সোমবার, ১৫ জানুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা
ধর্মতত্ত্ব

মুসলিম ঐক্যের বিকল্প নেই

মাওলানা এরফান শাহ

জ্ঞান-বিজ্ঞান, তথ্য-প্রযুক্তি, প্রভাব-প্রতিপত্তি, গ্রহণযোগ্যতা ও আত্মমর্যাদা প্রভৃতি বিবেচনায় বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীর নাম মুসলিম।  মধ্যপ্রাচ্যে অবস্থিত ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইলের আয়তন ২০,৭৭০ বর্গকিলোমিটার এবং জনসংখ্যা ৭.৭ মিলিয়ন। তন্মধ্যে ১.৪ মিলিয়ন মুসলিম এবং ইহুদি ৬.৩ মিলিয়ন। মধ্যপ্রাচ্যের মোট জনসংখ্যা থেকে ইসরায়েলের জনসংখ্যা বাদ দিলে মধ্যপ্রাচ্যের জনসংখ্যা দাঁড়ায় ৩৬৭.৩ মিলিয়ন। ইসরায়েল মূলত মুসলিম রাষ্ট্র পরিবেষ্টিত একটি খুদে ভূখণ্ড। তারপরও ৩৬৭.৩ মিলিয়ন জনগণ অধ্যুষিত ৭১,৮৬,৮০৫ বর্গকিলোমিটার আয়তনের মধ্যপ্রাচ্যকে মাত্র ৭.৭ মিলিয়ন অধ্যুষিত ২০,৭৭০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের ইসরাইল পুতুলের ন্যায় ইচ্ছামতো নাকানি-চুবানি খাইয়ে যাচ্ছে। ইসরায়েলের সঙ্গে সংঘটিত একটি যুদ্ধেও আমরা জয়ী হতে পারিনি। শতাব্দীকাল ধরে ফিলিস্তিনিরা লাঞ্ছিত, বঞ্চিত, নির্যাতিত ও নিপীড়িত। নিজ মাতৃভূমিতে তারা আজ পরবাসী। নিজ দেশে তারা আজ পরাধীন। নিজ জন্মভূমিতে তারা আজ শরণার্থী। স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার ন্যূনতম অধিকারটুকুও তাদের নেই। স্বাধীন ফিলিস্তিন কত দূর! এ জন্য আর কতকাল অপেক্ষা করতে হবে? সেই অপেক্ষার প্রহর কবে শেষ হবে? আর কত রক্ত ঝরলে স্বাধীন ফিলিস্তিন নামক সেই সোনার হরিণের দেখা মিলবে? সেই প্রশ্ন এখন মুসলিম উম্মাহর। পৃথিবীতে মুসলিমের সংখ্যা ১৪০ কোটি কিন্তু ২০১৫ খ্রিস্টাব্দের হিসাব মতে, ইহুদির সংখ্যা মাত্র ১ কোটি ৪৪ লাখ। সারা বিশ্বের ১৪০ কোটি মুসলিম ১ কোটি ৪৪ লাখ ইহুদির কাছে জ্ঞান-বিজ্ঞান, শৌর্য-বীর্য, প্রভাব-প্রতিপত্তি, মর্যাদা প্রভৃতি বিবেচনায় কত তুচ্ছ! কত নগণ্য! কত দুর্বল! তা মধ্যপ্রাচ্যসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের দিকে নজর দিলে বোঝা যায়।

বাংলাদেশ থেকে যেসব প্রবাসী মধ্যপ্রাচ্যে চাকরি করতে যায়, তাদের সঙ্গে কোন ধরনের আচরণ করা হয়, তা ভুক্তভোগী মাত্রই জ্ঞাত। পৃথিবীর প্রায় সব কটি দেশে কমবেশি মুসলিম আছে। মুসলিম সংখ্যাঘরিষ্ঠ অধিকাংশ রাষ্ট্রে অন্তর্কোন্দল ও হানাহানি ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছেছে। পাকিস্তান-আফগানিস্তানের দিকে তাকালে বিষয়টি আরও পরিষ্কার হয়ে যায়। প্যালেস্টাইন, কাশ্মীর ও মিয়ানমারের দিকে চোখ দিলে অনুধাবন করা যায়, মুসলিমদের অবস্থা কত করুণ! তথ্যগতভাবে মুসলিমরা নিজেদের ভাই ভাই বলে ঘোষণা করলেও বাস্তবতা ভিন্ন। ইসরায়েল ও মার্কিনলবি অস্ত্র ব্যবসার জন্য মুসলিম বিশ্বে যুদ্ধ লাগিয়ে আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়া ও ইয়ামেন এক এক করে সব মুসলিম রাষ্ট্রকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। অথচ মুসলিম শাসকগণ ইহুদিদের ষড়যন্ত্রে পা দিয়ে অজান্তে নিজ পায়ে কুড়াল মারছে। মুসলিম উম্মাহ আজ বিশ্বে ভাসমান জাতি তথা শরণার্থীতে পরিণত হতে চলেছে।

বিশ্বব্যাপী মুসলিমদের প্রভাব এবং এই প্রভাব অবসানের কারণ কিন্তু বেশি নয়। অনৈক্য ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে নিজেদের অভিযোজিত করতে না পারাই মূলত মুসলিম উম্মাহর এমন দুরবস্থার অন্যতম কারণ। মূলত অনৈক্যই মুসলিম বিশ্বকে পিছিয়ে দিয়েছে। এক সময় মুসলিমরা সারা বিশ্বকে শাসন করেছে। তখন তাদের মধ্যে ঐক্য ছিল। যুগোপযোগী শিক্ষা, জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা ও গবেষণা ছিল। তৎকালীন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে রাজ্য জয় কিংবা প্রভাব প্রতিষ্ঠার জন্য যেসব যন্ত্র বা কলাকৌশল আবশ্যক ছিল, তাতে সমৃদ্ধ ও দক্ষ হওয়ার মতো জ্ঞান ছিল। এখন আমরা যুগোপযোগী জ্ঞান থেকে অনেক পিছিয়ে। গবেষণাবিমুখ হয়ে পড়েছি। কেউ যদি মনে করেন, সপ্তম শতকের অস্ত্র দিয়ে বিশ্বকে পদানত করবেন, তাহলে তারাই পদানত হয়ে যাবেন। মুসলিম বিশ্ব ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে পারলে এবং জ্ঞান-বিজ্ঞান ও গবেষণায় মনোযোগ দিলে, নিজেদের প্রভাব-প্রতিপত্তি পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হবে ইনশা আল্লাহ। নতুন বছরে মুসলিম উম্মাহর প্রত্যাশা পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তে কোনো মুসলিম নর-নারী নির্যাতিত হলে মুসলিম উম্মাহ সম্মিলিতভাবে, সমস্বরে এক কণ্ঠে এর প্রতিবাদ করবে। মজলুমের পাশে দাঁড়াবে। সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেবে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহপাক বলেন, ‘সব মুমিন পরস্পর ভাই-ভাই, অতএব, তোমরা তোমাদের ভাইদের মাঝে সন্ধি স্থাপন কর, হুজুরাত : ১০। হাদিসে রসুল (সা.) ইরশাদ করেন, এক মুমিন অপর মুমিনের জন্য ফাউন্ডেশনের ন্যায়। যার এক অংশ অপর অংশকে মজবুত করে, আঁকড়ে ধরে। বুখারি ও মুসলিম। অন্য হাদিসে রসুল (সা.) ইরশাদ করেন, সব মুসলমান একটা শরীর বা দেহের মতো। শরীরের কোনো অঙ্গ পীড়িত হলে পুরো শরীরে ব্যথা ও জ্বর অনুভব হয়। বুখারি ও মুসলিম। অনুরূপভাবে একজন মুসলিম আক্রান্ত হলে সব মুসলমান তার জন্য ব্যথিত হয় এবং ঝটপট করে। জঙ্গিবিমান ও বোমার আঘাতে বিধ্বস্ত বাড়িঘরে নিষ্পাপ শিশুর আর্তনাদ, অসহায় মুমিন নর-নারীর কান্না, মজলুম মুসলমানদের আহাজারি, মুসলিম উম্মাহ আর দেখতে চায় না। ফিলিস্তিন, সিরিয়া, ইয়ামেন, কাশ্মীর ও আরাকানে মৃত্যুর মিছিল যেন আর দীর্ঘায়িত না হয়। মুসলমানদের রক্তে আর কারও হাত যেন রঞ্জিত না হয়। মুসলিমরা যেন আর শরণার্থীতে পরিণত না হয়। আভিজাত্য আরবদের যেন আর ঘরবাড়ি ছাড়তে না হয়। মুসলিম বিশ্ব, ওআইসি, মুসলিম দেশ, মুসলিম শাসক, মুসলিম নেতা ও সাধারণ মুসলমানের প্রতি এ হচ্ছে মুসলিম উম্মাহর বিনীত আহ্বান। ঐক্যবদ্ধভাবে ইসলামবিরোধী ষড়যন্ত্র ও শত্রুর মোকাবিলা করা হোক। আশার কথা হচ্ছে, ইতিমধ্যে জেরুজালেম নিয়ে ইহুদি-মার্কিন ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে মুসলিম বিশ্ব সোচ্চার হয়েছে। মুসলিম বিশ্ব হুংকার ও চ্যালেঞ্জ ছুড়তে শুরু করেছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প ও নেতানিয়াহুর একগুঁয়েমি সিদ্ধান্ত মুসলিম বিশ্ব ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছে। বিশ্বে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ অব্যাহত রয়েছে। ইনশা আল্লাহ সব ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে, ভয়ভীতি ও রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে, মুসলিম বিশ্ব ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে যাবে।  মুসলিম বিশ্বে শান্তি ও ঐক্যের সু-বাতাস প্রবাহিত হোক এটিই উম্মাহর প্রত্যাশা।  আল্লাহপাক বলেন, ‘তোমরা নিরাশ হয়ও না এবং দুঃখ কর না। যদি তোমরা মুমিন হও তবে তোমরাই জয়ী হবে।’ ১৩৯:৩। 

লেখক : গ্রন্থকার ও গবেষক।

সর্বশেষ খবর