সোমবার, ১৫ জানুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

বর্তমান বেহাল হলে কি উন্নয়নের স্বপ্ন দেখা যায়?

তুষার কণা খোন্দকার

বর্তমান বেহাল হলে কি উন্নয়নের স্বপ্ন দেখা যায়?

ঢাকার রাস্তায় ভয়াবহ ট্রাফিক জ্যামে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে গিয়ে গাড়ির ড্রাইভার যখন অঘোরে ঘুমিয়ে পড়ে তখন আমি পত্রিকার পাতায় ডুবে থেকে রাস্তায় আটকে থাকার কষ্ট ভুলে থাকার চেষ্টা করি। পত্রিকা পড়ে মনে আরাম পাওয়ার চেষ্টা করি এটা বললে বুঝতে হবে আমি বোকার স্বর্গে বাস করছি। পত্রিকা পড়ে মন ভালো হওয়ার মতো কোনো খবর কি ওখানে ছাপা হয়? পত্রিকার পৃষ্ঠাগুলো হত্যা, ধর্ষণ, ব্যক্তিস্বার্থ হাসিলের লক্ষ্যে দলীয় এবং অন্তর্দলীয় কোন্দল, মাদক এবং দুর্নীতির খবরে ঠাসা।  সামান্য যেটুকু জায়গা বাকি থাকে সেটুকু সরকারি দলের নেতা-নেত্রীদের বয়ানে বর্তমান সরকারের উন্নয়নের আমলনামা এবং বিএনপি দলের নিন্দা কাহিনী দিয়ে ঠাসা। ক্ষমতাসীন দলের নেতা-নেত্রীদের বয়ানে উন্নয়নের যে ফিরিস্তি পাওয়া যায় তাতে মনে হয় এই সরকার ক্ষমতায় আসার পরে ঢাকা শহরসহ দেশব্যাপী যোগাযোগ ব্যবস্থার শনৈ শনৈ উন্নতি হয়েছে। রাজনীতিকদের উন্নয়নের বর্ণনা বিশ্বাস করার সাধ থাকলেও মনে প্রশ্ন জাগে, যোগাযোগ ব্যবস্থার এত উন্নতির পরে আমাদের বর্তমান অবস্থা এত বেহাল কেন? ঢাকা শহরের যোগাযোগ ব্যবস্থা কতখানি বেহাল হলে একটি পত্রিকার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পড়া শেষ হয়ে গেলেও গাড়ি এক জায়গায় অচল দাঁড়িয়ে থাকে। রাস্তাগুলো ভয়ানক ভাঙাচোরা। কোনোটি বছরের পর বছর মেরামত হচ্ছে না। যেটি সদ্য মেরামত হয়েছে সেটির দিকে খেয়াল করে দেখলে বোঝা যায় রাস্তাটা সত্যিকার অর্থে মেরামত হয়নি। মেরামতের নামে রাস্তার এখানে সেখানে সামান্য পলেস্তারা পড়েছে যা কয়েক দিনের মধ্যে চটা উঠে যথা পূর্বং তথা পরং রূপ নেবে। শুধু তাই নয়, সদ্য মেরামত করা রাস্তায় বিটুমিন ঢালা শেষ হতে না হতে সেখানে বেসুমার খোঁড়াখুঁড়ি শুরু হয়ে যায়। বোঝা যায়, মোদ্দা কথা, উল্টেপাল্টে দেরে মা লুটেপুটে খাই। রাস্তার মাঝখানে অসহায়ভাবে বসে থেকে চারদিকে চোখ বুলিয়ে দেখি, দুই পাশে রাস্তার অর্ধেক জায়গা দখল করে রিকশা কিংবা ভ্যানগাড়ি এলোপাতাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। রিকশা, ভ্যানগাড়ি কিংবা পার্কিং করে রাখা বাস ট্রাকগুলো সরিয়ে দিতে পারলে জনদুর্ভোগ অনেকখানি কমতে পারত। রাস্তার জায়গা যানবাহন চলাচলের জন্য কতটুকু ব্যবহার হচ্ছে আর কতখানি জায়গা দখলদারদের কবলে সেটি দেখভাল করার জন্য সরকারের কি কোনো কর্তৃপক্ষ আছে? যদি থেকে থাকে তারা কি জনগণের টাকায় বেতন ভাতা খায়? তাহলে এত জনদুর্ভোগ কেন? রাস্তার জায়গা দখলদারদের কবলে আটকে আছে বলে আমরা সাধারণ মানুষ এত ভোগান্তি সহ্য করছি ভাবলে কষ্ট আরও বেড়ে যায়। মনে হয় পদ্মা সেতু, পাতাল রেল, এক্সপ্রেস হাইওয়ে ইত্যাদি একদিন হয়তো তৈরি করা শেষ হবে। যেদিন এসব মেগা প্রকল্পের কাজ শেষ হবে সেদিন কি আমরা তার সুফল ভোগ করতে পারব? আমার তো মনে হয় মেগা প্রকল্পের মেগা ম্যানেজমেন্টের কল্যাণে সেগুলোও জবরদখলদারীদের কবলে চলে যাবে। মানুষ বর্তমান বাস্তবতার নিরিখে ভবিষ্যৎ যাচাই করার চেষ্টা করে। বর্তমান বাস্তবতার নিরিখে ভবিষ্যতের উন্নত বাংলাদেশ কল্পনা করা কঠিন। এখন দেশজুড়ে যেসব রাস্তাঘাট তৈরি করা আছে সেগুলো সঠিকভাবে সংরক্ষণ করে তার সবটুকু জায়গা মানুষের চলাচলের উপযোগী করে দিলে জনজীবন সচল থাকতে পারত। রাস্তাঘাটের ম্যানেজমেন্ট সঠিক হলে মানুষকে দিনের পর দিন অচল অবস্থায় রাস্তার মাঝখানে বসে ঝিমাতে হতো না। ঢাকার ফুটপাথ কিংবা ফুটওভারব্রিজ হকারদের দখলে, রাস্তার অর্ধেক জায়গা ট্রাক, বাস, রিকশা কিংবা ভ্যানগাড়ির পার্কিং লট। যানবাহনগুলো রাস্তার একচিলতে সরু লেন ধরে চলার চেষ্টা করতে গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে আছে। একটু মনোযোগ দিয়ে চারপাশের দুরবস্থা খেয়াল করে দেখলে বোঝা যায়, কোনো অদৃশ্য শক্তি বছরের পর বছর ঢাকার রাস্তা এবং ফুটপাথকে তাদের আয়ের উৎস হিসেবে ব্যবহার করছে। জনস্বার্থ দেখার দায়িত্ব যদি সরকারের হয়ে থাকে তাহলে আমরা বলতে বাধ্য সরকার তার দায়িত্ব পালনে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। খোদ রাজধানী শহরে সরকারের চোখের সামনে জনস্বার্থের বেহাল দুর্গতি দেখে অনুমান করি রাজধানীর বাইরে পরিস্থিতি নিশ্চয়ই আরও খারাপ। সারা দেশে জনগণ ঘণ্টার পর ঘণ্টা তীব্র যানজটে আটকে থাকলেও রাস্তার জায়গা দখল করে দাঁড়িয়ে থাকা উটকো যানবাহন কিংবা দোকানপাট সরিয়ে দিয়ে জ্যাম থেকে জনগণকে মুক্তি দেওয়ার কেউ নেই। রাস্তার জ্যাম ছুটিয়ে আমাদের গাড়ির চাকায় গতি দেওয়ার দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে ট্রাফিক পুলিশ রাস্তায় মজুদ আছে। খেয়াল করলে দেখবেন, ট্রাফিক পুলিশের কনস্টেবল কিংবা সার্জন রাস্তার পাশে ভিন্ন কাজে মগ্ন। আমাদের কষ্ট লাঘব করার জন্য সামান্য উদ্যোগ নেওয়ার সদিচ্ছা তাদের নেই। ট্রাফিক পুলিশের কনস্টেবলকে দেখি রাস্তার এক কোনায় ছোট পিকআপ ভ্যানের ড্রাইভারের সঙ্গে লেনদেন নিয়ে দর কষাকষিতে ব্যস্ত। মোটরবাইকে বসা ট্রাফিক সার্জেন্টের চোখ তখন চাঁদাবাজিতে মত্ত কনস্টেবলের হাতের দিকে নিরিখ করে বাঁধা। চাঁদাবাজ কনস্টেবল পিকআপ ভ্যানের ড্রাইভারের কাছ থেকে কত টাকা আদায় করছে সেটি তত্ত্বাবধান করায় ব্যস্ত সার্জন রাস্তার যানজট ছোটাবে কখন। দীর্ঘ অপেক্ষার পরে একসময় গাড়ি ধীরগতিতে চলতে শুরু করলে কয়েক মিনিটের মধ্যে সামনে কোনো রেলক্রসিংয়ের ঘণ্টা বেজে ওঠে।

শহরের মধ্য দিয়ে রেলগাড়ি ক্রস করবে বলে দুই দিকে বাঁশের বার নেমে এসে রাস্তা আটকে দেয়। রাস্তার যাত্রীদের আবার অপেক্ষার পালা। কখন একটি ট্রেন রেলক্রসিং পার হয়ে আমাদের অপেক্ষার হাত থেকে মুক্তি দেবে সেই আশায় বসে থাকি। ক্লান্ত ড্রাইভার তার একঘেয়েমি দূর করার জন্য রেডিও চালু করলে সেখানে নেতা-নেত্রীদের বয়ানে উন্নয়নের তুবরি ছোটে। রেডিওর খবরে উন্নয়নের ধাপগুলোর টাইম ফ্রেম শুনতে পাই।

সরকারি দলের নেতা-নেত্রীর ভাষ্যে জানতে পারি ২০২১ সালে বাংলাদেশ নামের দেশটি মধ্যম আয়ের দেশ বনে যাবে। আর ২০৪১ সালে বাংলাদেশ উন্নত দেশে পরিণত হবে। খবর শুনে ভাবি, উন্নয়নের চড়ায় পৌঁছানোর জন্য আমাদের কি ধাপে ধাপে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হবে নাকি ২০৪১ সালে একটি উন্নত বাংলাদেশ আসমান থেকে ঝপ করে আমাদের সামনে নাজেল হবে! ২০১৮ সালের বাংলাদেশের মানুষ তাদের দৈনন্দিন জীবনে উন্নয়নের কোনো লক্ষণ কি সাদা চোখে দেখতে পাচ্ছে? ঢাকা শহরসহ ছোট-বড় সব শহরে পাকিস্তান আমলের মতো আজও সড়কের দুই মাথায় বাঁশের লাঠি ফেলে যানবাহন আটকে রেখে ট্রেন চলার পথ করে দেওয়া হচ্ছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে কত সরকার এলো গেল কোনো সরকারই কি রেললাইনের মুখে বাঁশের লাঠি ফেলার কালচার থেকে দেশকে এক ধাপ এগিয়ে নিতে পারল না? রেলক্রসিংয়ে বাঁশের লাঠির সামনে গাড়িতে আটকে বসে থেকে ভবিষ্যতে উন্নত বাংলাদেশ কল্পনা করা আমার মতো দুর্বল কল্পনা শক্তির মানুষের জন্য কঠিন। মনে হয় সরকারের পরিকল্পনা কি সত্যি নাকি উন্নয়ন এখন পরি এবং কল্পনা যা কোনো দিন বাস্তবে ধরা দেবে না। রাস্তার জ্যামে বেহাল অবস্থায় বসে থেকে রেডিওর খবরে মন্ত্রীদের মুখে উন্নয়নের ফিরিস্তি শুনে আমার একটি গল্প মনে পড়ে। অনেক দিন আগে গুলিস্তানে দুই ব্যক্তির মধ্যে ভয়ানক ঝগড়া বেধে গেছে। ঝগড়ার একপর্যায়ে একজন রেগে কাঁই হয়ে আরেকজনকে বলছে, ‘আর একটা কথা বললে তোকে একটা লাথি মেরে চাঁদে চালান করে দেব।’ দুই ঝগড়াটের পাশে এক লোক সদরঘাট যাবে বলে বাসের আশায় দাঁড়িয়ে ছিল। সে তখন নিজের পশ্চাদ্দেশ ক্ষিপ্ত বক্তার সামনে বাড়িয়ে দিয়ে বলে, ‘চাঁদ তো অনেক দূরের পথ। উনার জন্য কড়া লাত্থির বন্দোবস্ত দরকার। ওনার ব্যবস্থা আপনি পরে ধীরেসুস্থে করতে পারবেন। তার আগে আমাকে হালকার ওপর ছোট্ট একটা লাথি ঝেড়ে দিন। আমি ভাইজান সদরঘাট যেতে চাই।’ রাস্তার জ্যামে আটকে থেকে আমিও সদরঘাট যাত্রীর মতো ভাবি, বাংলাদেশ নামের নৌকাটা উন্নয়নের জোয়ারে তরতর করে উজান বেয়ে চলুক।

২০৪১ সালে দেশটি উন্নত বাংলাদেশ হয়ে যাক, আমরা তাতে বেজায় খুশি। সরকারের কাছে এ মুহূর্তে আমাদের বিনীত অনুরোধ, বাংলাদেশের ফুটপাথ-রাস্তা-ফুটওভারব্রিজগুলো মাস্তান-পুলিশের হাত থেকে উদ্ধার করে আমাদের বুঝিয়ে দিন।  আমাদের দৈনন্দিন জীবনে একটু গতি আসুক।  বর্তমানে দেশের যা সম্বল আছে সেটা স্বস্তির সঙ্গে ব্যবহার করার সুযোগ পেলে আমরাও আপনাদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে উন্নয়নের স্বপ্ন দেখার সাহস পাব।

লেখক : কথাসাহিত্যিক।

 

সর্বশেষ খবর