বুধবার, ২৭ ডিসেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

‘সমাজতন্ত্র’ শব্দটি প্রতারণামূলক

আলাউদ্দিন মল্লিক

প্যারি কমিউন ১৮৭১ সালে মাত্র ৬১ দিন (মতান্তরে ৭১ দিন) ক্ষমতায় টিকে থাকতে পেরেছিল। কার্ল মার্কস একে শ্রমিক শ্রেণির একনায়কত্ব হিসেবে উল্লেখ করেছেন। জাকুবিনদের সঙ্গে সমাজতন্ত্রীদের কর্তৃত্ব নিয়ে বিরোধ এবং সাম্রাজ্যবাদী শক্তির যৌথ অভিযানে এই মহান উদ্যোগ অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়। বহু সমাজবাদী একে শোষণযুক্ত সমাজ ব্যবস্থার বিদায় ঘণ্টা বলে অভিহিত করে। ২০১৭ সাল সারা বিশ্বে রুশ সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের শতবর্ষ পালন করছে। ১৯১৭ সালের ৭ নভেম্বর লেনিনের নেতৃত্বে রুশ শ্রমিক শ্রেণি পৃথিবীর প্রথম সমাজতান্ত্রিক দেশের অভ্যুদয় ঘটায়। এটি বিশ্বব্যাপী মেহনতি মানুষের একটি আলোকবর্তিকা হয়ে উঠল। যার ফলে বিশ্বে মাত্র ৫০ বছরের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক দেশ একই মতবাদের অনুসারী হয়ে উঠল। কার্ল মার্কসের কমিউনিজমের মতবাদটি সারা বিশ্বে বাস্তবে কার্যকরী হয়ে গেল। বিশ্ব মানবতা শোষণের বিপরীতে একটি মানবিক সমাজ গঠনের স্বপ্নে বিভোর হয়ে উঠল। কিন্তু আশির দশকে এসে বিষয়টি আর তেমনটি থাকল না। পূর্ব ইউরোপের সমাজতন্ত্রের পতনের পর ক্রমান্বয়ে তা সোভিয়েত ইউনিয়নকে যখন পুঁজিবাদে পরিণত করল তখন বিপ্লবের শক্তিগুলো আর স্বপ্নচারী মানুষগুলো যেন বাক্যহারা হয়ে গেল। তবে কী সমাজতন্ত্র মতবাদই ভুল? তবে কী পুঁজিবাদই শেষ কথা? ভুলটা আসলে কোথায়? কেন সমাজতন্ত্রের এত বড় বিপর্যয়?

কার্ল মার্কস যে কমিউনিজমের মতবাদ প্রকাশ করেন, তাতে সমাজ বিকাশের ধারা হিসেবে পুঁঁজিবাদ পরবর্তী ধাপ হিসেবে কমিউনিস্ট সমাজের উল্লেখ করেছেন। তার মতে পুঁঁজিবাদ পরবর্তী সমাজ ব্যবস্থাটি হবে শোষণহীন এবং তাতে মানুষ সামর্থ্য অনুযায়ী পরিশ্রম করবে এবং প্রয়োজন অনুযায়ী ভোগ করবে। এক সময় রাষ্ট্রহীন সমাজ হবে মানবিক। কার্ল মার্কসের মতে, পুঁঁজিবাদের অগ্রসর দেশগুলোতে সাম্যবাদী সমাজ আগে গঠিত হবে। সত্যিকার অর্থে মার্কস তার তত্ত্বে ‘সমাজতন্ত্র’ শব্দটি উল্লেখ না করে সমাজের পরবর্তী ধাপ সাম্যবাদের কথাই বলেছেন। তাহলে সমাজতন্ত্র শব্দটি কীভাবে এখানে ঢুকে পড়ল আর সে বিষয়টি কীভাবে সাম্যবাদের সমার্থক হয়ে উঠল, তা বোঝা মুশকিল। সমাজতন্ত্র শব্দটির ব্যাপক পরিচয় ঘটে মূলত লেনিনের রাশিয়ায় বিপ্লবের পর। কার্ল মার্কসের প্রতিষ্ঠিত প্রথম কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক ও ইউরোপের অন্যান্য সমাজবাদীরা রুশ বিপ্লবের জন্য লেনিন যে তত্ত্বটি দাঁড় করান, তা মানতে না পারলেও ১৯১৭ সালে বিপ্লব সফলের পর তত্ত্বটি সবাই মেনে নেন। লেনিন সঠিকভাবেই জানতেন জার-শাসিত রাশিয়ার ইউরোপ অংশ বাদ দিলে পুরোটাই ইউরোপীয় রাশিয়ার অভ্যন্তরীণ উপনিবেশ। আর ইউরোপীয় অংশ যেহেতু শিল্পোন্নত, তাই রাশিয়া পুঁঁজিবাদের অন্তর্গত। আর সারা রাশিয়া (ইউরোপীয় অংশ বাদে) তার উপনিবেশ। অন্যরা যেখানে রাশিয়াকে সামন্তবাদী হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন, লেনিন সেখানে রাশিয়াকে দুর্বল পুঁঁজিবাদ হিসেবে দেখছেন। আর তাই জারকে রাজধানী মস্কো থেকে বিতাড়িত করে ক্ষমতা নেওয়ার মাধ্যমে তিনি পৃথিবীর প্রথম প্রলেতারিয়েত ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত করতে পারলেন। এটি ছিল অচিন্তনীয়, অভাবনীয় একটি সমাজবাদী সমাজের মডেল—যা সমাজ বিপ্লবীদের ভিতর নতুন আশাবাদ তৈরি করল। লেনিন সমাজতন্ত্রের মাধ্যমে সাম্যবাদী সমাজে পৌঁছানোর যে তত্ত্ব (মডেলের আকারে) বাস্তবায়িত করলেন তা ছিল বৃহত্তর জনমানুষের জন্য খুবই ইতিবাচক। কিন্তু শব্দের আর বুঝের ব্যাপক তারতম্যের কারণে একটি বিরাট ভুলটিই হয়ে উঠল সবার কাছে গ্রহণযোগ্য। সবাই সমাজতন্ত্র আর সাম্যবাদের মূল পার্থক্যটা আর ধর্তব্যের মধ্যে আনলেন না। বরং সমাজতন্ত্র আর সাম্যবাদ হয়ে উঠল সমার্থক।

ব্রিটিশ-ভারতের বিখ্যাত পণ্ডিত নিরোদ চন্দ্র চৌধুরী (এন সি চৌধুরী, যিনি ভারতের শেষ সাম্রাজ্যবাদী বলে পরিচিত) ভারতের স্বাধীনতা প্রসঙ্গে তার মত দিয়েছিলেন, ভারত স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত নয়। সময়ের আগে কোনো কিছু পাওয়া অনেক সময়ই হিতে বিপরীত হয়। লেনিন যেখানে সমাজতন্ত্রকে পুঁজিবাদকে পাশ কাটিয়ে সাম্যবাদে যাওয়ার বিষয়টি সুস্পষ্ট করে উল্লেখ করে গেছেন, সেখানে তার উত্তরসূরিরা এবং সমাজ বদলের লড়াইয়ের সৈনিকরা বেমালুম বিষয়টিকে সমার্থক করে বলে ফেললেন। আশির দশকের প্রথম দিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন তার দেশকে ‘উন্নত সাম্যবাদী’ সমাজ নির্মাণের ঘোষণা দেয়। সমস্ত পৃথিবীর সামনে উপস্থাপিত তাদের ঘোষণাটি একটি বিরাট প্রতারণামূলক বিষয় ছিল। এটি কার্ল মার্কস প্রবর্তিত কমিউনিজম ধারণার সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। এটি লেনিনের বিপ্লব এবং পুঁজিবাদকে পাশ কাটানোর তত্ত্বের সঙ্গেও সাংঘর্ষিক। কেন এ ধরনের আত্ম-ধ্বংসমূলক বিষয়টি প্রধান হয়ে সবার মাঝে ছড়িয়ে গেল তা নিয়ে রীতিমতো একটি গবেষণা হতে পারে। তবে সমাজ প্রগতির আন্দোলনের যে ক্ষতিটি পুঁঁজিবাদীরা করতে পারেনি, সেটি এর ভিতর থেকেই সাধিত হলো। তাই যখন সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের শাসন ব্যবস্থা ওই দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ পরিবর্তন আর জনসাধারণের ইচ্ছায় পরিবর্তিত হয়ে পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় চলে গেল, তখন সবার মাথায় ভাঁজপড়ার অবস্থা হতেই পারে। দুই বাংলার জনপ্রিয় লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে এটি ‘ইতিহাসের স্বপ্নভঙ্গ’। আমরা আজ যেভাবেই ব্যাখ্যা করি না কেন, ঘটনাগুলো আর ফেরত আনা যাবে না। কিন্তু আজ সময় এসেছে, নিজের মুখোমুখি হওয়ার। সময় এসেছে সত্যকে মেনে নেওয়ার। আর অবশ্যই প্রতারণামূলক আচার-আচরণ থেকে নিজেদের মুক্ত করার মাধ্যমে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষা করার। সাম্যবাদকে তার সত্যিকার স্থানে অধিষ্ঠিত করে সমাজতন্ত্রের সঙ্গে তার সুস্পষ্ট পার্থক্য তুলে ধরে সামনের দিকে এগোবার সময় এখন। আরও বড় কোনো ক্ষতি করার আগেই ‘সমাজতন্ত্র’ শব্দটি আমাদের চেতনায় যে প্রতারণামূলক অর্থ প্রকাশ করে, তার আশু পরিবর্তন করে সঠিক শব্দের চর্চায় তাকে নিয়ে আসতে হবে।

লেখক : গণতান্ত্রিক শাসন ও সমাজ বিশ্লেষক।

সর্বশেষ খবর