সোমবার, ১৫ জানুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

আইএস এবং বৈশ্বিক জঙ্গিবাদ

মেজর জেনারেল একে মোহাম্মাদ আলী শিকদার পিএসসি (অব.)

আইএস এবং বৈশ্বিক জঙ্গিবাদ

বৈশ্বিক ইসলামিস্ট উগ্রবাদী জঙ্গিবাদের বীজ বহু আগে আঠারো শতকের মাঝামাঝিতে কট্টরপন্থি ধর্মবাদ ওয়াহাবিতন্ত্রের আবির্ভাবের মধ্যে নিহিত থাকলেও ২০১৪ সালে এসে ইরাক ও সিরিয়ার একটা বৃহৎ অঞ্চল দখল এবং ত্বরিতগতিতে তথাকথিত ইসলামী রাষ্ট্রের নামে (আইএস) খেলাফতের ঘোষণা সারা বিশ্বকে কাঁপিয়ে দেয়। বিশ্বের প্রায় সব প্রান্ত থেকে একশ্রেণির মুসলমান যুবক-যুবতী নেশাগ্রস্তের মতো আইএসের দিকে ধাবিত হয়।

তারা বাস্তবতাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে কীটপতঙ্গের মতো আগুনে ঝাঁপ দিতে থাকে।  অন্ধত্বের উন্মাদনায় তারা বুঝতে ব্যর্থ হয় সারা বিশ্বশক্তির বিপরীতে গিয়ে শুধু বর্বরতার শক্তির দ্বারা আধুনিক বিশ্বে নির্দিষ্ট ভূখণ্ড দখল ও রাজত্ব কায়েম করা যায় না। এ সত্য কথাটি এখন প্রমাণিত হয়েছে। মাঝখানে মধ্যপ্রাচ্যের শক্তিশালী মুসলিম রাষ্ট্রগুলো ধ্বংস হয়ে গেছে। পরম শান্তির ধর্ম ইসলামের প্রতি বিশ্বব্যাপী অন্য ধর্মাবলম্বীদের বিদ্বেষ বেড়েছে। ইউরোপ-আমেরিকায় মুসলমান পরিচয়ধারী মানুষ ঘৃণা, বিদ্বেষ ও চরম হয়রানির শিকার হচ্ছে। সাড়ে তিন বছরের মাথায় এসে সেই আইএস এখন ইরাক ও সিরিয়া থেকে সম্পূর্ণভাবে উত্খাত হয়েছে। তাদের ভূখণ্ডগত কর্তৃত্ব শেষ, আর নেই। তার মানে এই নয় যে, আইএসের কবল বা থাবা থেকে বিশ্ব সম্পূর্ণ মুক্ত হয়ে গেল। তবে অবশ্যই তাদের শক্তি বহুলাংশে খর্ব হয়ে গেল। অর্থবল, অস্ত্রের বল আগের মতো রইল না। ইরাকে দখলকৃত জ্বালানি তেল চোরাইপথে বিক্রি করে আইএস প্রচুর অর্থ আয় করত। এটি এখন সম্পূর্ণ হাতছাড়া। নির্দিষ্ট ভূখণ্ড নিয়ে রাষ্ট্র থাকায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে উদ্বুদ্ধ তরুণ-তরুণীরা পালিয়ে এসে একটা ঠিকানায় পৌঁছাতে পারত, যা এখন বিলুপ্ত। নির্দিষ্ট ভূখণ্ড থাকায় চোরাইপথে অস্ত্র সংগ্রহ ও তা সংরক্ষণ করা যতটা সহজ হতো সেটিও এখন আর পারবে না। সিরিয়ায় আইএসের ভূখণ্ড দখল ও বিস্তারের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। তবে ইরাকে তারা যেভাবে রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে পিছু হটিয়ে ত্বরিতগতিতে জায়গা দখল করেছে তা ছিল রীতিমতো বিস্ময়কর। সামাজিক বিশ্লেষণে এর সঠিক কারণ উদ্ঘাটন করা কঠিন। তবে এর জন্য অবশ্যই ২০০৩ সালে সাদ্দাম হোসেনকে উত্খাতের পর সক্ষমতা গ্রহণকারী আমেরিকার দখলদার বাহিনী ও তাদের প্রতিভূ স্থানীয় নতুন সরকারের ভ্রান্ত নীতিই দায়ী। তারা সাদ্দাম হোসেনের সেনাবাহিনীকে সম্পূর্ণ ভেঙে দিলে চাকরিচ্যুত হাজার হাজার প্রশিক্ষিত সশস্ত্র বাহিনীর অফিসার ও জওয়ান ক্ষুব্ধ হয়ে আইএস বাহিনীতে যোগ দেয়। এখন আইএস পরাজিত হওয়ার পর সাদ্দাম হোসেনের সেনাবাহিনী থেকে আগত অংশ সঙ্গত কারণেই ইরাকে তাদের নিজ আবাসভূমিতে নিজ জনগণের সঙ্গে আপাতত মিশে যাবে এবং ভবিষ্যতে সুযোগের অপেক্ষায় থাকবে। তবে আইএসমন্ত্রে উদ্বুদ্ধ অংশ চোরাগোপ্তা ও আত্মঘাতী আক্রমণ চালিয়ে ইরাককে অস্থির করে রাখবে। ইতিমধ্যেই এ রকম তৎপরতা শুরু হয়ে গেছে। তাই বলা যায়, আইএসের পতন হলেও ইরাক আইএসমুক্ত নয়। সিরিয়ায় যুদ্ধরত আইএস যোদ্ধাদের বেশির ভাগ ছিল বিদেশি, অর্থাৎ ইউরোপ, আমেরিকা, এশিয়া ও আফ্রিকার দেশসমূহ থেকে আগত। সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের রাষ্ট্রীয় বাহিনীর কাছে আইএস বাহিনী সুবিধা করতে পারত না, যদি আমেরিকা ও সৌদি আরব আসাদকে ক্ষমতা থেকে উত্খাতের জন্য নির্বিচারে আইএসসহ বিদ্রোহী বাহিনীগুলোকে অস্ত্র, অর্থ এবং প্রশিক্ষণ সহায়তা না দিত। এ কারণেই সৌদি আরব, আমেরিকা ও ইউরোপের সমন্বিত বিমান অভিযানেও সিরিয়ার আইএসকে কাবু করা কঠিন হয়ে পড়ে। তবে ২০১৫ সালের শেষদিকে রাশিয়া প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের পক্ষে এবং আইএসের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক বিমান অভিযান শুরু করলে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ পাল্টে যায়। শুধু বিমান অভিযান নয়, রাশিয়ার স্থলবাহিনীও অপারেশনে অংশ নেয়। তার সঙ্গে লেবাননের হিজবুল্লাহ মিলিশিয়া বাহিনীর যোগদান এবং তাতে ইরানের সমর্থনে ২০১৭ সালে এসে আইএস বাহিনী সম্পূর্ণ কোণঠাসা হয়ে পড়ে। ফলে ২০১৭ শেষ হওয়ার আগেই তথাকথিত খেলাফতের রাজধানী রাক্কা থেকে আইএস উত্খাত হয়ে যায়। যেভাবে উত্থান সেভাবেই পতন।

এখন নতুন আশঙ্কা হচ্ছে সিরিয়া থেকে উত্খাত এবং এখনো জীবিত, এমন যে কয়েক হাজার আইএস যোদ্ধা রয়েছে তারা আগামীতে কোথায় যাবে এবং তাদের কর্মকাণ্ড কী হবে। যুক্তরাষ্ট্রের জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের সন্ত্রাসবাদ বিশেষজ্ঞ ব্রুস ইফম্যান জানিয়েছেন, হাজারও আইএস যোদ্ধা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সটকে পড়েছে। তাদের মধ্যে অনেকে এখন বলকান অঞ্চলে অবস্থান করছে। সুযোগ খুঁজছে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ঢোকার জন্য। তাছাড়া ফিলিপাইনের দক্ষিণাঞ্চল, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, তুরস্ক এবং উত্তর আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে স্থানীয় জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে যোগ দেওয়ার খবরও বিশ্ব মিডিয়ায় আসছে। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত যারা আইএস বাহিনীতে যোগ দিয়েছিল তাদের সম্পর্কে সঠিক কোনো তথ্য জানা যাচ্ছে না। এটা আমাদের জন্য শঙ্কার কারণ হয়ে থাকছে। সবাই জানেন, আল-কায়েদা ও আইএসের মধ্যে আদর্শগত কোনো পার্থক্য নেই। কৌশলে একমত হতে না পারায় আল-কায়েদার একাংশ বিচ্ছিন্ন হয়ে আইএস সৃষ্টি করেছে। নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে তাড়াহুড়া করে খেলাফত ঘোষণা আল-কায়েদা সমর্থন করেনি। আয়মন আল জাওয়াহিরির লিখিত বই অনুসারে আল-কায়েদার কৌশল হলো, প্রথমে মধ্যপ্রাচ্যের রাজতন্ত্র ও একনায়কতন্ত্রকামী শাসকদের প্রতি আমেরিকাসহ পশ্চিমা বিশ্বের সমর্থন প্রত্যাহার করে নিলে এবং সামরিক ঘাঁটি সরিয়ে নিলে তখন আল-কায়েদার সৈন্যরা সহজেই আরব শাসকদের উত্খাত করে নিজেদের মতাদর্শের খেলাফত প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হবে। আমেরিকাসহ পশ্চিমা বিশ্বের সমর্থন বর্তমানের মতো তাদের প্রতি অক্ষুণ্ন থাকা পর্যন্ত এটা সম্ভব হবে না।

তাই আল-কায়েদা মনে করে আমেরিকা ও ইউরোপের নিজস্ব ভূখণ্ডে এবং বিশ্বব্যাপী তাদের স্বার্থের ওপর শক্তিশালী এবং অনবরত আঘাত হানতে পারলেই কেবল পশ্চিমা বিশ্ব মধ্যপ্রাচ্য থেকে হাত গুটিয়ে নিতে বাধ্য হবে। সুতরাং বেশির ভাগ বিশ্লেষক মনে করছেন, স্বতন্ত্র কৌশল নিয়ে ধাক্কা খাওয়ার পর আইএস আবার আল-কায়েদার ভিতরে একাত্ম হয়ে যেতে পারে। অথবা নতুন কোনো দেশের অভ্যন্তরে কিছু ভূখণ্ড দখল করে আবার নতুন খেলাফত ঘোষণার চেষ্টা করতে পারে। এক্ষেত্রে এ সময়ে তাদের পছন্দের জায়গা হতে পারে সোমালিয়া অথবা আফগানিস্তান। কারণ, এ দুটি রাষ্ট্রই এখন অত্যন্ত দুর্বল ও ভঙ্গুর অবস্থায় আছে এবং সেখানে ইতিমধ্যেই আইএস বেশ খানিকটা অবস্থান সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে।

সোমালিয়ার জঙ্গি সংগঠন আল-শাবাব বাহিনী অনেক আগেই আইএসের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করেছে। সোমালিয়ার পশ্চিমে উত্তর আফ্রিকার প্রায় একডজন দেশ এখন আইএসের প্রতি সহানুভূতিশীল ও সমর্থক জঙ্গি সংগঠনের তৎপরতায় অস্থিতিশীল হয়ে আছে। যেমন ইথিওপিয়া, সুদান, চাঁদ, নাইজার, মালি, নাইজেরিয়া, লিবিয়া ও মিসর। তাছাড়া সোমালিয়ার জঙ্গিগোষ্ঠী প্রায়শই কেনিয়া ও তানজানিয়াতেও আক্রমণ চালাচ্ছে। সোমালিয়া ও আফগানিস্তানে আইএস নতুন খেলাফত ঘোষণার চেষ্টা করতে পারে, তবে ইরাক ও সিরিয়ার মতো সুবিধা এখানে করতে পারবে না। কারণ আফগানিস্তানে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে আমেরিকা তার সেনাসংখ্যা বৃদ্ধি করছে এবং উত্তর আফ্রিকায় ফ্রান্সের বিশাল সেনা উপস্থিতি রয়েছে। একই সঙ্গে সেখানে আমেরিকার জঙ্গিবিরোধী বিমান অভিযান অব্যাহত আছে। তাই আইএস নতুন খেলাফত ঘোষণার চেষ্টা করলে তা কাজে আসবে না, মাঝখানে নিরীহ মানুষের জীবন যাবে এবং ক্ষণিকের জন্য আবার আইএস আগুন জ্বলে উঠবে। গত শতকের নব্বই দশকের শুরুতে সোমালিয়ার গৃহযুদ্ধকে কেন্দ্র করে আমেরিকার স্বার্থান্বেষী ভূরাজনীতির কারণে উদার বামপন্থি নেতা ফারাহ আইদিদ নিহত হন। তার ফলে যে শূন্যতার সৃষ্টি হয় সেই সুযোগে ওসামা বিন লাদেনের সরাসরি নির্দেশ ও তত্ত্বাবধানে সোমালিয়ায় সৃষ্টি হয় আল শাবাব জঙ্গিগোষ্ঠী। ১৯৯৮ সালের ৭ আগস্ট ওসামা বিন লাদেনের নির্দেশে আল-শাবাব বাহিনী কেনিয়া ও তানজানিয়ায় অবস্থিত আমেরিকান দূতাবাসের ওপর প্রচণ্ড বোমা বিস্ফোরণ ঘটায় এবং তাতে কয়েকশ আমেরিকান নাগরিক নিহত হয়। আল-শাবাব থেকে বোকো হারাম এবং তার শাখা-প্রশাখা এখন সমগ্র উত্তর আফ্রিকায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। একটু আগে যে কথা বলছিলাম, আইএস আল-কায়েদা একাত্ম হয়ে গেলে তাদের টার্গেটকৃত দেশের অভ্যন্তরে ওইসব দেশের নিজস্ব নাগরিকদের মধ্য থেকে জঙ্গিয়ানায় উদ্বুদ্ধ হওয়া ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের দ্বারা ছোট-বড় জঙ্গি আক্রমণের মাত্রা আগামীতে আরও বৃদ্ধি পেতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের অর্থায়নে পরিচালিত প্রভাবশালী নীতিনির্ধারণী গবেষণা প্রতিষ্ঠান র‌্যান্ড করপোরেশনের সাম্প্রতিক প্রকাশনা ‘দ্য অরিজিনস অব আমেরিকান জিহাদিস্টস (আমেরিকান জিহাদিদের উৎপত্তি)’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলেছে, আমেরিকান জিহাদিরা বাইরে থেকে আমদানি করা নয়, বরং তারা জিহাদি হয়ে উঠেছে আমেরিকান সমাজেই। ইউরোপের ফ্রান্স, জার্মানি, বেলজিয়াম, ইতালি ও যুক্তরাজ্যের বেলায়ও একই কথা প্রযোজ্য। ইরাক ও সিরিয়ায় আইএস উত্খাতে রাশিয়া সবচেয়ে সাফল্যজনক ভূমিকা রাখায় জঙ্গিগোষ্ঠী এখন রাশিয়ার অভ্যন্তরে আক্রমণের চেষ্টা করছে বলে খবর আসছে। রয়টার্স পরিবেশিত খবরে জানা যায়, ১৬ ডিসেম্বর আইএস রাশিয়ার দ্বিতীয় বড় শহর সেন্ট পিটার্সবাগে গির্জাসহ বিভিন্ন স্থাপনায় হামলার পরিকল্পনা করেছিল। কিন্তু এ সংক্রান্ত আগাম তথ্য সিআইএ জানার পর তা রুশ গোয়েন্দাদের জানিয়ে দেওয়ার ফলে সে আক্রমণ আইএস করতে পারেনি। সুতরাং সিরিয়া-ইরাক থেকে আইএস উত্খাত হয়েছে তার মানে এই নয় যে, জঙ্গি সন্ত্রাসীর কবল থেকে বিশ্ব মুক্ত হয়ে গেছে।  বরং তারা নতুন করে সংগঠিত হয়ে আল-কায়েদার মৌলিক কৌশলে ফিরে এসে তাদের টার্গেটকে ছায়ার মতো অনুসরণ করবে এবং অদৃশ্য ভূতের ভূমিকায় সারা বিশ্বকে  তটস্থ করে রাখার চেষ্টা করবে। ইতিমধ্যেই তার অনেক আলামত দেখা যাচ্ছে।

লেখক : কলামিস্ট ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক।

[email protected]

সর্বশেষ খবর