বৃহস্পতিবার, ২৫ জানুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

বই ছাপানো নিয়ে তুঘলকি কাণ্ড!!!

সাইফুর রহমান

বই ছাপানো নিয়ে তুঘলকি কাণ্ড!!!

দীর্ঘ পাঁচ-ছয় ঘণ্টা উড়োজাহাজে কাটিয়ে ইয়ান মার্টেল যখন লন্ডনের হিথ্রো এয়ারপোর্টে পৌঁছলেন তখন তিনি শারীরিকভাবে বেশ খানিকটা ক্লান্ত ও পরিশ্রান্ত। মনের ফুর্তিটা কিন্তু ধরে রেখেছেন ঠিকই, দৈব্যক্রমে যদি এবার বুকার পুরস্কারটি জোটে কপালে তাহলে তো সাগরের তলায় মুক্তা খুঁজে পাওয়ার মতো অবস্থা হবে। অভিবাসন কর্মকর্তার কাছে নিজের পাসপোর্টটি সমর্পণ করে ঈষৎ হাসি হাসি দৃষ্টিতে তাকালেন তার দিকে। ইমিগ্রেশন অফিসার একবার পাসপোর্টে আবার ইয়ান মার্টেলের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কানাডা থেকে আসছেন বুঝি? মার্টেল প্রতিউত্তরে বললেন, জি, হ্যাঁ। ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা পুনরায় প্রশ্ন করলেন, ভ্রমণের উদ্দেশ্য কি নিছক ঘুরে বেড়ানো? নাকি কোনো কাজ-কর্মে এসেছেন এখানে। কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইলেন মার্টেল। হঠাৎ বলে ফেললেন, বুকার জয় করতে এসেছি এখানে। একবার অনুশোচনা হলো একটু, কেন যে এমন একটি আলপটকা মন্তব্য করে ফেললেন হঠাৎ। পুনরায় ভাবলেন যা হয়েছে ভালোই হয়েছে। মনে যা এসেছে বলে দিয়েছেন দ্বিধাহীনভাবে। বিড়ালের কপালে যদি শিকে আদৌ ছিঁড়ে তবে এই কর্মকর্তাটি নিশ্চয়ই বুক ফুলিয়ে তার সতীর্থ বন্ধুদের বলবেন- জানিস, এই গুলবাজটিকে কিন্তু আমিই ঢুকতে দিয়েছিলাম ইংল্যান্ডে। আর যদি পুরস্কার না জোটে তবে আমার এসব চাঁপাবাজি হয়তো অচিরেই ভুলে যাবে লোকটি।

সে রাতে সত্যি সত্যি যখন পুরস্কারের ঘোষণা এলো তখন ইয়ান মার্টেল যেন কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না যে, লাইফ অব পাইয়ের জন্য এবার তাকেই দেওয়া হয়েছে বুকার। তিনি ইয়েস বলে বাঁ-হাতের মুঠিটি সুদৃঢ় করে সজোরে ঘুরালেন বাতাসে। তার কাছে মনে হলো স্যার এডমন্ড হিলারি এভারেস্টের চূড়ায় উঠে যতটা খুশি হয়েছিলেন ইয়ান মার্টেল বোধকরি তার চেয়েও বেশি আনন্দ লাভ করলেন।

জীবনের এই শুভক্ষণে শুরুতে ভাসমান মেঘমালার মতো অতীতের দুঃখ-কষ্টের মুহূর্তগুলো জড়ো হতে লাগল তার হূদয়ে। ছোট শিশুর মতো আবেগে উদ্বেলিত হয়ে উঠলেন মার্টেল। চোখ উপচে জল এলো। কী কষ্টের সময়টিই না পার করতে হয়েছে লেখক জীবনের সূচনালগ্নে। গলগ্রহ হয়ে থাকতে হতো বাবা-মায়ের সঙ্গে। বাড়ি ভাড়া তো দূরের কথা বরং তাদের খাওয়া-দাওয়ায় ভাগ বসাতে হতো দৈনিক। খণ্ডকালীন কিছু কাজকর্ম করতেন বটে যেমন মালিকের বাগানে গাছ লাগানো। থালাবাসন, হাঁড়িকুড়ি ধোয়া-মোছার মতো কাজগুলো। কিছুদিন আবার কাজ করেছিলেন নৈশপ্রহরী হিসেবে কিন্তু এতে কি আর জীবন চলে! জীবনের এত দুর্ভোগ-দুর্দশা, কষ্ট-ক্লেস অবশ্য কখনই তার কলমপেষাকে ব্যাহত করতে পারেনি। এ জন্যই বোধকরি আজ এ পর্যন্ত পৌঁছতে পেরেছেন তিনি।

১৯৯১ সালের দিকে মনস্থির করলেন প্রকাশ করবেন একটি গল্প সংকলন। ১৬টি গল্প আলাদা আলাদা করে মতামতের জন্য পাঠানো হলো ১৬টি প্রকাশনীতে। ভাগ্যের এমনি পরিহাস, প্রত্যাখ্যানপত্র এলো ১৬টি জায়গা থেকেই। অনেক কায়ক্লেসে গল্প সংকলনটি ছাপা হলো ১৯৯৩ সালে। বইটি প্রশংসিত হলো বটে, কিন্তু বিক্রি হলো যৎসামান্য। এরপর তার প্রথম উপন্যাস ‘সেলফ’ প্রকাশিত হয় ১৯৯৬ সালে। সেটি বিক্রি হলো না একেবারেই।

এরপর বেশ কয়েক বছর সময় নিয়ে মার্টেল লিখলেন তার দ্বিতীয় উপন্যাস ‘লাইফ অব পাই’। যার আগের দুটো বইয়ের কাটতি হয়নি তেমন, সে রকম একজন লেখকের তৃতীয় বই ছাপানো ছিল একেবারেই অসম্ভব। কিন্তু পশ্চিমা বিশ্বে বই ছাপানোর এই এক সুবিধা। ভালো কিছু লিখলে কোনো না কোনোভাবে ছাপা হবেই। লাইফ অব পাইয়ের ক্ষেত্রেও সেরকম কিছু ঘটল। বইটি আপাদমস্তক পড়ার পর প্রকাশনী সংস্থা সিদ্ধান্ত নিলেন বইটি ছাপবেন তারা। এরপর তো সবই ইতিহাস।

বাংলাদেশে বই ছাপানোর চালচিত্র কিন্তু একেবারেই ভিন্ন। বই প্রকাশ নিয়ে এখানে চলে তুঘলকি কাণ্ড! এখানে বই প্রকাশ করার ক্ষেত্রে খুব একটা অনুসৃত হয় না নিয়মনীতি। বাংলাদেশের বেশিরভাগ প্রকাশনীরই নেই কোনো এডিটোরিয়াল বোর্ড। পশ্চিমা দেশগুলোতে প্রত্যেকটি প্রকাশনীতেই একটি সম্পাদকমণ্ডলী থাকে। প্রকাশনা সংস্থায় যখন একটি বই জমা পড়ে সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্যরা তখন ভালো করে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেন বইটি আদৌ প্রকাশের যোগ্য কিনা। তাদের এই সূক্ষ্ম দৃষ্টির কারণে হয়তো অনেক লেখকের ভালো ভালো বইও বাদ পড়ে যায়। কিন্তু তাতে করার কিছু নেই। শতভাগ নিশ্চিত না হয়ে কিছুতেই তারা একটি উপন্যাস কিংবা অন্য কোনো বই তুলে দিতে চান না পাঠকের হাতে। তারা মনে করেন যে কোনো কারণেই হোক, একটি দুর্বল বই প্রকাশ করে পাঠকদের ঠকানোর অধিকার তাদের নেই। এ কারণেই দেখা যায়, উত্তরকালে অনেক লেখক যারা বিখ্যাত হয়ে জগৎ মাতিয়েছিলেন তাদের বইও প্রত্যাখ্যাত হয়ে ফিরে এসেছে নামিদামি সব প্রকাশনালয় থেকে। তাদের মধ্যে রাউলিং, মার্কেজ, নুট হ্যামসুন, নভোকভ, জর্জ অরওয়েল, আগাথা ক্রিস্টি, জুলভার্ন, গোল্ডিং, স্টিফেন কিং, কিপলিং, জেমস জয়েস, আছে আরও কত শত নাম। পশ্চিমা দেশগুলোতে প্রায় প্রত্যেকটি লেখককেই সূক্ষ্ম ছাঁকনির মধ্য দিয়ে যেতে হয়। নিজের মেধা, মনন, মনোবল ও দৃঢ়তা দিয়ে লেখকসত্তাকে প্রতিষ্ঠিত করতে হয়। আমাদের দেশে অবশ্য এসব দিক বিবেচনা করলে দেখা যায় একেবারেই বিশৃঙ্খল অবস্থা। এখানে লেখকের চেয়ে অলেখকের সংখ্যাই বেশি। বেশিরভাগ লেখকই আসলে ময়ূরপুচ্ছধারী কাক। ফেব্রুয়ারি মাস এলেই যোজন সহস্র লেখকযশপ্রার্থী হন্যে হয়ে দৌড়ঝাঁপ শুরু করে দেন। তখন এ সুযোগটিই কাজে লাগান আমাদের দেশের অসাধু প্রকাশনালয়গুলো। তারা টাকা নিয়ে বই ছাপান। ধারও ধারেন না বইটিতে আদৌ কোনো সারবস্তু আছে কিনা। আর এতে করে বঞ্চিত হন প্রকৃত লেখক। নিয়ম হচ্ছে প্রকাশক দৌড়াবে প্রতিভাবান লেখকদের পেছনে। কিন্তু বাংলাদেশে লেখকরাই সাধারণত হত্যে দিয়ে বেড়ান প্রকাশনালয়গুলোতে।

আমি আমার নিজের একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলি। ২০১৫ সালে আমি আমার প্রথম বই বের করব বলে সিদ্ধান্ত নিই। বিলেত থেকে ব্যারিস্টারি পাস করে দেশে ফিরেছি ২০০৪ সালে। স্কুলজীবন থেকে লেখালেখির সূত্রপাত হলেও ২০০৪ সাল থেকে লেখালেখি করছি পুরোদমে। কৈশোরে বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ও স্কুল ম্যাগাজিনে লিখলেও ২০০৪ সাল থেকে লেখা শুরু করি সমকাল নামক দৈনিকে। ২০১৩ সাল থেকে নিয়মিত লিখছি বাংলাদেশ প্রতিদিনে, তারপর যুগান্তর, কালের কণ্ঠ, আমাদের সময়, আলোকিত বাংলাদেশ প্রভৃতি পত্রিকায়। যুগান্তর, কালের কণ্ঠ ও বাংলাদেশ প্রতিদিনের বদৌলতে কিঞ্চিৎ লেখক খ্যাতিও জুটেছে ইতিমধ্যে। মনে মনে ভাবলাম বাংলাদেশ প্রতিদিন ও যুগান্তরে প্রকাশিত লেখাগুলো নিয়ে একটি সংকলন বের করলে মন্দ হয় না। প্রথমা বইয়ের দোকানের জয়েন্ত দাস আমাকে বিশেষ পছন্দ করেন। তিনিই একদিন আমাকে বললেন, আপনার বইয়ের জন্য একটি প্রকাশক পাওয়া গেছে। আমি খুবই খুশি। সে অনুযায়ী আমি জয়েন্ত দা ও আমার ভবিষ্যৎ প্রকাশক একদিন বাংলাবাজার বিউটি বোডিংয়ে লাঞ্চ মিটিং করলাম। আমার ভবিষ্যৎ প্রকাশক একথা-সেকথা বলে কিছুক্ষণ পর আমাকে বললেন, বই ছাপাতে টাকা লাগবে। আমি তো পাহাড় থেকে পড়লাম একেবারে সোজা মাটিতে, একি বলছেন আমার ভবিষ্যৎ প্রকাশক! আমি বললাম, আমার লেখা আগে পড়ুন, তারপর সিদ্ধান্ত নিন। উনি আমাকে সাফ জানিয়ে দিলেন টাকা ছাড়া বই প্রকাশ করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। আমি বললাম, আপনার প্রকাশনীর নামের তো অর্থ হচ্ছে অন্বেষণ করা। তো আপনি কী অন্বেষণ করেন। আপনার প্রকাশনীর জন্য ভালো বই, নাকি টাকা? আমার বলতে এতটুকুও দ্বিধা নেই যে, এই দেশে অনেক শ্রুতকীর্ত লেখকই তাদের জীবনের প্রথম বই গাঁটের পয়সা খরচ করে ছাপিয়েছেন। তাতে কোনো মহাভারত অশুদ্ধ হয়েছে বলে আমি মনে করি না। কিন্তু আমি ব্যক্তিগতভাবে টাকা খরচ করে বই ছাপানোর ঘোরবিরোধী। কবিতার বইয়ের সাধারণত কাটতি কম থাকায় বাংলা ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি আল মাহমুদের ‘লোক-লোকান্তর’ কবি সাহিত্যিকদের যৌথ উদ্যোগে প্রকাশ পেয়েছিল। আবদুল মান্নান সৈয়দ তার প্রথম বই ‘জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ’ নিজের টাকায় প্রকাশ করেছিলেন। সেলিনা হোসেন তার প্রথম বই প্রকাশ করেছিলেন নিজের টাকা খরচ করে। সে সময়ের লেখকদের মধ্যে অবশ্য শামসুর রাহমান ও নির্মলেন্দু গুণ ছিলেন বলা চলে কিছুটা ভাগ্যবান। শামসুর রাহমানের প্রথম কবিতার বই প্রকাশিত হয় ১৯৬০ সালে। বইয়ের নাম ‘প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’। ১৯৪৮ সালের পরে পুরো ১২ বছরের কাব্যসাধনার ফসল হচ্ছে এ কবিতা সংকলন। গল্পকার সম্পাদক এবং প্রকাশক মহীউদ্দিন আহমেদ এক প্রকার অনুরোধ করেই কবির কাছ থেকে আদায় করেছিলেন ‘প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’ পাণ্ডুলিপিটি। পাণ্ডুলিপি চেয়ে নেওয়ার আরেকটি কারণ হচ্ছে শামসুর রাহমান ‘পুর্বাশা’ ‘নতুন সাহিত্য’, ‘উত্তরসূরি’ ‘দেশ’ ‘কবিতা’ প্রভৃতি পত্রিকায় লেখালেখি করে ইতিমধ্যে কিছুটা খ্যাতি অর্জন করে ফেলেছিলেন। পাণ্ডুলিপি জমা দেওয়ার কয়েক মাসের মধ্যেই বই ছাপা হয়ে গেল। কিন্তু বইটির কাটতি হলো না তেমন। তিনি তার আত্মজীবনী ‘কালের ধুলোয়’ লিখেছেন— ‘প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে কাব্যগ্রন্থটি খুব বেশি বিক্রি হয়েছে বলে প্রকাশক কিংবা কোনো পুস্তক বিক্রেতার কাছ থেকে শুনিনি। এ জন্য আমার কোনো খেদ ছিল না। প্রকাশকের কাছ থেকে যৎসামান্য টাকা পেয়েও কোনো হা-হুতাশ করিনি। লিখে যাওয়াতেই আমার আনন্দ। সেকালে এমনই মনোভঙ্গি ছিল আমার।’

অন্যদিকে কবি নির্মলেন্দু গুণ তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘প্রেমাংশুর রক্ত চাই’ প্রকাশের জন্য ১৯৭০ সালে নওরোজ কিতাবিতান, মাওলা ব্রাদার্স এবং বইঘর প্রকাশনীতে ধরনা দিয়ে বারবার ব্যর্থ হন। কোনো প্রকাশকই তার বই প্রকাশের ঝুঁকি নিতে চাননি। অবশেষে খান ব্রাদার্স নিজ থেকে তার প্রথম কবিতার এ বইটি প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করে। প্রকাশনার এমন অবস্থায় অবশ্য আরও একজন ছিলেন নক্ষত্রের মতো, তিনি মুক্তধারার চিত্তরঞ্জন সাহা। তখনকার সময়ের তরুণ লেখকের আশ্রয় ছিলেন তিনি।

পশ্চিমবঙ্গে কিন্তু নিজের পকেটের টাকা খরচ করে বই ছাপানোর সংস্কৃতি একেবারে নেই বললেই চলে। প্রকৃত সাহিত্যচর্চাটা আসলে এক সময় ওখানেই হতো। এ মুহূর্তে শুধু আমার একজন লেখকের কথা মনে পড়ছে, যে কিনা নিজের টাকা খরচ করে বই ছাপিয়েছিলেন। লেখকটি ছিলেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। তারাশঙ্কর কংগ্রেসের কর্মী হয়ে সমাজসেবামূলক কাজ করতে গিয়ে জেল খেটেছিলেন কিছুদিন। তিনি তাঁর ‘আমার সাহিত্য জীবন’ বইটিতে লিখেছেন— ‘জেলখানা থেকে বেরিয়ে এলাম। উপাসনার সম্পাদক কবি সাবিত্রীপ্রসন্নের সঙ্গে আলাপ আগেই হয়েছিল, এবার তিনি অন্তরঙ্গ বন্ধু হলেন। তার উপাসনা প্রেস থেকেই চৈতালী ঘূর্ণি বের হলো।’

চৈতালী ঘূর্ণি তারাশঙ্করের প্রথম উপন্যাস। এটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৩১ সালে। বইটি তিনি উৎসর্গ করেছিলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্রের নামে।

এ উপন্যাসটি প্রকাশ করতে গিয়ে তাকে কিরূপ হেনস্তা হতে হয়েছিল তার একটি হৃদয়স্পর্শী বর্ণনা পাওয়া যায় সবিতেন্দ্রনাথ রায়ের লেখা ‘লেখকের কাছাকাছি’ গ্রন্থটিতে। সেখানে তিনি লিখেছেন— স্ত্রীর গয়না বিক্রি করে তারাশঙ্কর চৈতালী ঘূর্ণি উপন্যাসটি ছেপেছিলেন। ভেবেছিলেন, বই বিক্রি করে সে টাকায় গয়না নতুন করে গড়িয়ে দেবেন। বিক্রি তো হলোই না। এ দোকানে সে দোকানে বই জমা দেন, কিন্তু পয়সা পান না। একদিন ‘বঙ্গশ্রী’ পত্রিকা অফিসের সামনে পৌঁছেছেন। উপাসনা প্রকাশনালয়ের দফতরি ধরল— ‘এই যে বাবু, আপনি তো সেই একশ কপি বই নিলেন, তারপর তো আর দেখাও করলেন না, বই তো বাঁধা আছে আরও একশ কপি। তার দাম পেলাম না। আমার গুদামে জায়গা নেই বাবু, কাল-পরশুর মধ্যে দাম না পেলে আমি কিন্তু সব বেচে-বুচে দাম উসুল করে নেব।’

‘বঙ্গশ্রী’ পত্রিকা অফিসের সামনে উচ্চকণ্ঠে কথা বলছিল দফতরি, তারাশঙ্কর বাবু হয়তো কিছু বোঝানোর চেষ্টা করছিলেন। যাদের কাছে বই জমা দিয়েছিলেন তাদের কাছ থেকে টাকা আদায়ের চেষ্টা করছেন। সজনীবাবু চেঁচামেচি শুনে বেরিয়ে এলেন। বেরিয়ে এসে দফতরির কথাবার্তা শুনে সব বুঝলেন। সজনীবাবু তখন পথের পাঁচালী ও আরও কিছু বই ছেপে প্রতিষ্ঠিত প্রকাশক। উনি দফতরিকে থামতে বললেন— শোন, আজ থেকে ও বই আমার। তুমি আমাকে বাদবাকি সব বই বেঁধে দেবে। আগের বিল ও নতুন যা বিল সব দাম আমার কাছ থেকে নেবে।

সাহিত্য ভুবনে পশ্চিমবঙ্গের প্রকাশকরা সুদীর্ঘকাল ধরেই ভালো ভালো কবি-সাহিত্যিক সৃষ্টিতে একটি অবিস্মরণীয় ভূমিকা রেখে চলেছেন। এখনো সে ধারা অব্যাহত আছে। এ কারণেই আনন্দ, মিত্র অ্যান্ড ঘোষ, দে’জসহ আরও বহু প্রকাশনী বর্তমানে এক একটি প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে। তাদের আয়-রোজগারও বিস্ময়কর! কয়েকটা দৃষ্টান্ত দিচ্ছি।

‘শনিবারের চিঠি’র সম্পাদক সজনীকান্ত দাসের কথা তো আগেই উল্লেখ করেছি। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পথের পাঁচালী তখন সবেমাত্র বিচিত্রা পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে বেরুচ্ছে। হঠাৎ একদিন সজনীকান্ত দাস খোঁজখবর নিয়ে বিভূতি বাবুর কাছে এসে উপস্থিত। নব্বইটি টাকা তার হাতে গুঁজে দিয়ে বললেন— এটা আপাতত রাখুন ‘পথের পাঁচালী’ বই আকারে আমি ছাপব। অবাক হয়ে গেলেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। ন-ব্ব-ই-টা-কা!! এ যে কল্পনাতীত!!।

সমরেশ মজুমদারের ‘উত্তরাধিকার’ উপন্যাসটি ছাপিয়েছিলেন মিত্র অ্যান্ড ঘোষের গজেন্দ্র কুমার মিত্র। ছাপা হওয়ার পর বইটি বিক্রি হলো মোটামুটি ভালোই। বইটি যারা পড়েছেন তারা জানেন এর একটি বৃহৎ অংশজুড়ে আছে কমিউনিস্ট আন্দোলন। তো হয়েছে কী, সমরেশ মজুমদারের সঙ্গে কমিউনিস্ট নেতা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সঙ্গে একদিন দেখা। তিনি সমরেশ মজুমদারের কাছে বইটি সম্পর্কে উচ্চ প্রশংসা করলেন এবং এও বললেন, যদি সমরেশ মজুমদার বইয়ের ভূমিকায় বইটি কমিউনিস্ট আন্দোলনের মুখপত্র কিংবা এ জাতীয় কিছু কথা লিখে দেন তাহলে তিনি পার্টি ফান্ড থেকে বইটি পঞ্চাশ হাজার কপি কিনে নেবেন। সমরেশ মজুমদার তো খুশিতে গদগদ হয়ে প্রকাশক গজেন্দ্র কুমার মিত্রকে কথাটা জানালেন। গজেন্দ্র বাবু সমরেশ মজুমদারকে বোঝালেন এটা করা মোটেও উচিত হবে না। তখন দেখা যাবে শুধু যারা কমিউনিস্ট পার্টি করে তারাই বইটি কিনছে। সাধারণ পাঠক হয়তো এ বইটি আর ছোঁবেও না। কয়েক লাখ টাকা রয়্যালিটি থেকে বঞ্চিত হলেন বলে সেদিন সমরেশ মজুমদার অনেক রুষ্ট হয়েছিলেন। তাত্ক্ষণিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল মিত্র অ্যান্ড ঘোষ প্রকাশনীটিও। কারণ বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কথামতো কাজ করলে নগদে বেশকিছু অর্থযোগ ঘটত নিঃসন্দেহে। কিন্তু গজেন্দ্র বাবু ছিলেন বিচক্ষণ প্রকাশক। এ পর্যন্ত উত্তরাধিকার উপন্যাসখানা বিক্রি হয়েছে প্রায় দুই লাখ কপিরও বেশি। আনন্দ পাবলিশার্স যে কীভাবে পাহাড়, অরণ্য কিংবা দুর্গম অঞ্চল থেকে সুন্দর সুন্দর সুবাসিত ফুল তুলে এনে সাহিত্য অঙ্গনের ডালা সাজায় তার একটি জাজ্বল্যমান উদাহরণ হচ্ছে বাংলা ভাষার জনপ্রিয়তম লেখিকা তিলোত্তমা মজুমদার। আনন্দ পাবলিশার্স তাকে কীভাবে একজন সফল লেখিকা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিল সে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিলোত্তমা মজুমদার লিখেছেন— ‘সেটা ছিল ২০০০ সাল। এক হেমন্তের দুপুরে একটি পোস্টকার্ড এলো আমার নামে। সল্ট লেকের একটি মহিলা আবাসনে থাকতাম তখন। জীবনের বহু জটিল বাঁক পেরিয়ে, নানা অসার্থক সিদ্ধান্তের ফলাফলে আমি তখন একা, ধ্বস্ত, কপর্দকহীন। অতীত নিয়ে ভাবতে চাই না, ভবিষ্যৎ সম্পূর্ণ নিরালোক। কে আমাকে চিঠি লিখবে? জগতে ব্যর্থ নিঃসম্বল মানুষের খবর রাখে অতি অল্পজন। তবু আমার চিঠি এলো। পড়ে আমি বড় বিচলিত হয়ে ওঠলাম। আগের বছর একটি অখ্যাত পত্রিকার শারদ সংখ্যায় আমার একটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছিল। ‘মানুষশাবকের কথা’ নামে সেই উপন্যাসখানা আনন্দ পাবলিশার্স গ্রন্থাকারে প্রকাশ করতে চায়, এ কথা চিঠিতে লেখা ছিল। বলা হয়েছিল, আমি যদি আগ্রহী হই তবে যেন প্রকাশনার দফতরে শ্রীবাদল বসুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করি।’

উপরোক্ত ঘটনাটি থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় আনন্দ পাবলিশার্সের মতো প্রকাশনীগুলো প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে ছাপা হওয়া অখ্যাত সব সাহিত্য পত্রিকাগুলোও খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়েন যাতে করে প্রকৃত ভালো লেখকদের তুলে আনা যায়। বাংলাদেশের প্রকাশনী সংস্থাগুলোকেও নিতে হবে এ ধরনের যুগান্তকারী পদক্ষেপ। শুধু মুনাফার কথা চিন্তা করলেই হবে না। বই ছাপিয়ে যদি শুধু অর্থপ্রাপ্তির কথা মাথায় থাকে তাহলে তো সোনা কিংবা হীরার ব্যবসা করাই ভালো। সৃজনশীল ব্যবসায় কেন? লেখাটি শেষ করছি ছোট্ট একটি ঘটনা বলে। অ্যালেন লেন নামক এক ইংরেজ একদিন ইংল্যান্ডের প্লেমাউথ অঞ্চলটির কাছাকাছি এক্সিটার নামক রেলস্টেশনে পড়ার জন্য ভালো কোনো বই খুঁজে না পেয়ে সিদ্ধান্ত নিলেন  যে তিনি নিজেই একটি প্রকাশনা সংস্থা খুলে প্রকাশ করবেন ভালো ভালো লেখকের বই। আর এভাবেই ১৯৩৫ সালে জন্ম হলো পেঙ্গুইন বুকস নামে আজকের বিখ্যাত প্রকাশনালয়টির। কথা হচ্ছে উদ্দেশ্য যদি সৎ হয় তবে সাফল্য একদিন না একদিন আসবেই।

লেখক : গল্পকার ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী।

ই-মেইল :  [email protected]

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর