শুক্রবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

মুক্তির পয়গাম ও বিশ্বনবী মুহাম্মদ (সা.)

মুফতি আমজাদ হোসাইন হেলালী

মুক্তির পয়গাম ও বিশ্বনবী মুহাম্মদ (সা.)

মুক্তির পয়গাম নিয়ে দুনিয়ার বুকে আগমন করেন মহামানব রহমতে আলম রসুলে আরাবি (সা.)। তখন যেন দুনিয়ার আনাচে-কানাছে শোনা যাচ্ছিল মুক্তিদূতের আগমনধ্বনি। যার আগমনধ্বনিতে আনন্দিত গোটা বিশ্ব, আকাশ-বাতাস ও বৃক্ষ-তরুলতা। আন্দোলিত প্রকৃতি, শিহরিত বাতাস, জোনাকিতে আলোর বন্যা। মুখ লুকানো চাঁদ যেন স্নিগ্ধ হাসিতে জেগে ওঠে। জেগে ওঠে প্রভাতরবি। এই মহামানব যখন পবিত্র মক্কা থেকে হিজরত করে মদিনায় পা রাখতে যাচ্ছিলেন, তখন মদিনার ছোট-বড় সবাই গেয়েছিল কতিপয় ছন্দ, যে ছন্দগুলো আজো মানব হৃদয়ে আনন্দের বন্যা ছড়িয়ে দেয়। তারা গেয়েছিল, ‘তালায়াল বাদরু আলাইনা * মিনসানি ইয়াতিল বিদা। ওয়াজাবাস শুকরু আলাইনা * মাদায়া লিল্লাহ হিদা।’ বাস্তবিকই এক মহাক্ষণে, মহা এক দুর্দিনে মহামানব হজরত মুহাম্মদ (সা.) মুক্তির পয়গাম নিয়ে এ ধরায় আবির্ভূত হন। নবীজির আগমনে কবি-সাহিত্যিকরা রচনা করেছেন শত শত কবিতা ও পঙিক্ত, যা ইতিহাসের কিতাবে আজো বিদ্যমান এবং কিয়ামত পর্যন্ত বিদ্যমান থাকবে। নবীজির আগমনের আগে মানুষের ধর্মীয় অবস্থা ছিল খুবই শোচনীয়। মানুষ কর্তৃক হজরত ঈসা, মুসা (আ.) ও অন্য নবী-রসুলদের তাওহিদের শাশ্বত আদর্শ হচ্ছিল ভূলুণ্ঠিত। তাদের উম্মতদের মাঝে কেউ বা আপন স্রষ্টাকে অস্বীকার করে নাস্তিক, কেউ বা ধর্মের নামে পাথরপূজা, কিংবা মাটির পূজায় লিপ্ত। একদিকে আপন স্রষ্টাকে অস্বীকার করার মতো অহমিকা ও মূর্খতা প্রকাশ করে; অন্যদিকে সৃষ্টিকেই স্রষ্টা বা প্রভু মনে করার মতো হীনমানসিকতা প্রকাশে মানব জাতি ছিল ব্যস্ত। এভাবেই সেদিন সমাজে বিরাজ করছিল সামাজিক নৈরাজ্য। আধ্যাত্মিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক প্রতিটি ক্ষেত্রে শোষণ, অবিচার, অনাচার ও ব্যভিচার হয়ে উঠেছিল নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। এরই ফলে মানবসমাজে সুখ-শান্তি ও প্রগতির আশা-আকাঙ্ক্ষা হয়ে গিয়েছিল সুদূরপরাহত। কিন্তু মহানবী (সা.) তার মুক্তির বাণীতে মানুষকে আন্দোলিত করে প্রতিষ্ঠিত করলেন মহামর্যাদায়। মানুষকে দিলেন তার আসল পরিচয়, কর্মপথ ও পাথেয়। যে মানুষ স্রষ্টাকে ভুলে গিয়ে সৃষ্টিকেই খোদার মর্যাদা দিয়ে আরাধনায় লিপ্ত ছিল তাদের আধ্যাত্মিক অবক্ষয়ের অন্ধকার থেকে মুক্তি দিলেন এই বলে যে, সব সৃষ্টির স্রষ্টা একমাত্র আল্লাহ। তিনি ছাড়া আর কোনো উপাস্য নেই। এখন থেকে তিনি ছাড়া আর কারও ইবাদত নয়।

রহমতে আলম (সা.) মানুষকে বোঝালেন : ‘মানুষ যেমন কারও খোদা হতে পারে না, তেমন মানুষ আল্লাহ ছাড়া কারও ইবাদত করতে পারে না।’ এমনকি তিনি বলিষ্ঠ কণ্ঠে ঘোষণা করে দিলেন, হে মানব জাতি! তোমরা বল, আল্লাহ ছাড়া আর কোনো মাবুদ নেই, মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর রসুল। অর্থাৎ এই কথাটি যদি তোমরা মনে-প্রাণে বিশ্বাস কর, জবানে স্বীকার কর এবং অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দ্বারা বাস্তবায়ন কর তাহলে অবশ্যই তোমরা ইহ ও পরকালে সফলতা অর্জন করবে। এবং তিনি আরও ইরশাদ করেছিলেন যে, অসংখ্য বানোয়াট খোদার উপাসনা বর্জন করে এক আল্লাহর ইবাদতে মগ্ন হও। নবী (সা.)-এর কথা মেনে যারাই ইমান এনেছিল, তারাই পেয়ে গেল নিজেদের সঠিক পরিচয়। এক আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস, রসুল, কোরআন, ফেরেশতা ও ইসলামের মূল আকিদা-বিশ্বাস মানুষকে নিমিষেই মুক্তি দিল কুফরি ও শিরকির অন্তঃসারশূন্যতা ও হীনমন্যতা থেকে। মানুষ মর্যাদা লাভ করল সৃষ্টির সেরা ‘আশরাফুল মাখলুকাত’রূপে। আল্লাহর একাত্মবাদের ওপর বিশ্বাস ও অবিচল থেকে জেগে উঠল শোষিত, বঞ্চিত মজলুম জনতা। চারদিকে জ্বলে উঠল সত্যের উজ্জ্বল মশাল। সত্যের এই আলোকরশ্মি অন্ধকারতর ধূসর মরু আরবের সব অন্ধকারের সমাধি রচনা করতে ছড়িয়ে পড়ল সর্বত্র। পরবর্তীতে সাহাবায়ে কিরামদের অক্লান্ত পরিশ্রমে অত্যাচারীর সব অত্যাচার ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। বিলুপ্তি ঘটতে লাগল সব তাগুতি শক্তির। সত্যের এই প্রদীপ-শিখা ছড়িয়ে পড়ল বিশ্বব্যাপী। তাই অতি দ্রুত পৃথিবীবাসীর প্রতি বর্ষিত হলো রহমতের বারিধারা। দলে দলে লোক ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে এসে নিল স্বস্তির নিঃশ্বাস। মরু আরবের দুর্ধর্ষ, অধঃপতিত অজ্ঞ জাতি হয়ে উঠল পরবর্তীতে সর্বকালের সব মানুষের আদর্শের শিক্ষক। তারই আদর্শ অনুসরণের ফলে পৃথিবীর মানচিত্রে সর্বশ্রেষ্ঠ জাতি হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছিল মুসলিম জাতি। যে জাতির নাম শুনলে বিজাতীয়দের হৃদয় দুরু দুরু করে কাঁপতে থাকত। যে জাতির হুঙ্কারে কিসরা কায়সারের রাজসিংহাসনে কম্পনের সৃষ্টি হতো। রহমতে আলম হজরত রসুলে আরাবি (সা.)-এর সহবত পেয়ে মানুষ হলো প্রকৃত মানুষ। শুরু হলো জ্ঞান-বিজ্ঞানে মানুষের অগ্রযাত্রা। তিনি আমির-ফকির ও ধনী-গরিবের বিভক্তির অবসান ঘটিয়ে মানুষকে আল্লাহর বাণী শুনিয়ে দিলেন, ‘হে মানব! আমি তোমাদের এক পুরুষ ও এক নারী থেকে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদের বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যাতে তোমরা পরস্পরে পরিচিত হও। নিশ্চয় আল্লাহর কাছে সে-ই সর্বাধিক সম্ভ্রান্ত, যে সর্বাধিক পরহেজগার। নিশ্চয় আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সবকিছুর খবর রাখেন।’ (সূরা হুজুরাত : ১৩)। আল্লাহর বাণীর ঘোষণায় রক্ত, বর্ণ ও বংশগত আভিজাত্যের সব গরিমা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেল। আরব-অনারব সাদা-কালোর পার্থক্য টুটিয়ে রসুল (সা.) ঘোষণা দিলেন, ‘মানুষ এক আদম থেকে সৃষ্টি। আর আদমের সৃষ্টি মাটি থেকে। সুতরাং এখানে উঁচু-নিচুর প্রশ্ন নিতান্তই অবান্তর।’ রসুলের আদর্শে মুক্তি পেল নারীসমাজ। যাদের শুধু ভোগপণ্য হিসেবে ব্যবহার করা হতো। যাদের সমাজে কোনো অধিকার ছিল না, ছিল না কোনো মূল্যায়ন। আমাদের নবী (সা.) এসে জানালেন, ‘তারা মায়ের জাতি তাদের মর্যাদা সুউচ্চে।’ আজ আবার কেন সেই মায়ের জাতি নির্যাতন, নিপীড়ন ও লাঞ্ছনার শিকার? কেন তারা অশুভশক্তির কাছে পদানত? এর একটিই মাত্র কারণ, তা হলো আজকের মুসলিম জাতি মহানবী (সা.)-এর আদর্শ পরিহার করে অশুভশক্তির আদর্শে নিজেদের গা ভাসিয়ে দেওয়ার কারণেই এমনটি হচ্ছে। প্রিয় পাঠক! অশুভশক্তির প্ররোচনার পেছনে না পড়ে আজও যদি আমরা মহানবী (সা.)-এর আদর্শ জীবনের সব ক্ষেত্রে বাস্তবায়ন করতে তৎপর হই, তাহলে আজও সেই ঐতিহ্য, সেই গৌরব ফিরে আসবে ইনশা আল্লাহ। প্রতিষ্ঠিত হবে শান্তি ও সুখের সমাজ এবং মানুষ ফিরে পাবে তাদের হারানো সম্পদ। প্রিয় পাঠক! চলুন, মুক্তির এই মহান বার্তাবাহক এবং মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার নির্ভীক রূপকার, সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে আপসহীন এবং সর্বকালের সর্বশেষ নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে সবাই একসঙ্গে বলি, ‘হে রসুল (সা.) আপনাকে জানাচ্ছি শত-কোটি দরুদ ও সালাম।’

লেখক : মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও খতিব; বারিধারা ঢাকা।

সর্বশেষ খবর