শিরোনাম
শনিবার, ২৭ জানুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা
বায়তুল মোকাররমের খুতবা

মুসলিম ভ্রাতৃত্ববোধের গুরুত্ব ও অপরিহার্যতা

মাওলানা মো. এহসানুল হক, পেশ ইমাম : বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদ

আমরা মুসলিম জাতি। আমাদের ধর্ম ও জীবনবিধান হলো আল ইসলাম। মহান আল্লাহর প্রিয় ধর্ম ইসলাম। ইসলাম বিশ্বভ্রাতৃত্ব বোধ ও মুসলিম ভ্রাতৃত্ববোধের শিক্ষা দেয়। বিশ্বভ্রাতৃত্ব বোধের ধারণা এমন যে, হজরত আদম (আ.) সব মানুষের আদি পিতা আর হজরত হাওয়া (আ.) সব মানুষের আদি মাতা। তাদের দুজন থেকে সব মানুষের বংশানুক্রমিক দুনিয়ায় আগমন। সুতরাং মানুষ ভাই ভাই এই শিক্ষা ইসলামের, এই চেতনা মুসলিমের। মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে লোকসকল! আমি তোমাদের সৃষ্টি করেছি এক পুরুষ ও এক নারী থেকে। পরে তোমাদের বিভক্ত করেছি বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে; যাতে তোমরা একে অন্যের সঙ্গে পরিচিত হতে পারো। তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সে-ই অধিক মর্যাদাসম্পন্ন, যে তোমাদের মধ্যে অধিক মুত্তাকি।’ (সূরা হুজুরাত : ১৩)।

আল্লাহ আরও বলেছেন, ‘হে লোকসকল! তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে ভয় কর, যিনি তোমাদের এক ব্যক্তি থেকেই সৃষ্টি করেছেন এবং যিনি তা থেকে তার স্ত্রী সৃষ্টি করেছেন আর তাদের দুজন থেকে বহু নর-নারী ছড়িয়ে দেন।’ (সূরা নিসা : ১)। ইসলামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো মুসলিম ভ্রাতৃত্ববোধ। সব মুসলিম ভাই ভাই— এ চিন্তা ও চেতনা মুসলমানের অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য। মহান আল্লাহ ও তাঁর প্রিয় রসুল হজরত মুহাম্মদ (সা.) মুসলিম ভ্রাতৃত্ববোধকে প্রতিটি মুসলমানের জন্য অপরিহার্য করে দিয়েছেন। আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই মুমিনরা পরস্পর ভাই ভাই। সুতরাং ভাইদের মধ্যে শান্তি স্থাপন কর আর আল্লাহকে ভয় কর, যাতে তোমরা অনুগ্রহপ্রাপ্ত হও।’ (হুজুরাত : ১০)। মুসলিম ভ্রাতৃত্ববোধের চেতনা বিশ্ব মুসলিম ঐক্যের অন্যতম প্রধান প্রেরণা। জীবনের সার্বিক সাফল্যের জন্য বিশ্ব মুসলিম ঐক্য অনিবার্য। বিশ্ব মুসলিমকে ভ্রাতৃত্ববোধে উজ্জীবিত করা আল্লাহর বড় নিয়ামত ও অনুগ্রহ। আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা সবাই আল্লাহর রশি দৃঢ়ভাবে ধর এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হইও না। তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ স্মরণ কর তোমরা ছিলে পরস্পর শত্রু এবং তিনি তোমাদের হৃদয়ে প্রীতির সঞ্চার করেছেন। ফলে তাঁর অনুগ্রহে তোমরা পরস্পর ভাই হয়ে গেছো।’ (সূরা আলে ইমরান : ১০৩)।

আমাদের প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) জীবনভর তাঁর সাহাবিদের পরস্পর ভাই ভাই হয়ে থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। পরবর্তী প্রজন্মের প্রতি এ নির্দেশ পৌঁছানো জরুরি বলে ঘোষণা করেছেন। রসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা সন্দেহ পোষণ করা থেকে নিজেদের রক্ষা কর, সন্দেহ পোষণ বেশির ভাগ মিথ্যায় পর্যবসিত হয়। তোমরা পরস্পর ছিদ্র অন্বেষণ করবে না, অন্যের দোষ খুঁজে বেড়াবে না, দালালি করবে না, হিংসা পোষণ করবে না, ঘৃণা পোষণ করবে না এবং পরস্পর সম্পর্ক ছিন্ন করবে না বরং আল্লাহর বান্দারূপে পরস্পর ভাই ভাই হয়ে থাকবে।’ (বুখারি, মুসলিম, মিশকাত)।

ভ্রাতৃত্ববোধে উৎসাহিত করে প্রিয় নবী (সা.) বলেছেন, ‘এক মুসলমান অন্য মুসলমানের ভাই। সে তার ভাইয়ের প্রতি জুলুম করবে না; তাকে লাঞ্ছিত করবে না এবং তাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য ও খাটো করবে না।’ তিনি বলেছেন, ‘একজন মানুষের মন্দলোক হওয়ার জন্য এটুকুই যথেষ্ট যে, সে তার মুসলিম ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলা বন্ধ রাখে।’ (মুসলিম, মিশকাত)। শবেবরাতের বরকত থেকে যারা বঞ্চিত হয়, তাদের একজন হলো সেই ব্যক্তি, যে তার মুসলিম ভাইয়ের সঙ্গে তিন দিনের বেশি কথা বলা বন্ধ রাখে।

মুসলিম ভ্রাতৃত্ববোধ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে রসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘এক মুমিনের ওপর অন্য মুমিনের ছয়টি দাবি রয়েছে। অসুস্থ হলে দেখতে যাবে, মারা গেলে জানাজায় উপস্থিত হবে, ডাকলে সাড়া দেবে, দেখা হলে সালাম দেবে, হাঁচি দিলে জবাব দেবে, উপস্থিত থাকুক কিংবা অনুপস্থিত সর্বদা তার কল্যাণ কামনা করবে।’ (মিশকাত)।

হাদিসে এসেছে, এক ব্যক্তি একদিন তার একজন ভাইয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য পথে বের হলো। ওই ভাই বসবাস করত ভিন্ন গ্রামে। এ সময় আল্লাহ একজন ফেরেশতা পাঠালেন মানুষের আকৃতি দিয়ে; ফেরেশতা তাকে বলল, আপনি কোথায় যাচ্ছেন? সে বলল, ওই গ্রামে যাচ্ছি আমার এক ভাইয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য। ফেরেশতা বলল, তার সঙ্গে কি আপনার কোনো দেনা-পাওনা আছে, যার তথ্য জানার জন্য যাচ্ছেন? সে বলল, তা নয়; বরং আমি তাকে আল্লাহর ওয়াস্তে ভালোবাসি। অতঃপর ফেরেশতা বলল, আমি আল্লাহর পক্ষ থেকে এই সুসংবাদ জানানোর জন্য এসেছি যে, আপনি যেমন আল্লাহর ওয়াস্তে ওই সম্পর্ক চলমান রেখেছেন, মহান আল্লাহও তেমনি আপনার সঙ্গে তার নিজের সম্পর্ক চলমান রেখেছেন। (মুসলিম, মিশকাত)।

মুসলিম ভ্রাতৃত্ববোধের অন্যতম দাবি হলো একজন মুসলমান কখনো অন্য মুসলমানের মানহানি করবে না; বরং অন্য কেউ তার মানহানি করতে গেলে তা প্রতিহত করবে। রসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, কোনো মুসলমানের সামনে অন্য মুসলমানের গিবত ও দুর্নাম করা হলে ওই মুসলমানের যদি তা প্রতিহত করার ক্ষমতা থাকে গিবতকারীকে প্রতিহত করার মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্তকে সাহায্য করে, তাহলে আল্লাহ আখিরাতে তাকে সাহায্য করবেন। আর যদি ক্ষতিগ্রস্তকে সাহায্য করার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তাকে সাহায্য না করে তবে আল্লাহ তাকে দুনিয়া ও আখিরাতে এ রকম দুর্নাম ও গিবতযোগ্য হওয়ার ব্যবস্থা করে দেবেন। (কোরআন সুন্নাহ-মিশকাত)। আল্লাহ আমাদের সবাইকে সর্বান্তকরণে মুসলিম ভ্রাতৃত্ববোধের গুরুত্ব ও অপরিহার্যতা অনুধাবন ও জীবনে বাস্তবায়ন করার তাওফিক দিন।

 খুতবা লেখক : ড. সৈয়দ এমদাদউদ্দিন, খতিব, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদ

 

সর্বশেষ খবর