রবিবার, ৭ জানুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

সুবিধাবাদী লীগের দেনা শোধের সময় ২০১৮

নঈম নিজাম

সুবিধাবাদী লীগের দেনা শোধের সময় ২০১৮

আওয়ামী লীগ থেকে গত নয় বছর অনেকে উজাড় করে পেয়েছেন, নিয়েছেন। এই বছরকে ঘিরেও অনেকের অনেক প্রত্যাশা। খুব ভালো। কোনোটাই খারাপ নয়। তবে শুধু নিলে হবে না, ফেরতও দিতে হবে। ২০১৮ সাল হচ্ছে প্রাপ্তির বিপরীতে আওয়ামী লীগারদের ফেরত দেওয়ার সময়। অনেক কিছু নিয়ে আপনারা দেনাদার। তাই এই বছর হোক দেনা শোধের বছর। কীভাবে শোধ করবেন তা নিয়েও গবেষণার কিছু নেই। যারা গোচরে-অগোচরে নিয়েছেন তাদেরও সমস্যা নেই। চিন্তারও কিছু নেই। শোধ করা খুবই সহজ। ভোটের বছরেই হতে পারে সব দেনা-পাওনার শোধ। কারণ কোনো সম্পর্কই একতরফা নয়। আর নেওয়ার বিষয়গুলোও একরকম নয়। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর অনেকে দেশে-বিদেশে নিয়োগ পেয়ে সামাজিক, আর্থিক মর্যাদা বাড়িয়েছেন। তারা এখন নেই ক্ষমতার পাশে। কিন্তু তাদেরও কাজ করতে হবে। আমি কিছু বিষয়ে ব্যুরোক্রেটদের কথা বলছি না। তারা একটা প্রক্রিয়ার মধ্যেই নিয়োগ-পদোন্নতি পান। যদিও এখানেও অনেক সুবিধাভোগী রয়েছেন প্রশ্নবিদ্ধ অবস্থানে। যার যা পাওয়ার কথা নয়, তা পেয়েছেন। যোগ্যতার মাপকাঠি দেখা হয়নি। তবুও এবারের লেখা তাদের নিয়ে নয়। এই লেখা রাজনৈতিকভাবে, ব্যবসা, বাণিজ্য, নিয়োগ ও সুযোগ-সুবিধাপ্রাপ্তদের নিয়ে।

আসলে কোনো কিছু নিয়েই প্রশ্ন তুলতাম না। কিন্তু কিছু বিষয়ে মনে হচ্ছে, সুর-তাল-লয় ক্ষয়ে যাচ্ছে বলে মনে হলো। অনেক সুবিধাভোগীর চেহারার বদলও দেখছি। কিছু কিছু বিষয় চোখে পড়েছে যা শালীন নয়। অনেক সুবিধাভোগী ভোল পাল্টাতে শুরু করেছেন। অনেকে বিএনপির সঙ্গে সম্পর্ক গড়ছেন। কেউ হয়তো বিদেশে রাষ্ট্রদূত ছিলেন রাজনৈতিক কোটায়, এখন তাকে দেখা যায় ভিন্ন চিন্তার মানুষদের সঙ্গে। আবার কেউ হয়তো অন্য পদে ছিলেন তিনিও নতুন চাওয়া-পাওয়ার হিসাব করছেন। আবার দেশেও একদল ছিলেন যারা সুবিধা নিয়েছেন, এখন কেটে পড়ার চিন্তায় আছেন। এই মানুষদের সম্পর্কে সাবধান হতে হবে। আরে ভাই, দলের নাম ভাঙিয়ে অনেক কিছু করেছেন, এখন কেটে পড়ছেন কেন? এ কেমন কথা ভাই এখনো আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়। এই বছর পুরো আছে। আগামীতে আসার সম্ভাবনা অনেক বেশি। তার পরও সুবিধা নিয়ে কেটে পড়লে কেমনে হবে? ভুলে গেলে কী হবে— দেনা-পাওনার একটা হিসাব থাকে। লাজ-লজ্জা বলেও একটা কথা আছে। রবীন্দ্রনাথের ব্যক্ত প্রেমের দুটি লাইন মনে পড়ছে— ‘কেন তবে কেড়ে নিলে লাজ-আবরণ। হৃদয়ের দ্বার হেনে বাহিরে আনিলে টেনে, শেষে কি পথের মাঝে করিবে বর্জন?’

কোনো বর্জন নয় আগামীতে। অর্জনকে নিয়েই থাকতে হবে উপকারীর সঙ্গে। ইসলামের বিধান হচ্ছে, কারও কাছ থেকে ঋণ নিলে শোধ করতে হয়। আওয়ামী লীগ-প্রধান আপনাদের জন্য অনেক করেছেন। দয়া করে এবার আপনারা করুন। যে সাংবাদিকরা দেশ-বিদেশে, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে নিয়োগ পেয়েছিলেন, বিদেশে সফরসঙ্গী হয়েছিলেন তাদেরও উজাড় করে কাজ করতে হবে। যিনি ব্যাংক-বীমা, জাহাজ, পাওয়ার প্লান্ট, বিশ্ববিদ্যালয়সহ হাজার ধরনের ব্যবসা নিলেন, ঠিকাদারির নামে উজাড় করে আয় করলেন, নয় বছরে শত থেকে হাজার-কোটির মালিক হলেন— এই বছর আপনাদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশের বছর। এখন যারা মন্ত্রী-এমপি আছেন তারা তো দুই হাতে খরচ করবেন দলের জন্য, কর্মীদের জন্য, এটাই স্বাভাবিক। এর বাইরে ২০০৮ সালের এমপি, মন্ত্রী, ব্যাংকের পরিচালক, এখন নেই; তাদের অতীত ভুলে গেলে হবে না। মন্ত্রিত্ব হারিয়েছেন অথবা এখন এমপি নেই, তাতে কী? ভুলে গেলে হবে না, প্রথম পাঁচ বছরে আপনার এই অবস্থানটুকু শেখ হাসিনারই দেওয়া। তাই এখন জীবন বাজি রেখে দলের জন্য দৃশ্যমান কাজ করবেন— এটাই আপনাদের কাছে সবার প্রত্যাশা। এ নিয়ে কাজী নজরুল ইসলামের কবিতার একটি লাইন মনে পড়ছে। কবি লিখেছেন, ‘দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে দেনা শুধিতে হইবে ঋণ!’ আমিও তাই মনে করি। কারণ দেনা শোধ না করলে স্বয়ং আল্লাহ রব্বুল আলামিনও বেজার হন। সূরা আল-বাকারায় বলা হয়েছে : ‘হে বিশ্বাসীগণ! যখন তোমরা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ধার-কারবার করবে তখন তা লিখে রাখবে।’ আর বুখারি শরিফে আছে, ‘মানুষ ঋণী হলে, যখন কথা বলবে, মিথ্যা বলবে, অঙ্গীকার করলে অঙ্গীকার ভঙ্গ করবে।’ এ কারণে আমাদের নবীজি (সা.) আল্লাহর কাছে সবসময় প্রার্থনা করতেন, অলসতা, গুনাহ ও ঋণ থেকে আল্লাহ রব্বুল আলামিন যেন তাঁকে এবং তাঁর উম্মতদের দূরে রাখেন। নবীজির উম্মত হিসেবে সবাইকে সবকিছু মনে রাখতে হবে।

২০১৮ সাল হচ্ছে আওয়ামী লীগের জন্য চ্যালেঞ্জের বছর। একটির পর একটি ভোট হবে। ভোট মোকাবিলা করেই আওয়ামী লীগকে নতুন করে ক্ষমতায় আসতে হবে। ভিশন টোয়েন্টি টোয়েন্টি ওয়ান বাস্তবায়নে ক্ষমতায় আসার বিকল্পও নেই। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের চোখে এই সাল অনেক চ্যালেঞ্জের। আর এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা সম্ভব শুধু সুবিধাভোগীদের দলের প্রতি ভালোবাসা ও আনুগত্য দেখানোর মধ্য দিয়ে। এর মধ্যে ২০০৯ সাল থেকে অনেক নতুন সুবিধাভোগী দেখছি। যারা অতীতে নানামুখী ব্যস্ততা অথবা অন্য দলে থাকার কারণে আওয়ামী লীগের জন্য কাজ করতে পারেননি। আজকাল তাদের টকশোয় দেখি। স্বঘোষিতভাবে আওয়ামী লীগের নেতা সাজা মানুষগুলো, অতীতে, বর্তমানে দলে দুই টাকার কর্মীও ছিলেন না। এখন নিজেদের নতুন আওয়ামী লীগ নেতা ও নীতিনির্ধারক হিসেবে পরিচয় দেন। টিভি পর্দায় তাদের রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানেও দেখি। এদের কেউ কেউ হাওয়া ভবনে ঘোরাফেরা করতেন। এখন সবাই আওয়ামী লীগ! ভালো। খুবই ভালো। অতি আনন্দের বিষয়। এই মানুষগুলো দলের জন্য আগামীতে পরিকল্পিতভাবে কাজ করবেন বলেই বিশ্বাস করি।

এত কিছু বলার কারণ বিশ্বাস ও আস্থা নিয়েই আমরা বেঁচে থাকি। এমনিতে মানুষের স্বাভাবিক অনুভূতিগুলো ভোঁতা হয়ে যাচ্ছে। এখন কোনো কিছুই কাউকে স্পর্শ করে না। সময়টা কেমন যেন! অনেক সময় সবকিছু বোঝা মুশকিল। মাটি ও মানুষ আমাকে টানে। মাঝে মাঝে গ্রামে যাই। আমার উপজেলায়ও দেখছি অনেক বিএনপি, জামায়াত নেতা এখন কঠিন আওয়ামী লীগ নেতা। এসব নেতাই সর্বনাশ বেশি করছেন। বিএনপি ক্ষমতায় থাকার সময় এরা আওয়ামী লীগের ওপর বেশি নির্যাতনই করেছেন। কিছুদিন আগে এক অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগ, বিএনপির দুই শীর্ষ নেতা। এর মধ্যে একজন বললেন, ভাই, এলাকায় গেলেই সমস্যা করে আওয়ামী লীগের ছেলেগুলো। তখন আওয়ামী লীগ নেতা বললেন, আমি আপনাদের আমলে আপনার এলাকায় গিয়েছিলাম। ভুলে গেছেন কীভাবে আমার ওপর হামলা হয়েছিল! জবাবে সেই বিএনপি নেতা বললেন, আমার সময়ে যারা হামলা করেছিল তারাই এখন আওয়ামী লীগে। ওরাই এখন জ্বালাচ্ছে আমাকে। দুই নেতার কথোপকথনই বাস্তবতা। অতীত ভুলে গেলে হবে না। অতীতে অনেক কিছু দেখেছি। আর দেখেছি বলেই প্রশ্ন তৈরি হয় সময়মতো সুবিধাভোগীরা সবাই থাকবে তো?

আশা নিয়েই থাকতে হয়। এবারও আশাবাদী আওয়ামী লীগ গত ৯-১০ বছরে সুবিধাভোগী ও নবাগত আওয়ামী লীগারদের নিয়ে। যারা বড় মাপের ব্যবসা নিয়েছেন, আগামী সিটি করপোরেশন ও জাতীয় নির্বাচনে তারা অবশ্যই উজাড় করে দুই হাতে খরচ করবেন। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া দলের প্রার্থীদের পক্ষে ঝাঁপিয়ে পড়বেন। টাকা-পয়সা খরচ করবেন। পেছনে ফিরে তাকাবেন না। বিদেশে টাকা পাঠিয়ে দেবেন না। খাতে-খাতে, ঘাটে-ঘাটে কারা ব্যবসা করেছেন, নতুন করে কারা শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন, তাদের তালিকা প্রধানমন্ত্রীর কাছে নিশ্চয়ই আছে। আমাদের মিডিয়া কর্মীদের কাছেও আছে। আপনাদের বিশাল বিশাল সাফল্য আমরা বিস্ময় নিয়ে দেখেছি। এখনো দেখছি। তাই আপনাদের জন্য আমার শুভ কামনা। আগামী সব নির্বাচনে দলের জন্য, কর্মীদের জন্য আপনাদের বিশাল দানেই জেগে উঠবে সবকিছু নতুনভাবে। আবারও বলছি ও বিশ্বাস করি, কেউ নির্বাচনের সময় বিদেশে যাবেন না। এ বছর পুরোটাই সবাই দেশে কাটাবেন। বিশেষ করে সিটি করপোরেশনের ভোট ও অক্টোবরের পর কেউ ব্যবসা-বাণিজ্য অথবা অন্য কারণ দেখিয়ে দেশ ছাড়বেন না। কাজ করবেন দলের জন্য, আগামীতে ক্ষমতার জন্য। আর দুই মাস পর থেকেই সবার ইমানের পরীক্ষা শুরু। প্রাথমিক পরীক্ষা ঢাকা উত্তর সিটি নির্বাচন দিয়ে। এরপর গাজীপুর, বরিশাল, সিলেট, রাজশাহী ও খুলনায়। কেউ চেহারা বদল করবেন না বলেই প্রত্যাশা রাখছি।

মানুষকে সম্মান না দিলে আপনিও সম্মান পাবেন না। জীবনের কোনো সম্পর্কই একতরফা নয়। জীবনের পরতে পরতে জটিলতা সামনে রেখে আমরা চলি। মানুষকে মূল্যায়ন করতে হবে। কোনো অহমিকা-দাম্ভিকতার পরিণতি ভালো হয় না। আপনার কাছে যা সহজ তা আরেকজনের কাছে অনেক জটিল। বলছি না এক জীবনে সব হিসাব-নিকাশ মিলে যাবে। আজকাল মানুষের পরিবর্তন দেখেও মন খারাপ করি না। দুনিয়ায় মানুষকে বোঝার মতো কষ্টকর আর কিছু নেই। সত্যকে আড়াল করার সুযোগ নেই। মনে একবার আগুন লাগলে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। সেদিন কথা হচ্ছিল আওয়ামী লীগের এক কেন্দ্রীয় নেতার সঙ্গে। বললেন, ভাই অমুক কে? আমি বললাম, আপনার দলের ভবিষ্যৎ নীতিনির্ধারক। থতমত খেলেন ভদ্রলোক। এমন উত্তর আশা করেননি। ছাত্রলীগের এক সাবেক সাধারণ সম্পাদক বললেন, আমাদের দলের নতুন নতুন আবিষ্কারে নিজেরাই বিস্মিত হই। আমি বললাম, বিস্ময়ের কিছু নেই। বাস্তবতাকেই মানতে হবে।

মাঝে মাঝে মনে হয়, কী হবে? রাজনীতির সবচেয়ে বড় সর্বনাশ হয়েছে ওয়ান-ইলেভেনে। অনেক ভালো মানুষকে দালাল বানিয়ে রাজনীতি থেকে চিরবিদায় দিয়েছে। ওয়ান-ইলেভেনের অনেক কঠিন-জটিল অংশ ছিল বিদেশি কূটনীতিকদের তৈরি। এখন সবকিছু বের হচ্ছে। ওয়ান-ইলেভেন সরকারে শপথ অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগ অংশ নিয়েছিল। তারপর কী কারণে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের নামে আওয়ামী লীগের বিপক্ষে সেনা সমর্থকরা অবস্থান নিল, সেই রহস্যও হয়তো একদিন বের হবে। ইতিহাসকে কখনো লুকিয়ে রাখা যায় না। ক্ষমতার সময়, সুসময়ে দেখা হওয়া বন্ধুরা কখনো প্রকৃত সখা নয়। দুঃসময়ে তাদের কী ভূমিকা তাও দেখা দরকার। সেদিন এক বন্ধু বললেন, বিপদে পড়লে টের পাওয়া যায়, কারা পাশে দাঁড়ায়। বিপদ দেখলে অধিকাংশ মানুষ কেটে পড়ে। যাদের প্রতি আশা থাকে, তারাই সবার আগে সরে পড়ে। অনেক সময় দেখা যায়, যার কথা কল্পনায়ও নেই, তিনি এসে দাঁড়াচ্ছেন পাশে। ক্ষুদ্র এই জীবনে কম তো দেখা হলো না। বড় অদ্ভুত আমাদের সবকিছু!

 

লেখক : সম্পাদক , বাংলাদেশ প্রতিদিন।

সর্বশেষ খবর