সোমবার, ২২ জানুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা
বিচিত্রিতা

স্তন্যপান শিশুর অধিকার

আফতাব চৌধুরী

স্তন্যপান শিশুর অধিকার

স্তন্যপান ব্যাপারটা মহার্ঘ্য হলেও তার অনুষঙ্গে রয়ে গেছে বিবিধ প্রতিবন্ধকতা— সামাজিক ও সাংস্কৃতিক। সেসবের বিরুদ্ধে সচেতনতা প্রচারের উদ্দেশ্যেই প্রতি বছর ১ থেকে ৭ আগস্ট বিশ্বজুড়ে স্তন্যপান সপ্তাহ পালিত হয়। ডব্লিউবিএ বা ‘ওয়ার্ল্ড অ্যালায়েন্স ফর ব্রেস্টফিডিং অ্যাকশন’ সংস্থাটির উদ্বোধন হয় ১৯৯১ সালে। ’৯২-এ তাদের উদ্যোগে শুরু হয় প্রথম স্তন্যপান সপ্তাহ পালন। এই কর্মযজ্ঞে ডব্লিউএইচও এবং ইউনিসেফের মতো প্রতিষ্ঠানেরও প্রত্যক্ষ ভূমিকা রয়েছে।

১৯৯০ সালে প্রথম প্রকাশিত ইনোসেনটির ডিক্লারেশনে মূল লক্ষ্য সম্পর্কে বলা হয়েছিল, ‘স্তন্যপানের প্রচার, সুরক্ষা ও সমর্থন’। গোটা পৃথিবীতে বোতল ফিডিংয়ের পরিবর্তে ব্রেস্টফিডিং কালচার গড়ে তোলার সঙ্গে সঙ্গে শিশুকে ছয় মাস বয়স পর্যন্ত শুধু স্তন্যপান করানো, ছয় মাসের পর থেকে সাপ্লিমেন্টারি হিসেবে মায়ের দুধ খাওয়ানো, স্তন্যদায়ী মাকে উপযুক্ত খাবার ও পুষ্টি গ্রহণে সাহায্য করা, স্তন্যপানের জন্য মা ও শিশুর উপযুক্ত পরিবেশ গড়ে তোলা, সে ঘরে হোক বা কর্মস্থলে হোক সমস্তই জননী ও শিশুর সুরক্ষার প্রাথমিক দাবিগুলোর মধ্যে অন্যতম।

সচেতনতা প্রচারে অন্য বিষয়গুলোর সঙ্গে বিশেষভাবে নজর দেওয়া হচ্ছে পৃথিবীর সমস্ত কর্মরত মায়ের প্রতি; যারা ঘরের বাইরে শিশুকে স্তন্যপান করানোর উপযুক্ত পরিবেশ এখনো পাননি। আর্থ-সামাজিক অবস্থান যাই হোক না কেন, শিশুকে স্তন্যদান মা এবং শিশুর প্রাথমিক অধিকার এবং এ বিষয়ে যতক্ষণ না সমাজ ও রাষ্ট্রের সহায়তা পাওয়া যাবে ততক্ষণ পর্যন্ত স্লোগান স্লোগানই থেকে যাবে, বাস্তবায়ন হবে না। স্তন্যপানের সঙ্গে মা ও শিশু সরাসরি সম্পর্কযুক্ত হলেও পরিবারের কাছের মানুষদের এবং প্রচলিত পরিবার কাঠামোয় বাবার সহযোগিতা একান্ত কাম্য। এই প্রয়োজনীয়তার তাগিদ থেকে ২০০২ সালে তানজানিয়া ও আরুশায় জিআইএফএস অর্থাৎ ‘গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ ফর ফাদার সাপোর্ট’ গঠিত হয়। পরে বৃহত্তর দৃষ্টিকোণ থেকে ২০০৬ সালের অক্টোবরে ‘জেন্ডার ট্রেনিং ওয়ার্কশপ’ ও ইউথ ওয়ার্কশপের মাধ্যমে ডব্লিউএমবিএ-ও (ওয়াবা) ছাতার নিচে নয়া উদ্যমে গড়ে ওঠে একটি জনপ্রিয় শাখা; যার নাম ‘মেনস ইনিশিয়েটিভ’। পুরুষ নামাঙ্কিত এই বিভাগ পুরুষদের দ্বারা পরিচালিত হলেও মূল ব্যাপারটা যে আদৌ পুরুষ বা পিতায় সীমাবদ্ধ নয়, তা বোধ করি ব্যাখ্যা দেওয়ার অপেক্ষা রাখে না। বলা যেতে পারে, এটি একটি ওভারঅল এফট, অর্থাৎ লিঙ্গনির্বিশেষে সার্বিক সচেতনতার বোধ তৈরি করাই এই মেনস ইনিশিয়েটিভের লক্ষ্য। ফেসবুক পরিসরে ‘ওয়াবা মেনস ইনিশিয়েটিভ’-এর একটি অফিশিয়াল পেজ আছে। এই পেজটিতে দেশ-বিদেশের সদস্যদের ক্রমাগত ছবি, খবর বা বিশ্লেষণ প্রকাশ করতে দেখা যায়; যার মাধ্যমে শিশুর অধিকার বিষয়ে লিঙ্গসাম্যের প্রশ্ন যেমন সামাজিক স্টিগমাগুলো চোখে পড়ে, তেমন তার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অনুপ্রেরণা হিসেবে পদক্ষেপগুলোও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

স্তন্যপান বিষয়ে লিঙ্গসাম্যের পরিপ্রেক্ষিত মূলত দুটি— এক. শিশুর লিঙ্গ যাই হোক না কেন, উপযুক্ত স্তন্যপান তার মানবিক অধিকার। দুই. মা এবং বাবা অথবা দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের শিশুকে প্রতিপালনের ক্ষেত্রে সাম্যের অধিকার। অর্থাৎ কোনো মাকে যদি ঘরের কাজে এতটাই ব্যস্ত থাকতে হয়, তিনি যথাসময়ে শিশুকে স্তন্যপান করাতে না পারেন, সে ক্ষেত্রে বাবার ও পারিবারিক বাকি সদস্যদের কাজ হবে ঘরের কাজ ভাগ করে নেওয়া; যাতে মা-শিশু পরস্পরের জন্য যথেষ্ট সময় পায়। কর্মস্থলেও একই কথা প্রযোজ্য, উপরন্তু স্তন্যদায়ী মাকে একটি ঘর বা পরিসর অথবা পরিবেশ দিতে হবে, যাতে তিনি সন্তানকে নির্দিষ্ট সময় অন্তর স্তন্যপান করাতে পারেন। পরীক্ষা করে দেখা গেছে, নিষ্কাশিত মাতৃদুগ্ধ সংরক্ষণ করে রেখে শিশুকে খাওয়ানোর তুলনায় সরাসরি স্তন্যপান অনেক বেশি ফলপ্রসূ। সংরক্ষণের পাত্র, তাপমাত্রা ইত্যাদির যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ করা না গেলে মাতৃদুগ্ধ সহজেই নষ্ট হয়ে যায়। তা ছাড়া, শিশুকে মায়ের শরীরের সান্নিধ্যে এনে স্তন্যপান করালে পারস্পরিক বন্ধন অনেক বেশি দৃঢ় হয়; যা শিশুটির শারীরিক ও মানসিক বিকাশের পক্ষে সহায়ক হয়ে ওঠে। একই কথা বাবার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। সুইডিশ অধ্যাপক এ ওয়াল্ড তার গবেষণায় দেখিয়েছেন, একটি প্রি-ম্যাচিওর শিশুকে একা ইনকিউবেটরে ফেলে রাখার পরিবর্তে তাকে মা-বাবা, ভাই-বোনের দেহের সরাসরি সংস্পর্শে রাখলে স্কিন-টু-স্কিন কন্টাক্টের ফলে তার বৃদ্ধি একই রকম বা ক্ষেত্রবিশেষ দ্রুততর হয়।

মেনস ইনিশিয়েটিভ মায়ের যত্ন ও সুরক্ষা থেকে শুরু করে শিশুর জন্মের পর মা ও শিশুর জীবনযাপনের উপযোগী পরিবেশ দেওয়া, শিশুর স্তন্যপানে সাহায্য করা, ঘর ও বাইরের কাজে মাকে সহযোগিতা করা, এমনকি নিরাপদ যৌনতা ও সুস্থ যৌনজীবন বিষয়ে শিক্ষিত ও সচেতন করে তোলার ব্যাপারে অঙ্গীকারবদ্ধ।

লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর