মঙ্গলবার, ২৩ জানুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

গৌরব ও ঐতিহ্যের ১২৫ বছর গৈলা মাধ্যমিক বিদ্যালয়

অজয় দাশগুপ্ত

গৌরব ও ঐতিহ্যের ১২৫ বছর গৈলা মাধ্যমিক বিদ্যালয়

বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলার গৈলা গ্রামে ১৮৯৩ সালের ২৩ জানুয়ারি গৈলা উচ্চ ইংরেজি স্কুলটি ১২২ শিক্ষার্থী নিয়ে যাত্রাা করে। কিন্তু তার অনেক আগ থেকেই গৈলা আলোকিত গ্রাম। আরও অন্তত অর্ধশত বছর আগে এ গ্রামের কবীন্দ্রবাড়িতে (ন হন্যতে, মংপুতে রবীন্দ্রনাথ ও অন্যান্য বিখ্যাত গ্রন্থের লেখক মৈত্রেয়ী দেবীর বাড়ি) চালু হয়েছিল সংস্কৃত শিক্ষার কলেজ; যেখানে ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, ফরিদপুর প্রভৃতি জেলা থেকে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার জন্য আসতেন। পাশাপাশি ছিল মৌলভিদের কাছে ফারসি ভাষা শিক্ষার ব্যবস্থাও। রবীন্দ্রনাথ তার ‘সহজ পাঠ’-এ উল্লেখ করেছেন বরিশালের গৈলা গ্রামের নাম। এ গৈলা গ্রামেরই বাসিন্দা ছিলেন বিজয় গুপ্ত। তিনি অন্তত ৫০০ বছর আগে ‘মনসামঙ্গল’ কাব্য রচনা করেছিলেন বাংলায়, যখন অধিকতর প্রচলিত ভাষা ছিল সংস্কৃত। জীবনানন্দ দাশের মা কুসুম কুমারী দেবীও গৈলার বাসিন্দা। ‘আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে, কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে’ কবিতার রচয়িতা তিনি।

১৮৮৫ সালে সাড়ে চার বর্গমাইল আয়তনের এ গৈলা গ্রামেরই এক ছাত্র কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্র্যাজুয়েট হন। ১৮৯৩ সালে কালুপাড়া উত্তরের বাড়ির বিশ্বেশ্বর সেন গ্রামের প্রথম এম এ। ১৮৮৫ থেকে ১৮৯২ পর্যন্ত গ্রামের ১৩ জন গ্র্যাজুয়েট ডিগ্রি লাভ করেন। গৈলা স্কুলের প্রথম প্রধান শিক্ষক হয়ে আসেন সে সময়ে বিএ পাস শেষে সরকারি উচ্চপদে কর্মরত কৈলাসচন্দ্র সেন। তিন দশকেরও বেশি বিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি। পাশাপাশি তিনি পাশের গ্রামের ভেগাই হালদার ইনস্টিটিউশনেরও ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। তার জীবনাবসান ঘটেছে আট দশকেরও আগে। এখনো গৈলা গ্রাম ও আশপাশের লোকেরা তাকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে। বিদ্যালয়প্রাঙ্গণে তার স্মৃতিসৌধে লেখা আছে ‘ডেথ ডিভাইডস, মেমরি লিঙ্গারস’। প্রকৃতই স্মৃতিতে চিরভাস্বর তিনি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এ গ্রামটিকে চিনতেন। ১৯৩১ সালে এ গ্রামের তারকেশ্বর সেন নামের এক তরুণ বিপ্লবীকে ব্রিটিশ পুলিশ হিজলী বন্দীশিবিরে গুলি করে হত্যা করেছিল। এর প্রতিবাদে কলকাতায় যে সমাবেশ হয় তাতে সভাপতিত্ব করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি সেই সভায় বিখ্যাত ‘প্রশ্ন’ কবিতা পাঠ করেন, যার একটি লাইন ‘প্রতিকারহীন শক্তের অপরাধে/বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে।’

এ গ্রামের ছাত্রছাত্রীদের উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য যেতে হতো ঢাকা বা কলকাতায়। ঢাকায় যেতে সাত-আট দিনে প্রমত্ত পদ্মা-মেঘনা নদী নৌকায় পাড়ি দিতে হতো। কলকাতায় যেতেও তিন-চার দিন লাগত। কোনো প্রতিকূলতাই গ্রামের ছাত্রছাত্রীদের জ্ঞানের প্রত্যাশা পূরণ থেকে নিবৃত্ত করতে পারেনি। বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার কয়েক বছরের মধ্যেই ছাত্রছাত্রী সংখ্যা এক হাজার ছাড়িয়ে যায়। স্কুল পরিচালনার জন্য অভিভাবকদের একটি সংগঠন ছিল। তবে এর অভিনবত্ব ছিল গৈলা গ্রামের যারা এমএ-এমএসসি বা এ ধরনের ডিগ্রি অর্জন করতেন, তারা আপনাআপনি এই পরিষদের সদস্য হিসেবে গণ্য হতেন। ১৮৯৩ থেকে ১৯৪২ সাল পর্যন্ত এ বিদ্যালয় থেকে ১ হাজার ৫ জন ছাত্রছাত্রী এনট্রান্স বা মেট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। গৈলা গ্রামটি তখন উচ্চতর ডিগ্রিধারীদের পদচারণে মুখর ছিল। ‘গৈলার কথা’ গ্রন্থ থেকে আমরা জানতে পারি, চল্লিশ দশক পর্যন্ত এ গ্রাম থেকে অন্তত ৪০ জন ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেছিলেন। এর মধ্যে সাতজন নারী। এমএ-এমএসসি ও সমপর‌্যায়ের পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণি পেয়েছিলেন অন্তত ২২ জন। এমবিবিএস ডাক্তার ছিলেন ৩৩ জন এবং গ্র্যাজুয়েট ইঞ্জিনিয়ার ৪৩ জন। ব্রিটিশ আমলেই গ্রামে মাস্টার্স ডিগ্রিধারী নারী ছিলেন অর্ধশতের বেশি। এর বাইরে বিএ-বিএসসি পাস করেছিলেন আরও ২৪ জন নারী।

গৈলা স্কুল এখন মডেল স্কুল। অচিরেই সরকারি বিদ্যালয় হিসেবে হবে নবযাত্রা। ছাত্রছাত্রী প্রায় দেড় হাজার। জনপ্রিয় রাজনীতিবিদ ও কৃষক রদি হিসেবে পরিচিত সেরালের আবদুর রব সেরনিয়াবাত টানা দুই দশক এ স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির কর্ণধার ছিলেন। তিনি ছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভগ্নিপতি। গৈলার পার্শ্ববর্তী নাঠৈ গ্রামেও বঙ্গবন্ধুর আত্মীয়বাড়ি ছিল। এ দুই এলাকার সুবাদে শৈশবে এ অঞ্চলে কিশোর শেখ মুজিবুর রহমানের যাতায়াত ছিল এবং গৈলা স্কুলও ছিল তার পদচারণে ধন্য। বঙ্গবন্ধুর বোনের পুত্র জাতীয় সংসদে স্থানীয় সরকারসংক্রান্ত স্ট্যান্ডিং কমিটির চেয়ারম্যান ও সাবেক চিফ হুইপ আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ স্কুলটির উন্নতির বিষয়ে বিশেষভাবে মনোযোগী। এ স্কুলের ব্যবস্থাপনায় তিন দশক যুক্ত ছিলেন ইউসুফ হোসেন মোল্লা। গৈলাকে মন্ত্রীদের গ্রামও বলা হয়। আবদুর রব সেরনিয়াবাত ও আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ ছাড়াও এ বিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র সুনীল কুমার গুপ্ত, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম এ মালেক ও সৈয়দ আবুল হোসেন বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রী কিংবা মন্ত্রীর মর‌্যাদায় দায়িত্ব পালন করেন। নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের পিএইচডি গবেষণার সময়ের শিক্ষক অমিয় দাশগুপ্ত গৈলা স্কুলে পড়াশোনা করেছেন। তার সম্পর্কে অমর্ত্য সেন লিখেছেন ‘স্যার বলতেন, তার জীবনে যা কিছু অর্জন তার মূলে গৈলা স্কুলের শিক্ষা।’

এ বিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রছাত্রীরা ১৯৯৩ সালে তাদের প্রিয় প্রতিষ্ঠানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে নিজেদের অর্থে নির্মাণ করেছেন শতবর্ষ ভবন। ২০০০ সালে সাবেক ছাত্র ও সাবেক মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন কৃতী ছাত্রছাত্রীদের জন্য গঠন করেন ৫ লাখ টাকার বৃত্তি তহবিল। গত দেড় যুগে এ তহবিল থেকে কৃতী ছাত্রছাত্রীদের ৭ লাখ টাকার বেশি বৃত্তি প্রদান করা হয়েছে এবং এখনো জমা রয়েছে ৭ লাখ টাকার বেশি।

প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে বিদ্যালয়ে সমাবেশ, আনন্দমিছিল ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। ঢাকাস্থ সাবেক ছাত্রছাত্রীরা ২৬ জানুয়ারি আয়োজন করেছেন পারিবারিক পুনর্মিলনীর। এ অনুষ্ঠানে অর্ধশত বছর আগ পর্যন্ত যারা বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন তাদের বিশেষ সম্মাননা দেওয়া হবে।  বাংলাদেশের গ্রামীণ জনপদের অন্যতম প্রাচীন এই প্রতিষ্ঠানটি গৌরব ও ঐতিহ্যের ধারায় শিক্ষার বিস্তার ও মানোন্নয়নে অবদান রেখে যাবে, এটাই প্রত্যাশা।

লেখক : সভাপতি, গৈলা পরিষদ।

সর্বশেষ খবর