শনিবার, ৩০ ডিসেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

এইডস কেন ভয়ঙ্কর

আফতাব চৌধুরী

এইডস কেন ভয়ঙ্কর

রোগের নাম ‘এইডস’। পুরো কথা ‘অ্যাকোয়ার্ড ইমিউনো ডেফিশিয়েন্সি সিনড্রোম’। এ ব্যাধির জীবাণুর নাম এইচআইভি। গত শতাব্দীর শেষ অঙ্কে এর আবির্ভাব। ১৯৮১ সালে চিকিৎসা-বিজ্ঞানীদের সঙ্গে এর প্রথম পরিচয়। এ রোগের বিভীষিকাময় রুদ্রমূর্তিতে বিশ্ব আতঙ্কিত। দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে এর আক্রমণ। এই ভয়ঙ্কর ব্যাধির প্রথম প্রকাশ দক্ষিণ আফ্রিকায়। সারা দুনিয়ায় যত সংক্রামক ব্যাধি আছে তার মধ্যে এ রোগ সব থেকে বেশি মানুষের জীবনকে কেড়ে নিয়েছে। যে কোনো রোগের কারণে যত মানুষের মৃত্যু ঘটেছে, তার মধ্যে সংখ্যার বিচারে এ রোগে আক্রান্ত মৃত মানুষের সংখ্যা চতুর্থ। গবেষকদের মতানুসারে মানুষ মারা জীবাণু আবিষ্কারের সময় অসতর্ক মুহূর্তে পরীক্ষাগারে এই রোগজীবাণুর জন্ম ও বিস্তার। মানবদেহে যে কোনো রোগের জীবাণু প্রবেশ করলে তাকে বাধা দেওয়া এবং অসম্ভব হলে তাকে চিহ্নিত করে দেওয়ার জন্য এক প্রকার প্রতিরোধের ব্যবস্থা আছে। প্রাকৃতিক নিয়মে মানুষের শরীরকে রোগমুক্ত রাখার জৈবিক ব্যবস্থা আছে। প্রতিরোধ করার ক্ষেত্রে সব থেকে কার্যকর কোষকে বলা হয় ‘টি সেলস’। কেউ কেউ তাকে বলেন, রক্তের শ্বেতকণিকা।

এইডস রোগের জীবাণু মানবদেহে প্রবেশ করার পর প্রথমেই আক্রমণ করে এই প্রতিরোধকারী কোষ টি সেলসকে। এ যেন নৃশংস সাম্রাজ্যবাদী শক্তির অতর্কিত আক্রমণ। এইডস জীবাণু প্রথমেই দেহের প্রতিরোধব্যবস্থাকে ভেঙে চুরমার করে দিয়ে সারা দেহে তার আক্রমণকে ছড়িয়ে দেয়। এইডস জীবাণু এইচআইভি শুধু টি সেলসকে আক্রমণ করেই ক্ষান্ত থাকে না। মগজের কোষসহ দেহের অন্যান্য কোষকে অকেজো করে দেয়। এক কথায় মানবদেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গে যত প্রকার প্রতিরোধের ব্যবস্থা আছে তার সব কটিকে ধ্বংস করে দেয়। কোনো কোনো গবেষকের মতে, এইচআইভির অস্তিত্ব বহু আগেও ছিল। কিন্তু তার ধ্বংস করার ক্ষমতা ছিল খুবই দুর্বল। পরবর্তী যুগে বিভিন্ন কারণে এইচআইভির ধ্বংসাত্মক ক্ষমতা বহুগুণে বেড়ে গেছে। আজ এই রোগজীবাণু এক ভয়াবহ ত্রাস হিসেবে হাজির হয়েছে। মানবসমাজের সব থেকে সৃজনশীল অংশ ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়স। এ রোগের আক্রমণ হচ্ছে সমাজের ওই অংশের মানুষের ওপর সব থেকে বেশি। বলা যায় সমাজকে পঙ্গু করে দেওয়ার প্রশ্নে এ রোগের কোনো জুড়ি নেই। নিচের চিত্র থেকে বিশ্বে এ রোগের ভয়াবহতা কিছু অনুমান করা যাবে।। এ রোগে আক্রান্ত রোগীর দেহে নানা প্রকার লক্ষণ দেখা দেয়। অবিরাম জ্বর, অত্যন্ত ক্লান্ত বা দুর্বল হয়ে যাওয়া, পাতলা পায়খানা হওয়া, দেহের ওজন অস্বাভাবিকভাবে কমে যাওয়া ইত্যাদি।

৯০ শতাংশ ক্ষেত্রে এ রোগ সংক্রামিত হয় যৌন সম্পর্কের মধ্য দিয়ে। চিকিৎসার জন্য দেহে প্রয়োজনে যে রক্ত সঞ্চালন করা হয়, সে রক্তে এর জীবাণু থাকার ফলে এ রোগে অনেকে আক্রান্ত হয়। ইনজেকশনের সুচ পরিশুদ্ধ না থাকার ফলে এ রোগ সংক্রামিত হয়। আক্রান্ত রোগীর রক্ত অথবা দেহনিঃসৃত লালা এ জীবাণু বহন করে। অন্য কোনোভাবে নয়। এ রোগ নিরাময়ের জন্য এখনো পর্যন্ত কোনো কার্যকর চিকিৎসা পদ্ধতির আবিষ্কার হয়নি। বিভিন্ন প্রকার কেমোথেরাপির সাহায্যে রোগীকে বেশি দিন বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করা হয় মাত্র। রোগীর দেহের এইচআইভিকে যতদূর সম্ভব সংযত করে রাখার চেষ্টা করা হয় মাত্র, তাকে নির্মূল করার কোনো চিকিৎসা নেই। এ চিকিৎসাও অত্যন্ত ব্যয়বহুল। ফলে এ রোগের জীবাণু আর যাতে সংক্রামিত না হয়, সেদিকে বিশেষ সতর্ক দৃষ্টি দেওয়া ছাড়া আর কোনো পথ নেই।

এ রোগকে প্রতিরোধ করার জন্য প্রতিবিম্বিত হয়েছে জাতীয় এইডস নিয়ন্ত্রক সংস্থা ন্যাশনাল এইডস কনটেত্থাল অর্গানাইজেশন সংক্ষেপে (এনএসিও)। সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাসমূহ যৌথভাবে এ মারাত্মক রোগের প্রতিকারের জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে চলেছে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গে সম্মিলিত উদ্যোগের ফলে এদের যত অংশকে এইডস নিয়ন্ত্রক ব্যবস্থার মাধ্যমে এই সময়ের মধ্যে আনা সম্ভব হয়েছে, অন্য কোনোখানে তা হয়নি। বাকি অংশ এই নিয়ন্ত্রক ব্যবস্থার মধ্যে আনার জন্য সার্বিক প্রয়াস চলছে। পরিবহনশিল্পের সঙ্গে যুক্ত কর্মীদের মধ্যে এক উল্লেখযোগ্য অংশ এইডস দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে বা হয়। এইডস নিয়ন্ত্রক ব্যবস্থার মধ্যে এদের আনার ক্ষেত্রে এ রাজ্য দেশের মধ্যে সাফল্যের দ্বিতীয় স্থানে আছে। রাজ্যের স্বাস্থ্য বিভাগ বিশেষ কেন্দ্র খুলে দেশের নিষ্ঠাবান স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সাহায্য নিয়ে এইডসের বিরুদ্ধে সার্বিক অভিযান চালাচ্ছে।

রক্ত সঞ্চালনের সময় এইচআইভি যুক্ত সুচ বা রক্ত যাতে ব্যবহার করা না হয় তার জন্য কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। স্বেচ্ছায় দেওয়া রক্ত ছাড়া অন্য কোনো রক্ত সঞ্চালন নিষেধ করা হয়েছে। এর ফলে পেশাদারদের দেওয়ার রক্ত ব্যবহার আইনত প্রায় নিষিদ্ধ হয়েছে। এ রোগের কারণ ও সংক্রামিত হওয়ার পদ্ধতি সম্পর্কে জন-চেতনা সৃষ্টি, সংযমী জীবনযাপন করার গুরুত্ব বোঝানোর জন্য সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগকে শক্তিশালী করা হয়েছে। এ রোগের ভয়াবহতা বিপজ্জনক। এর নিরাময়ের জন্য বস্তুত কোনো চিকিৎসা নেই। এর দ্বারা অধিক মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে। সেজন্য সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ কাজ জনচেতনা সৃষ্টি করা।

লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট।

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর