প্রতিদিন পাল্টাচ্ছে কৃষির অনুশীলন। বাণিজ্যিক কৃষিতে চুলচেরা হিসাব করে ফসল ফলানো হচ্ছে। পানি, তাপ, আলো, আর্দ্রতা কিংবা পুষ্টির হিসাবগুলো এখন আর প্রকৃতিনির্ভর নয়। বিজ্ঞানের অবদানে মানুষ এগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে শিখেছে। অল্প জমিতে, অল্প সময়ে বেশি ফসল উৎপাদনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা এগিয়ে যাচ্ছে। তা সম্প্রসারিতও হচ্ছে দ্রুত। ‘হৃদয়ে মাটি ও মানুষ’ অনুষ্ঠানে দেশে-বিদেশে গ্রিনহাউসে হাইড্রোপনিক কৃষির নানা চিত্র আপনারা দেখেছেন। দেখেছেন রাজধানীর বিসিএসআইআর বা সায়েন্স ল্যাবরেটরিতে গ্রিনহাউসে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে পুষ্টিকর ঘাস উৎপাদনের কৌশলও।
এ প্রযুক্তি এখন ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। আগ্রহী গরুর খামারিরা গড়ে তুলছেন ঘাস উৎপাদনের একই রকম খামার। নারায়ণগঞ্জের ফরাজিকান্দার তৌফিকুজ্জামান আজমান তেমনই এক শৌখিন উদ্যোক্তা। নিজের বাড়িতে শুরু করেছেন নিয়ন্ত্রিত তাপমাত্রায় ইনডোর হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে ঘাস উৎপাদন। আমি দেখতে গিয়েছিলাম এই পদ্ধতিতে ঘাস উৎপাদন করে কৃষক কতটুকু লাভবান হচ্ছে, কোনো সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন কিনা।
তৌফিকুজ্জামান আজমান তার বাড়ির আঙিনায় বদ্ধঘরে শুরু করেছেন হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে ঘাস উৎপাদন। মোট ১০০ ট্রে থেকে পর্যায়ক্রমে দৈনিক ১২৫ কেজি ঘাস উৎপাদন হচ্ছে তার সেই ঘরোয়া মাটিবিহীন ঘাস উৎপাদনব্যবস্থায় অর্থাৎ ইনডোর হাইড্রোপনিক ঘাস ফার্মিং সিস্টেমে। সবিস্তারে ঘাস উৎপাদনের পর্যায়গুলো তুলে ধরলেন তৌফিকুজ্জামান।
জানালেন ঘাসের বীজে ইন্ডাস্ট্রিয়াল সল্ট মিশিয়ে তিনি ভিজিয়ে রাখেন ছয় ঘণ্টা। তারপর সম্পূর্ণরূপে পানি ঝরিয়ে ট্রেতে রাখেন। সাত দিনেই পাওয়া যায় গবাদিপশুর খাওয়া উপযোগী ঘাস। প্রতিদিনই তাকে বীজ ট্রেতে রাখতে হয়। বদ্ধ ঘরটিতে স্তরে স্তরে সাজানো ট্রে। সবার নিচ থেকে শুরু করে এক দিন, দুই দিন, তিন দিনের ট্রেগুলো সাজিয়ে রাখা। সবার ওপরে সাত দিন বয়সী চারার ট্রে।
সাড়ে তিন লাখ টাকা খরচ করে বসিয়েছেন হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে ঘাস উৎপাদনের এই সিস্টেম। এটি থেকে পর্যায়ক্রমে প্রতিদিন ১২৫ কেজি ঘাস উৎপাদন করেন তিনি; যা সাতটি গরুর প্রতিদিনের ঘাসের চাহিদা মেটাতে সক্ষম।
তৌফিকুজ্জামান আজমান জানালেন, তিনি জাম্বো ও গম দুই ধরনের বীজ থেকে ঘাস উৎপাদন করছেন। তার মতে, ঘাস উৎপাদনের ক্ষেত্রে জাম্বোয় বেশি সুবিধা। ‘জাম্বোয় কেন সুবিধা?’ জানতে চাইলে, তিনি জানান, গমটা ভেঙে যায়, সে অপেক্ষা জাম্বোটা ফ্রেশ দেখায় এবং গবাদিপশু এটা খায়ও আগ্রহ নিয়ে।
তরতাজা ঘাসে রয়েছে প্রচুর প্রোটিন। গবাদিপশুর জন্য এই কাঁচা ঘাস অত্যন্ত উপযোগী। উদ্যোক্তা বলছেন, এ পদ্ধতিতে ঘাস উৎপাদন শুরু হওয়ার পর এখন তার খামারের গাভী ও বাছুরের জন্য আগের চেয়ে বেশি পুষ্টির জোগান দিতে পারছেন। কারণ, এই ঘাস পুরোপুরি জীবাণুমুক্ত। তিনি সাধারণত গবাদিপশুর ওজনের আড়াই শতাংশ হিসাবে প্রতিদিন কাঁচা ঘাস দিচ্ছেন। ফলও পাচ্ছেন বেশ ভালো।
তৌফিকুজ্জামান আজমানের খামারটি রীতিমতো একটি সমন্বিত খামার। খামারে রয়েছে নয়টি গাভী আর নয়টি বাছুর।
গাভীর পাশাপাশি আজমান পালন করছেন টারকি, দেশি মুরগি ও কবুতর। এই ঘাস শুধু গাভী নয়, টারকিকেও খাওয়ানো যায়।
আজমান সমন্বিত এই উৎপাদন কার্যক্রম শুরু করেছেন দীর্ঘমেয়াদি একটি সাফল্যের চিন্তা মাথায় রেখে। কৃষিতে বিনিয়োগের প্রশ্নে এই তরুণ আন্তরিক ও সাহসী। এরই মধ্যে আজমান উৎসাহ পেয়ে গেছেন বহুমুখী উৎপাদন সাফল্যে। আশা করছেন, অল্প দিনেই বেশ প্রসারিত হবে তার খামার।
প্রশ্ন হলো এই আধুনিক ও ব্যয়বহুল প্রকল্প সাধারণ খামারিদের পক্ষে গ্রহণ করা সম্ভব কিনা। যদিও দীর্ঘমেয়াদে এমন একটি প্রকল্প লাভজনক হতে পারে। কিন্তু প্রাথমিক বিনিয়োগই সাধারণ বা ছোট খামারির জন্য অনেক ভারী হয়ে যায়। উদ্যোক্তা তৌফিকুজ্জামানও একমত এ ব্যাপারে। তিনিও জানালেন, দেশীয় ও স্থানীয় পদ্ধতিতে যদি একই প্রক্রিয়ায় ও স্বল্প বিনিয়োগে ঘাস উৎপাদন শুরু করা যায়, তা খামারিদের জন্য হবে অনেক লাভজনক।
দেশীয় পদ্ধতিতে একই ঘাস উৎপাদনের দৃষ্টান্তও কিন্তু রয়েছে। আপনারা সম্প্রতি হৃদয়ে মাটি ও মানুষ অনুষ্ঠানের প্রতিবেদনে দেখেছেন নারায়ণগঞ্জের গার্মেন্ট ব্যবসায়ী হারুন অর রশীদের সমন্বিত খামার। তার খামারের বহুমুখী কৃষি উৎপাদন কার্যক্রমের ভিতর উন্নতমানের ঘাস উৎপাদনের ব্যবস্থাটিও আমাকে মুগ্ধ করে। তিনি ব্যবহার করেছেন সম্পূর্ণ দেশীয় পদ্ধতি। কিন্তু প্রযুক্তিটি একই, মাটি ছাড়া চাষ বা হাইড্রোপনিক ফার্মিং সিস্টেম।
গত বছর যশোর সদর উপজেলার পাঁচবাড়িয়া গ্রামে দেশীয় পদ্ধতিতে হাউড্রোপনিক ঘাস উৎপাদন করে দেশব্যাপী সাড়া ফেলে দেন যশোর ডেইরির স্বত্বাধিকারী রিয়াজ মেহমুদ খান। পিরোজপুরের বেকুটিয়া ফেরিঘাট এলাকার আলমগীর হোসেনও শুরু করেছেন দেশীয় পদ্ধতিতে হাইড্রোপনিক ঘাস উৎপাদন কার্যক্রম। দেশের অনেক এলাকাতেই ছড়িয়ে পড়েছে এমন নজির।
বছরের প্রতিদিন গবাদিপশুকে পুষ্টিকর খাদ্য দেওয়ার বিশাল এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য এ পদ্ধতি বেশ কার্যকর। যেখানে বাজারের দানাদার খাদ্যে গুণগতমান সবসময় ঠিক থাকে না। ফলত গবাদিপশুর বদহজমসহ নানা রোগবালাই দেখা দেয়। তা ছাড়া মাঠে লাগানো ঘাসে কৃমি ও শামুকের সংক্রমণে পশুর নানারকম রোগব্যাধি হয়।
গতানুগতিক কৃষিতে সাফল্য অর্জন এখন কঠিন। তার চেয়ে বরং আধুনিক প্রযুক্তি ও পদ্ধতিগুলো অনুসরণ করে অল্প দিনেই কাঙ্ক্ষিত সাফল্য অর্জন করা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে বিনিয়োগের অর্থের চেয়ে বেশি প্রয়োজন হতে পারে আন্তরিকতা ও নিষ্ঠা। প্রযুক্তিকে আন্তরিকতার সঙ্গে গ্রহণ করার মানসিকতাই আজকের দিনে সাফল্যের চাবিকাঠি হতে পারে— তার প্রমাণ দেখিয়েছেন তৌফিকুজ্জামান আজমান। আমি বিশ্বাস করি, তার এই আধুনিক ঘাস উৎপাদন কৌশল যেমন দ্রুত ছড়িয়ে পড়বে, একই সঙ্গে সম্প্রসারিত হবে দেশীয় পদ্ধতিও। মানুষের খাদ্য ও পুষ্টির পাশাপাশি প্রাণিসম্পদের পুষ্টিকর খাদ্যের প্রশ্নেও সবার মনোযোগ প্রয়োজন।
লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।