শনিবার, ৩০ ডিসেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

সমন্বিত কৃষির এক আদর্শ উদ্যোক্তা

শাইখ সিরাজ

সমন্বিত কৃষির এক আদর্শ উদ্যোক্তা

আর মাত্র এক দিন পরই শেষ হয়ে যাবে ২০১৭ সাল। কালের গর্ভে হারিয়ে যাবে আরেকটি বছর। সময় দ্রুত চলমান; এরই সঙ্গে চলমান মানুষের জীবন-জীবিকা, চিন্তা, স্বপ্ন, সাফল্য সবকিছু। সময়ের এ পরিবর্তনকে নিবিড়ভাবে উপলব্ধির জন্য আমরা কৃষির দিকে তাকিয়ে আছি। দুই, তিন বা চার দশকের বিবেচনায় এ খাতের মতো পরিবর্তন আর কোথাও আসেনি। একমাত্র কৃষি খাত সামনে রেখেই বলা যায় প্রতিটি দিন পরিবর্তিত। প্রতিটি দিন পাল্টে যাওয়া। একসময় কৃষক একা কৃষি নিয়ে ভাবত, এখন সেই ভাবনা ভাগ হয়ে গেছে। কৃষিতে বড় বড় ব্যবসায়ী এসেছেন। কৃষির বাণিজ্যিক পরিধিও বিশাল আকার ধারণ করেছে। এখন কৃষির লাভ-লোকসানের হিসাব শুধু গ্রামের সাধারণ প্রান্তিক একজন কৃষকই কষেন না, কষেন বড় ব্যবসায়ীরাও। কারণ তারাও এখন সবচেয়ে লাভজনক খাত হিসেবে বিনিয়োগ করছেন কৃষিতে। অনেকে শখের বশে কৃষি শুরু করে পরে এখানে খুঁজে পাচ্ছেন বিশাল লাভের এক ক্ষেত্র। শৌখিনতা থেকে বাণিজ্যিক কৃষিতে এসে সাফল্য অর্জন করছেন অনেকেই। সাফল্য অর্জনের বহু উদাহরণ ইতিমধ্যে গড়ে উঠেছে দেশে। নতুন প্রজন্ম যেমন শিক্ষিত হয়ে এগ্রো বিজনেসের পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নামছে, একইভাবে বড় ব্যবসায়ীরাও জীবনে একটু সুখের সন্ধানে ফিরে আসছেন মাটির কাছে। এমন এক ব্যবসায়ী শিল্পোদ্যোক্তা হারুন অর রশীদ। তিনি জীবনের অর্থ খুঁজে নিয়েছেন কৃষিতে। একজন সফল শিল্পপতি ও তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক। তার গার্মেন্ট কারখানার সুবিশাল ছাদে তিনি গড়ে তুলেছেন মনোরম ছাদকৃষি। সে এক বিশাল কর্মযজ্ঞ। ছাদে ফল-ফসলের এক বিশাল ক্ষেত্র গড়ে তুলেছেন। এমনকি ছাগল পালনও শুরু করেছেন। বছর দুয়েক হলো আমি ‘ছাদকৃষি’ নামে নাগরিক কৃষিকাজভিত্তিক একটি অনুষ্ঠান করছি। এ অনুষ্ঠানে বহু পেশাজীবী, বাড়িমালিকের কৃষির প্রতি অনুরাগ দেখে অভিভূত হয়ে যাই। আজকের দিনে এই ছাদকৃষি এক অপরিহার্য উদ্যোগ। আমরা স্বপ্ন দেখি রাজধানীসহ প্রতিটি নগর-মহানগরের উপরিভাগে সবুজের এক নতুন স্তর গড়ে উঠুক। যেখানে প্রচুর ফল-ফসল উৎপাদন হোক, একই সঙ্গে শহরগুলোর পরিবেশ হয়ে উঠুক আরও স্বাস্থ্যকর ও সজীব। এ বিষয়গুলো শিল্পপতি হারুন অর রশীদও বিশ্বাস করেন। মাস দেড়েক আগে যখন তার গার্মেন্ট কারখানার ছাদে অনুষ্ঠান ধারণ করতে যাই, তখন মনে হয়েছে দেশের সব শিল্পপ্রতিষ্ঠানের ভবনের ছাদে যদি ছাদকৃষি গড়ে উঠত তাহলে সেখানে কৃষি উৎপাদনের নতুন এক অধ্যায় সূচিত হতো। যাই হোক, হারুন অর রশীদ সেদিন বলেছিলেন, শুধু গার্মেন্টের ছাদেই নয়, কৃষি তিনি মাঠেও করেন। তার একটি সমন্বিত খামার রয়েছে নারায়ণগঞ্জ সদরের দাসেরগাঁওয়ে। গত সপ্তায় ঘুরে এলাম তার খামার। বিশাল এলাকাজুড়ে হারুন অর রশীদের সমন্বিত কৃষি খামার। ব্যবসা-বাণিজ্যের পাশাপাশি একরকমের শৌখিনতা থেকেই ১৯৮২ সাল থেকে কৃষিকাজের চর্চাও চালু রাখেন তিনি। বলা যায়, কৃষক পরিবারের সন্তান হিসেবে একরকমের অনুরাগ ও দায়িত্ব থেকেই কৃষির সঙ্গে যুক্ত থাকা। অবাক ব্যাপার হচ্ছে, ৩৫ বিঘা আয়তনের খামারে তিনি কৃষির সব খাতের এক দারুণ সমন্বয় রচনা করেন। দেশি-বিদেশি ফলের বাগান, শাক-সবজির আবাদ, মাছ, হাঁস-মুরগি, টার্কি মুরগি, ছাগল, গরু পালন সব রয়েছে।

ঢুকতেই চোখে পড়ল ছাগলের খামার। সেখানে পালন করা হচ্ছে উন্নত জাতের পাটনার ছাগল ও ভারতীয় গাড়ল। ছোট-বড় মিলিয়ে ৫০টির মতো ছাগল ও গাড়ল রয়েছে। হারুন অর রশীদ জানালেন, ছাগল ও গাড়ল ছয় মাস অন্তর বাচ্চা দেয়। ২০ থেকে ৩০টি বাচ্চা পাওয়া যায়। দুই মাস বয়সী প্রতিটি বাচ্চার দাম ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা। প্রতি ছয় মাস অন্তর এসব ছাগল থেকে ৩-৪ লাখ টাকা আসে।

আরেক পাশে পালন হচ্ছে টার্কি। ওই খামারে বড় আকারের টার্কি রয়েছে ১০০টি। এ ছাড়া বিভিন্ন আকারের টার্কি রয়েছে চার শর মতো। সেখান থেকে প্রতিদিন পাওয়া যায় ৩০ থেকে ৩৫টি ডিম। টার্কির ডিম থেকে ইনকিউবিটারে বাচ্চা ফোটানোর ব্যবস্থা রয়েছে। সম্পূর্ণ দেশীয় পদ্ধতির কারণে খরচও হচ্ছে কম। হারুন অর রশীদ জানালেন, দিন দিন বড় হচ্ছে টার্কির খামার। প্রতি হালি ডিম বিক্রি করছেন ৮০০ টাকা দরে। টার্কি বিক্রি করছেন ৩০০ টাকা কেজি দরে। একেকটি এক বছর বয়সী টার্কির ওজন ৮ থেকে ১০ কেজি।

আরেক পাশে গাভীর খামার। ষাঁড়, গাভী, বাছুর সব মিলিয়ে ৫৫টি গরু আছে সেখানে। আগামী বছর নাগাদ খামারে ব্রাহমা জাতের গরু লালন-পালন শুরু হবে। ইতিমধ্যে কয়েকটি গাভীর ব্রাহমা জাতের সিমেন প্রয়োগ করা হয়ছে। এখনো বাচ্চা হয়নি। দুগ্ধ খামারে প্রতিদিন দুধ পাওয়া যাচ্ছে প্রায় ১০০ লিটারের মতো। ৭০ টাকা লিটার দরে সেই দুধও বিক্রি করছেন।

এসব গাভীর খামারের গোবর দিয়ে তৈরি করা হচ্ছে জৈব সার; যা এখানকার সব ফল-ফসলে ব্যবহার করা হয়। গরুর খামারে কাজ করছেন ১০ জন কর্মচারী। গরুকে খাওয়ানো হয় দানাদার খাবার আর খামারেই উৎপাদিত ঘাস। মাঠে উৎপাদিত ঘাস তো আছেই। হারুন অর রশীদ জানালেন, ‘হৃদয়ে মাটি ও মানুষ’ অনুষ্ঠানে দেখানো হাইড্রোপনিক ঘাস উৎপাদন দেখে নিজেই আবিষ্কার করে নিয়েছেন নিজস্ব এক পদ্ধতি। সেই পদ্ধতিতেই উৎপাদন করছেন ঘাস।

এখন শীত বলে খামারের সব পুকুরে পানি নেই। যেখানে পানি নেই সেসব পুকুরও ফেলে রাখা হয়নি। সেখানে মাচা করে চাষ করা হচ্ছে লাউ। মাচার নিচে রোপণ করা হয়েছে কচু। এ ছাড়া শিম, কুমড়াসহ অন্যান্য সবজি তো রয়েছেই। সব মিলিয়ে মিশ্র ফসল, সাথী ফসল বা সমন্বিত চাষের এমন উত্কৃষ্ট উদাহরণ সত্যিই বিরল। আর সব চাষই হচ্ছে জৈবিক পদ্ধতিতে।

সারা বাগানে দেশি-বিদেশি ফুল-ফলের গাছ। কোনো ফলই কিনে খেতে হয় না। সমন্বিত খামারের বড় অংশ ব্যবহার হচ্ছে মাছ চাষে। রুই-কাতলা থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের মাছ চাষ করা হয়। এসব মাছের খাবারের ব্যাপারে শতভাগ সতর্ক থাকেন তিনি। এতে মাছের আকার যেমন ভালো হচ্ছে, স্বাদও হচ্ছে তুলনামূলক বেশি। ছোট-বড় পাঁচটি পুকুরের ২১ বিঘা জলায়তনে বছরে ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকা আয় আসে।

মজার ব্যাপার হলো এই বিভিন্ন উৎপাদিত ফল-ফসল ও মাছ বা গাভীর দুধ সবই নিজের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি বাকি অংশ চলে যায় তার উদ্যোক্তার গার্মেন্টে নিযুক্ত দেড় হাজার শ্রমিকের কাছে। বাজার থেকে অপেক্ষাকৃত কম দামে এবং বিষমুক্ত ও ফ্রেশ খাবার হিসেবে মাসিক চুক্তিতে তিনি শ্রমিকদের মাঝে বিক্রি করে থাকেন। ফলে তার চাষাবাদের বাজারটিও সুনিশ্চিত।

হারুন অর রশীদ জানালেন, এত সুদীর্ঘ আয়োজন, এমন শখ শৌখিনতা আর উৎপাদনশীল উদ্যোগের পেছনে রয়েছে টেলিভিশন। টেলিভিশনে দেখে দেখে তিনি পদক্ষেপ নেন নতুন নতুন চাষবাসের। হারুন অর রশীদ অন্য শিল্পপতিদেরও আহ্বান জানান এ ধরনের সমন্বিত কৃষি উদ্যোগে যুক্ত হতে। তিনি বলেন, প্রতিটি শিল্পেই ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে। তবে কৃষিতে তুলনামূলক কম। ক্ষতি নেই, আছে লাভের অঙ্ক। সবচেয়ে যে লাভ, তা হচ্ছে মনের তৃপ্তি। তাজা খাবার পাওয়ার সুখ।

উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির সুযোগ সবখানেই আছে। সবাই পারেন স্ব স্ব অঙ্গনে উৎপাদনমুখী হয়ে উঠতে। হারুন অর রশীদের মতো গার্মেন্ট শিল্প উদ্যোক্তা এ দেশে বহু রয়েছেন, কিন্তু এই বহুমুখী কর্মতৎপরতা ও উৎপাদন সাফল্য রয়েছে খুব কম মানুষের। কৃষির প্রতি ভালোবাসা তার মানসিক প্রশান্তিকে প্রতিনিয়ত বাড়িয়ে দিচ্ছে। কারণ প্রকৃতির এ দান সবসময় তাকে করছে কৃতজ্ঞ। আমি বিশ্বাস করি, হারুন অর রশীদের দেখাদেখি অন্য শিল্পোদ্যোক্তারাও যে কোনো শিল্প-বাণিজ্যের পাশাপাশি একটু জায়গা রেখে দেবেন কৃষির জন্য। যেখানে ফলবে তরতাজা ফল-ফসল। এ ফল-ফসলই বাণিজ্যিক সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে রাখবে গুরুত্বপূর্ণ অবদান।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।

[email protected]

 

সর্বশেষ খবর