরিতে সচেষ্ট থাকবে বলে আমাদের বিশ্বাস।

লেখক : চেয়ারম্যান, ডিবেট ফর ডেমোক্রেসি।

ই-মেইল : [email protected]

সর্বশেষ খবর