সোমবার, ৪ ডিসেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা
ধর্মতত্ত্ব

পুলসিরাতের পুল রসুল (সা.)

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

পুলসিরাতের পুল রসুল (সা.)

বিশ্বের অন্যসব মহামনীষী এবং মুহাম্মদ (সা.)-এর মধ্যে পার্থক্যটুকু কোথায় তা জানিয়ে দিয়ে পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা বলছেন, ‘লাকাদ কানা লাকুম ফি রসুলুল্লাহি উসওয়াতুন হাসানাহ। হে দুনিয়ার মানুষ শোন! তোমাদের জন্য মুহাম্মদ (সা.)-এর মধ্যেই রয়েছে অনুপম আদর্শ।’ অর্থাৎ, অনুসরণ-অনুকরণের  জন্য আর কেউই এত বেশি যোগ্য নন। এমনকি অন্যসব নবী-রসুলও মানবজাতির জন্য পূর্ণাঙ্গ মডেল হতে পারেননি।  অন্য মহামনীষীরা তো নয়ই।

মুহাম্মদ (সা.) আমাদের জন্য অনুপম আদর্শ এ কারণে যে, তার পুরো জীবনে একটি কালো দাগও নেই। এ ছাড়া পৃথিবীর শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যত নবী-রসুল, ধর্মগুরু, জ্ঞানগুরু, রাজনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ, সংসারী-বৈরাগী— এককথায় যত আলোকিত মানুষ এসেছেন তাদের সবারই জীবনে কোনো না কোনো অংশে কালোর ছাপ পড়েছে। দৈবক্রমে যদি এদের কাউকে মানবজাতির মডেল বানিয়ে দেওয়া হতো তবে ওই কালো দিকটিও আমাদের জন্য অনুকরণ-অনুসরণ করা জরুরি হয়ে পড়ত। তাই আল্লাহতায়ালা এমন একজনকে মানবজাতির মডেল বলে ঘোষণা করেছেন, যার ব্যাপারে বিশ্লেষকরা একবাক্যে স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন, তিনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব। এদের অনেকেই মুহাম্মদ (সা.)-এর ধর্মবিশ্বাসের সঙ্গে একমত নন। কিন্তু তিনি যে মহামানব এ বিষয়ে তাদের কোনো দ্বিমত নেই। মজার ব্যাপার হলো, যারা মুহাম্মদ (সা.)-কে মহামানব বলে স্বীকার করেননি, তাঁর নিন্দায় ছিল অগ্রগামী, তারাও এমন কোনো শক্ত যুক্তি-প্রমাণের ওপর ভিত্তি করে কথা বলতে পারেননি, যা সমালোচকদের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে পারে।

তাহলে দেখা গেল, আমরা এমন একজন মানুষকে মডেল হিসেবে পেয়েছি যার মহত্বের ব্যাপারে কারও দ্বিমত নেই। আর যারা এ ব্যাপারে প্রশ্ন তুলেছেন তাদের প্রশ্নও যথার্থ না হওয়ায় ইতিহাস তা গণনায় ধরেনি। এটা অবশ্যই আল্লাহতায়ালার বিশেষ অনুগ্রহ ছাড়া আর কিছুই নয়। আল্লাহতায়ালা নিজেই বলছেন, ‘ওয়ামা আরসালনাকা ইল্লা রাহমাতাল্লিল আলামিন। হে মুহাম্মদ (সা.)! আমি আপনাকে বিশ্ববাসীর জন্য দয়ার সাগর করে পাঠিয়েছি।’ এ সাগরের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো, এতে কেউ কোনো খুঁত খুঁজে পাবে না। তাই যারাই এ সাগরের বুকে জীবনতরী ভাসিয়ে দেবে তাদের মতো সৌভাগ্যবান আর কেউই হবে না।

আর যারা এর থেকে এক-আধ জগ-মগ-গ্লাস পানি নেবে তারাও এর স্বচ্ছতা-সৌন্দর্যের স্বীকৃতি দেবে এবং এর সৌন্দর্য অনুভব করবে। এমনকি যারা তীরে দাঁড়িয়ে সাগরের বুকে চোখ রাখবে তারাও এর সৌন্দর্য দেখে অভিভূত হয়ে পড়বে। আর যেসব হতভাগ্য এর বুকে কোনো আঁছড় টানতে চাইবে, আফসোস! তাদের কোনো দাগই স্থায়ী হবে না। আমরা সেই দয়ার সাগর নবীজির দেখানো পথেই জীবন তরী ভাসিয়ে মনজিলে মকসুদের উদ্দেশ্যে পথ চলছি। তাই আমাদের চেয়ে সৌভাগ্যবান জাতি যেমন আর কেউ নেই, আবার আমাদের মতো বিপদেরও কেউ নেই। ‘বিপদ’ এ জন্যই বলছি, আমাদের চলাফেরা, ওঠাবসা, হাসি-কান্না, ব্যবসায়-বাণিজ্য, শিক্ষা-দীক্ষা, রাজনীতি-অর্থনীতি এককথায় এ টু জেড কোনো একটি অংশে যদি সামান্য পরিমাণ দোষ প্রকাশ হয়ে পড়ে, তবে মানুষ এ কথা বলার সুযোগ পাবে যে, দেখ! শ্রেষ্ঠ নবীর উম্মত হয়ে কী লাভ হলো? সেও মিথ্যা কথা বলে আমিও মিথ্যা কথা বলি। সেও চুরি করে, অন্যায় করে, দুর্নীতি করে, আমিও করি।

একটু ভাবুন তো, দুনিয়ার মানুষের কাছে যেন আমরা গর্ব করে বলতে পারি, শ্রেষ্ঠ মানুষটিই আমাদের উসওয়া বা আদর্শ। তাই আল্লাহতায়ালা নিখুঁত একজন মানুষকে আমাদের নবী এবং আদর্শ বানালেন। তো আমাদেরও কী সেরকম উম্মত হয়ে দুনিয়াকে দেখিয়ে দিতে হবে না, আমাদের নবী যেমন শ্রেষ্ঠ আমরাও তেমনি শ্রেষ্ঠ উম্মত। তা ছাড়া আমরা যেমন মানুষের কাছে গর্ব করে বলতে পারি আমাদের নবীর মতো শ্রেষ্ঠ মহামানব আর কেউ নেই, নবীজি (সা.)ও যেন অন্যসব নবী ও তাদের উম্মতদের সামনে আমাদের নিয়ে গর্ব করতে পারেন। একটি হাদিসে কিন্তু রসুল (সা.) সে ইঙ্গিতই দিয়েছেন। আম্মাজান আয়শা (রা.)কে বলেছেন, ‘কেয়ামতের দিন আমি আমার উম্মতদের নিয়ে গর্ব করব।’

প্রিয় আশেকে রসুলগণ! একটিবার নিজেকে প্রশ্ন করুন— আপনি-আমি কী সেই পর্যায়ের উম্মত হতে পেরেছি, যাকে নিয়ে হুজুর (সা.) গর্ব করতে পারবেন। আমি সেই উম্মত হতে পেরেছি কী, যাকে নবীজি নিজ হাতে হাউসে কাওসারের পানি পান করাতে চাইবেন।

আমার দ্বীনি ভাইগণ! হুজুর (সা.) আমাদের আদর্শ বলে তো কোরআন ঘোষণা করেছে। কিন্তু আমরা কতটুকু এ আয়াতকে আমাদের জীবনে ধারণ করতে পেরেছি? ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরি-বাকরি, ওঠা-বসায়, খাওয়া-দাওয়ায়, ঘরে-বাইরে কোথায় কোথায় আমরা নবীজিকে মেনে চলছি? কেউ ঘরে মানছে তো বাইরে মানছে না। বাইরে মানছে তো সমাজে মানছে না। আবার কেউ সমাজে মানলে রাষ্ট্রে মানে না। রাষ্ট্রে মানলে অর্থনীতি, ব্যবসায় মানে না। অর্থাৎ আমরা কেউই পূর্ণভাবে নবীজি (সা.)-এর জীবনাদর্শ অনুসরণ করছি না। অথচ, কোরআন স্পষ্টভাবে বলছে, মানতে হলে নবীজিকে পুরোপুরিই মানতে হবে।

এই রবিউল আউয়ালের চাঁদকে সাক্ষী রেখে আজ আমরা পণ করি, আজ থেকে, এখন থেকেই প্রাণের নবীকে জীবনে ধারণ করব।  জীবনের সর্বক্ষেত্রে তাঁর জীবন ব্যবস্থা মেনে চলব। আমরা হব সাচ্চা মানুষ/‘রসুল অনুসারী-/রসুল প্রেমিক হয়ে দেব/জীবন নদী পাড়ি।/দেশ বিদেশে ছড়িয়ে দেব/লা-ইলাহার সুর/ডাকবে পাখি ফুটবে গোলাপ/আঁধার হবে দূর।’

লেখক : বিশিষ্ট মুফাসসিরে কোরআন ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব।

www.selimazadi.com

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর