শিরোনাম
শনিবার, ২৭ জানুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

রড থাকতে ডাকসুর কী কাজ?

মোস্তফা কামাল

রড থাকতে ডাকসুর কী কাজ?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কি ছয় মাসের মধ্যে ডাকসু নির্বাচন দেবে? এ সময়ের মধ্যে ডাকসু নির্বাচনের উদ্যোগ না নিলেই বা কী হবে? এ দুই প্রশ্নের এক কথায় জবাব নেই কারও কাছেই। তবে কিছুটা জবাব লুকানো রয়েছে ‘বাঙালকে হাই কোর্ট দেখিয়ে লাভ নেই’— বহু পুরনো সেই প্রবাদে। নানান ঘটনায় প্রবাদটি বাংলা মুলুকে তার হালনাগাদ সক্ষমতা অটুট রেখে চলেছে। চিন্তার দূষণের উদাহরণ হিসেবে থাকছে জীবন্ত হয়ে।

ডাকসু নির্বাচনের ব্যাপারে হাই কোর্টের নির্দেশ তো এলো মাত্র সেদিন। নির্দেশে বলা হয়েছে ছয় মাসের মধ্যে উদ্যোগ নিতে। এর বছরখানেক আগে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫০তম সমাবর্তনে আর দেরি না করে ডাকসু নির্বাচনের কড়া তাগিদ দিয়েছেন স্বয়ং দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ। বক্তব্যের ঝাঁজে কড়া হাততালি পড়েছে। সেদিন তার মন্তব্য ছিল : ‘ডাকসু ইলেকশন ইজ মাস্ট, নইলে ভবিষ্যৎ নেতৃত্বশূন্য হয়ে যাবে।’

রাষ্ট্রপতির এমন মন্তব্য উচিত কথা হিসেবে চড়া প্রশংসা পায়। এর আগে-পরে ডাকসু নির্বাচনের ব্যাপারে আরও রসকষ মেশানো আবৃত্তিভরা তাগিদ দিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, হেভিওয়েট মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। দেরি না করে নগদে প্রতিক্রিয়া দেন তখনকার ভিসি প্রফেসর আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক। সঙ্গে ‘ই’ প্রত্যয় যোগ করে তিনি বলেছেন, ‘শিগগিরই’ ডাকসু নির্বাচনের উদ্যোগ নেওয়া হবে।

শিগগির কাকে বলে? শব্দটির কী অর্থ, উদাহরণ? কত দিনে শিগগির হয়? এসব প্রশ্নের জবাব হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে ডাকসু নির্বাচন আকাঙ্ক্ষীরা। ঢাকাসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে কত ঘটনা ঘটছে। একটার তোড়ে আরেকটা চাপা পড়ছে। আচার্যের নির্দেশের পরও আশ্চর্য রকমের কোনো তৎপরতা দেখা যায়নি। হুকুম তামিল না করায় আচার্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে তলব করেননি। ভর্ত্সনাও নয়।

এর মধ্যেই আদালতি হুকুম। এক আদালতে ডিসিসি নির্বাচনে স্থগিতাদেশ। আরেক আদালতে ছয় মাসের মধ্যে ডাকসু নির্বাচনের নির্দেশ। তাগিদাদেশ আর স্থগিতাদেশ দুই কিসিমের আদেশ-নিষেধ দিব্যি বিনা পানিতেই গিলে হজম করে ফেলছেন সামর্থ্যবানরা। এ ধরনের বিষয়কে আদালত পর্যন্ত টেনে নিয়ে কাউকে বোকা বানানোর দক্ষতার প্রমাণ মিলছে। চালাকির জয় হচ্ছে। কেউ কেউ অভিনয়ের পাকনামির স্বাক্ষরও রাখছেন। সেই সঙ্গে অতিচালাকি কিন্তু গোপন থাকছে না। প্রাণিসম্পদ বিভাগের দাবিমতে, দেশে গরু-ছাগলের সংখ্যা বাড়ছে। তাই বলে স্বাভাবিক বিষয়কে অস্বাভাবিক করে আদালতি ঘটনায় নিয়ে ঠেকানোর সংস্কৃতি কিসের সংখ্যা বাড়াচ্ছে? এর কুশীলবরা দেশের সব মানুষকে সেই পালেই মনে করার ইজারাও পেয়ে গেছেন?

ডাকসু নির্বাচনের ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় অন্যতম পক্ষ। আদালতের সরাসরি নির্দেশনা এই পক্ষকেই। এই পক্ষের মূল ব্যক্তি বা অভিভাবক ভিসি। এ পদে ভারপ্রাপ্তের ভারবাহী অধ্যাপক ড. আখতারুজ্জামান ডাকসুর ব্যাপারে কী চান? কী তার মানসিকতা? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সাতটি কলেজ ইস্যুতে আন্দোলনের ২৩ জানুয়ারির পর্বে তা মোটামুটি বুঝিয়ে দিয়েছেন তিনি। জানিয়ে দিয়েছেন চিন্তার সীমা কত দূর?

তার ডাকে ছাত্রলীগ এসে পেটাল আন্দোলনরত নিরীহ, আধমরা বাম ছাত্রদের। ছাত্রীরাও বাদ গেল না। তারা বিচার চাইতে গেল প্রাতিষ্ঠানিক অভিভাবক প্রক্টরের কাছে। তিনি নিপীড়িত হয়ে যারা বিচার চাইতে গেল তাদের বিরুদ্ধেই মামলার বন্দোবস্ত করলেন। এরপর ভিসির কাছে বিচার চাইতে গেল তারা। সেখানে উপরিমার। এর আগেই ভিসি গেটে তালা দিয়ে দিলেন। তালা ভেঙে শিক্ষার্থীরা ভিসির রুমের দরজার সামনে অবস্থান নেন। ভিসির সঙ্গে কথা বলে বিচার পাওয়ার আশায় স্লোগান দেন। রটিয়ে দেওয়া হলো এই কমজুরিরাই ভিসিকে বন্দী করে ফেলেছে। অবস্থা বড় বেগতিক।

ভিসি নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা রক্ষায় প্যারা সিকিউরিটি ফোর্সের মতো শরণাপন্ন হলেন ছাত্রলীগের কাছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তৈরি হলো নতুন ইতিহাস। ছাত্রলীগের কাছে নিরাপত্তা ও আনুগত্যের পরীক্ষায় তিনি গোল্ডেন জিপিএ পেয়েছেন। কিন্তু ছাত্রলীগকে কী দিলেন? বদনামের পাল্লায় সেরের ওপর সোয়া সের। তাদের দিয়ে রডবাজি ছাত্রদের ওপর। আবার পেটালেন। ছাত্রীদের কিল-ঘুষি-লাথি মারালেন। বেশ কটি টেলিভিশনে সেই চিত্র প্রচারিত হয়েছে। টিভি ফুটেজের কয়েক ক্লিপে যদ্দুর দেখা গেছে তাতে ঘটনাস্থল থেকে দেখা জরুরি নয় কী সব কাণ্ড করেছে ছাত্রলীগ। সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, ধর্ষণসহ নানা কদাকার অভিযোগে ছাত্রলীগের এমনিতেই নানা  কলঙ্কের মালগাড়ির মতো অবস্থা। এর ওপর নতুন বছরে দিয়েছে রড উপহার। অথবা তাদের মাধ্যমে তা দেওয়ানো হয়েছে। হলসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সবকিছুতে একক কর্তৃত্বের ক্ষমতা অনেক দিন থেকেই ছাত্রলীগের কব্জায়।

ছাত্রদলকে তারা ক্যাম্পাস-আউট করে ছেড়েছে আগের ভিসি আরেফিন সিদ্দিকের আমলের শুরুতেই। বলা হয়, তিনি ছাত্রলীগকে এত দিয়েছেন পরের ভিসির জন্য দান-অনুদানের মতো তেমন কিছু বাকি রেখে যাননি। ক্যাম্পাসসহ আশপাশে রড, ইট, সিমেন্টের সব কাজ ছাত্রলীগই করে। এর পরও বাড়তি রড না দিয়ে ছাত্রলীগকে ডাকসুতে জেতার উপযুক্ত করে তোলার ভার নিতে পারতেন ভারপ্রাপ্ত ভিসি আখতারুজ্জামান। সেই পথে যাননি তিনি। এর চেয়ে বরং রডের ব্যবহার বাড়িয়েছেন। ছাত্রলীগকে রডবাহিনীতে নামিয়েছেন। ছাত্রলীগের এ অপকর্মকে আবার বৈধতা দিলেন ওবায়দুল কাদের। নিজে ডাকসুতে না জিতলেও তার বেড়ে ওঠা ছাত্র রাজনীতির মাধ্যমেই। সেই তিনিই বললেন, ভিসিকে উদ্ধারে যাওয়া ছিল ছাত্রলীগের দায়িত্ব। এ মন্তব্যের ব্যাখ্যায় বলেছেন, নইলে ভিসির ওপর হামলা হতে পারত।

এ ধরনের কাণ্ড ও কথায় জন্ম দেওয়া হয়েছে নানা প্রশ্নের। হামলার শঙ্কা করলে ভিসি পুলিশের শরণাপন্ন হতেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বা আইজিপিকে ফোন করতে পারতেন। আস্থা থাকলে সহকর্মী শিক্ষকদের সহায়তা চাইতে পারতেন। আর কিছু না হোক ৯৯৯ নম্বরে একটা কল দিতে পারতেন। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলতে পারতেন। নিপীড়ক কয়েকজন ছাত্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সাহস দেখাতেন। তা না করে তিনি স্তরে স্তরে তালা দিয়ে ভিতরে বসে থাকলেন। ভিসি বলছেন তার ওপর হামলা হতে পারত শঙ্কার কথা। আর ছাত্রলীগ বলেছে ভিসিকে ঘুষি মারা হয়েছে। কোথায় গিয়ে ঠেকলেন ভিসি নিজে? কোথায় নিয়ে ঠেকালেন ছাত্রলীগকে?

ইতিহাস বলে, ডাকসু থাকলে এ ধরনের ঘটনার জন্মই হতে পারত না। অথবা হলেও ডাকসু নেতারা তার ফয়সালা দিতে পারতেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ অনেক বাঁক বদলের শরিক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই যুগের বেশি সময় ছাত্র সংসদ নির্বাচন নেই। মাঝেমধ্যে এ নিয়ে টুকটাক আওয়াজ হয়। পরে তা তলিয়ে যায় অন্য ঘটনায়। দেশের প্রতিটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকারি কলেজের অবস্থা প্রায় একই। কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছাই এসব ছাত্র সংসদের নির্বাচনে মুখ্য। যোগ্য, দক্ষ নতুন নেতৃত্ব তৈরিতে দরকার ছাত্র সংসদ নির্বাচন। তা না থাকায় রাজনৈতিক দলগুলোয় মানসম্পন্ন নেতৃত্বের অভাব লুকানো-ছাপানোর বিষয় নয়। ষাট, সত্তর এমনকি আশির দশকের তারকা নেতাদের অনেকের জন্ম বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদে জিতে বা হেরে। কিন্তু দলগুলোয় এমনকি ওই নেতাদের কারও কারও মধ্যেও রহস্যজনক কারণে এই উপলব্ধিতে বেশ কৃপণতা। তাদের বোধ ও দাবি জোরালো হলে এর একটা বিহিত অবশ্যই হতে পারত।

ডাকসু বা দেশে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীনদের ইচ্ছাই মুখ্য। স্বৈরাচার নামে প্রচারিত-প্রতিষ্ঠিত এরশাদ আমলেও ডাকসু, রাকসু, জাকসুসহ দেশের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় প্রতিযোগিতামুখর নির্বাচন হয়েছে। সেখানকার হারা-জেতা বহু প্রডাক্টই এখন রাজনীতিতে তারকা। অথচ এরশাদ পতনের পর গণতান্ত্রিক সরকারগুলো সব কটি ছাত্র সংসদ নির্বাচন আটকে দিয়েছে। মাঝেমধ্যে তারা এ নিয়ে দু-চার কথা বললেও কথার সঙ্গে কাজের বড় ফারাক। একেবারেই উল্টো। বরং ডাকসুসহ ছাত্র সংসদের মাধ্যমে পাকাপোক্ত হয়ে নতুন নেতৃত্বের আগমন আশঙ্কায় কেউ ভীত, কেউ বিরক্ত। আর কেউ বা ঈর্ষাকাতর। স্বার্থগতভাবে কেমন যেন একাট্টা সব দলের ‘তাহারা, উহারা’। এমনকি সাবেক ডাকসু নেতাদের কেউ কেউও। শিক্ষকরা পারলে আরেকটু এগিয়ে। ডাকসু বা ছাত্র সংসদ নির্বাচন দাবি করলে তারা বেজার হন। তেড়ে আসেন। ছাত্রদের ঘুষানও। কিন্তু নিজেরা রাজনীতির নামে সুবিধা হাসিল একরত্তিও বাদ দেন না। তাদের শিক্ষক সমিতির নির্বাচন হয় ঠিকমতোই।

সিনেট নির্বাচনও হলো কদিন আগে। সব দিকের দলবাজ শিক্ষকের কাছে ডাকসু আপদের। তাদের চলমান একতরফা কর্তৃত্বের পথে হুমকির। এই ফাঁকা মাঠে তারাই বিভিন্ন মূল দল বা সরকারের খাস খাদেম হতে চান। আর ছাত্র সংগঠনগুলোকে চান তাদের রডবাহিনী হিসেবে। আর রডের বিকল্প হিসেবে বাঁশ প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেছে আরও আগেই।

লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।

 

 

সর্বশেষ খবর