সোমবার, ২৯ জানুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে ষড়যন্ত্রের লক্ষণ

মেজর জেনারেল একে মোহাম্মাদ আলী শিকদার পিএসসি (অব.)

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে ষড়যন্ত্রের লক্ষণ

১৬ জানুয়ারি মিয়ানমার-বাংলাদেশের মধ্যে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের জন্য ফিজিক্যাল অ্যারেঞ্জমেন্ট চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ২৩ জানুয়ারি প্রথম ৩০০ জনের একটি দল ফেরত যাওয়ার দিন নির্ধারিত থাকলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। এর মধ্যেই ষড়যন্ত্রের লক্ষণ শুধু নীরবে নয়, সরবে শুরু হয়ে গেছে। ২১ জানুয়ারি বাংলাদেশের একটি প্রধান দৈনিকের প্রধান শিরোনাম ছিল— ‘রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নস্যাৎকরতে বহুমুখী ষড়যন্ত্র’।  গত ১৯ জানুয়ারি মো. ইউসুফ নামের এক রোহিঙ্গা নেতা, যিনি ফিরে যাওয়ার পক্ষে কাজ করছিলেন তাকে বালুখালী ক্যাম্পের ভিতরেই মুখোশধারী একটি চক্র গুলি করে হত্যা করে। পত্রিকায় খবর এসেছে, রোহিঙ্গারা যাতে ফেরত না যায় তার জন্যও ২০টি এনজিও সক্রিয়ভাবে কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ভিতরে কাজ করছে। জানা যায়, এসব এনজিওর কর্মকাণ্ড সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে বন্ধ ঘোষণা করা সত্ত্বেও তারা পুরোদমে তাদের কর্মতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। এটা কী করে সম্ভব হচ্ছে তা এক বিরাট প্রশ্ন।

এতে বোঝা যায়, ষড়যন্ত্রের নেটওয়ার্ক কত শক্তিশালী ও বিস্তৃত। এর মধ্যে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ভিতর থেকে একটি বিদেশি পিস্তলসহ একজন রোহিঙ্গাকে গ্রেফতার করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। পেছনে ফিরে একটু বিশ্লেষণের দৃষ্টিতে তাকালে দেখা যাবে এই যে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও অপতৎপরতা এখন প্রকাশ্যে দেখা যাচ্ছে, এটা কোনো বিচ্ছিন্ন বা নতুন ঘটনা নয়। নিজ নিজ হীন রাজনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ উদ্ধারের জন্য দেশের ভিতর থেকে এবং দেশের বাইরে থেকে অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে এসব অপতৎপরতা চালানো হচ্ছে। গত বছর ২৫ আগস্ট থেকে শুরু হওয়া এবারের মতো মিয়ানমার কর্তৃক রোহিঙ্গা বিতাড়নের প্রেক্ষাপট এবং তার অব্যবহিত পর বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ একটি পক্ষের অবস্থান ও কথাবার্তা লক্ষ্য করলেই বুঝতে বাকি থাকে না এই ষড়যন্ত্রের পেছনে কারা কাজ করছে এবং কেন করছে। এটা এখন সবাই জানেন দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত রোহিঙ্গা সমস্যাটির একটা স্থায়ী সমাধানের পথে সর্বজনগ্রাহ্য কফি আনান কমিশনের প্রতিবেদন একটা সম্ভাবনাময় প্রেক্ষাপট তৈরির প্রাক্কালেই কীভাবে সেটিকে অকার্যকর ও ভণ্ডুল করে দেওয়ার চেষ্টা করে রোহিঙ্গাপ্রসূত সশস্ত্র সংগঠন আরসা বাহিনী। একইভাবে বাংলাদেশ-মিয়ানমারের মধ্যে সম্প্রতি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন চুক্তি স্বাক্ষরের পরের দিনই ওই আরসা বাহিনী আবারও বিচ্ছিন্নভাবে সশস্ত্র তৎপরতা চালানোর চেষ্টা করে। এটা তো সহজেই বোঝা যায়, রোহিঙ্গাদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখার মতো সক্ষমতা আরসা বাহিনীর নেই এবং ভবিষ্যতেও তা হবে না। তারা অপতৎপরতায় লিপ্ত হচ্ছে শুধু তাদের পৃষ্ঠপোষকদের অঙ্গুলি হেলনে, সমস্যাটি জিইয়ে রাখার জন্য। বেলজিয়ামভিত্তিক ক্রাইসিস গ্রুপের প্রতিবেদন পড়লে সবাই জানবেন ২০১৩ সালে জন্ম নেওয়া আরসা বাহিনীর মূল পরিচালক পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই এবং আর্থিক সমর্থন পাচ্ছে সৌদি আরবের কিছু সংস্থা থেকে। ২৫ আগস্টের ঘটনার পর আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় এই মর্মে খবর বের হয় যে, কফি আনান কমিশনের প্রতিবেদনকে বানচাল করার জন্য পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই আরসা বাহিনীকে দিয়ে মিয়ানমার সেনাক্যাম্পের ওপর আক্রমণ চালায়। সাম্প্রতিক সময়েরও বহু আগে থেকে পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা রোহিঙ্গা সশস্ত্র গ্রুপগুলোকে সব রকমের পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে আসছে। ২০১৬ সালের ১২ মে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ভিতরে অবস্থিত বাংলাদেশের আনসার ক্যাম্প আক্রমণ করে রোহিঙ্গাদের পুরনো গ্রুপ আরএসও (রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন)। আক্রমণকারীরা আনসার কমান্ডার আলী হোসেনকে হত্যা করে এবং ১১টি অস্ত্র লুট করে নিয়ে যায়। এই আক্রমণে নেতৃত্ব দেয় পাকিস্তানের একজন নাগরিক, যিনি পরবর্তীতে গ্রেফতার হয়ে এখন বাংলাদেশের জেলে আছে। গত শতকের আশির দশকের মাঝামাঝিতে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের তত্ত্বাবধানে আরএসও পাকিস্তানের করাচিতে অফিস স্থাপন করে, যা এখনো কার্যকর বলে জানা যায়। পাকিস্তানি লেখক হোসেন হাক্কানি তার লিখিত ‘পাকিস্তান বিটুইন মস্ক অ্যান্ড মিলিটারি’ গ্রন্থে এসবের উল্লেখ করেছেন। পাকিস্তান আপাতত দু-তিনটি লক্ষ্যসহ আরেকটি চূড়ান্ত লক্ষ্যকে সামনে রেখে রোহিঙ্গা সমস্যাটিকে জিইয়ে রাখার চেষ্টা করছে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ জঙ্গি তৎপরতার সঙ্গে পাকিস্তান সরাসরি জড়িত, এ বিষয়ে নতুন করে তথ্য উত্থাপনের প্রয়োজন নেই। ঢাকাস্থ তাদের দূতাবাসের দুজন কর্মকর্তা জঙ্গি তৎপরতায় জড়িত থাকার কারণে পাকিস্তানে ফেরত যেতে বাধ্য হয়েছে। তবে তাতে তাদের তৎপরতা বন্ধ হয়ে গেছে, এমনটি ভাবার কারণ নেই। তাই রোহিঙ্গা সমস্যাটি চলমান থাকলে এনজিওসহ অন্যান্য ভায়া-মিডিয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ জঙ্গিদের জন্য অর্থ ও অস্ত্র সহযোগিতা প্রদানের অতিরিক্ত একটি চ্যানেল তা হলে খোলা থাকে।

দ্বিতীয়ত, সার্ক অকার্যকর হওয়ায় আঞ্চলিকভাবে বিচ্ছিন্ন রাষ্ট্রে পরিণত হওয়া ঠেকাতে পাকিস্তানের প্রয়োজন ইঈওগ এবং ইওগঝঞঊঈ-এর অগ্রগতি ঠেকিয়ে রাখা, যা সম্ভব হবে যদি রোহিঙ্গা সমস্যাটি প্রলম্বিত হয়। তৃতীয় কারণটি হলো, বাংলাদেশে বর্তমান ক্ষমতাসীন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকারকে রাজনৈতিক সংকটে ফেলা এবং জনপ্রিয়তা নষ্ট করা, যাতে ২০১৮ সালের নির্বাচনে তারা পুনরায় ক্ষমতায় আসতে না পারে। পাকিস্তানের চূড়ান্ত লক্ষ্যটিই তাদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং এই লক্ষ্যকে অর্জন করার জন্যই উপরে উল্লিখিত তিনটি লক্ষ্য তাদের অর্জন করা দরকার। আর এই চূড়ান্ত লক্ষ্যটি হলো, বাংলাদেশে ২০০১-২০০৬ মেয়াদের সরকারের মতো আরেকটি সহায়ক পরিবেশ যদি তাদের জন্য আবার সৃষ্টি হয় তাহলে আগের মতো ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোতে সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সহযোগিতা প্রদান ও পরিচালনার জন্য সহায়ক উপাদান হিসেবে কাজ করবে রোহিঙ্গাপ্রসূত সশস্ত্র সংগঠনগুলো। বহির্দেশীয় ষড়যন্ত্র আছে। এই আজন্ম পুরনো শত্রু আমাদের অজানা নয়, চিনতেও অসুবিধা হয় না। কিন্তু দেশের ভিতর থেকে বহুরূপী ও ছদ্মবেশী ষড়যন্ত্রকারীদের সম্পর্কে আরও বেশি সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। কারণ, কথায় আছে ঘরের শত্রু বিভীষণ। ২৫ আগস্টের পর যখন হাজার হাজার রোহিঙ্গা দলে দলে প্রতিদিন বাংলাদেশে প্রবেশ করছে তখন বড় একটি রাজনৈতিক পক্ষ ও তাদের সমর্থক বুদ্ধিজীবীদের কথা এবং সভা-সেমিনারে তাদের বক্তব্য শুনে মনে হয়েছে মিয়ানমারের সঙ্গে যুদ্ধ ঘোষণা ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প বোধহয় নেই। শুরুর দিকে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে উগ্র ধর্মান্ধ গোষ্ঠী সাহায্য বিতরণের ছদ্মবেশে ক্যাম্পের ভিতরে ঢুকে রোহিঙ্গা যুবকদের জিহাদি মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ করতে থাকে। ওই বড় রাজনৈতিক দলের সাবেক এক এমপি ও অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা তো পত্রিকায় কলাম লিখে রোহিঙ্গা যুবকদের জিহাদে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানালেন।

যারা এসব বলছেন তারা এর পরিণতি না বুঝে বলেছেন সেটি কখনই আমার কাছে মনে হয়নি। মিয়ানমার সেনাশাসকদের পক্ষ থেকে উসকানি তো স্পষ্টতই লক্ষ্য করা গেছে এবং তার সঙ্গে বাংলাদেশের এই পক্ষের উত্তেজনাকর উসকানিতে বাংলাদেশ পা দিলে ভয়ঙ্কর এক পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো, যার পরিণতিতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশ চিহ্নিত হতো আগ্রাসী দেশ হিসেবে। যার দায় ও ভার বহন করা আমাদের পক্ষে কিছুতেই সম্ভব হতো না। বাংলাদেশের ওই পক্ষ তখন আন্তর্জাতিকভাবে সর্বজনগ্রাহ্য কফি আনান কমিশনের প্রতিবেদনকে শুভঙ্করের ফাঁকি হিসেবে উল্লেখ করে রোহিঙ্গাদের উসকে দেওয়ার চেষ্টা করেছে। যেমনটি করেছে আরসা বাহিনী। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ধীরস্থির দূরদৃষ্টিসম্পন্ন রাষ্ট্রনায়কোচিত পদক্ষেপের কারণে দেশি-বিদেশি সব পক্ষের ষড়যন্ত্র তখন ব্যর্থ হয়েছে। জাতিসংঘসহ বিশ্ব জনমত বাংলাদেশের অবস্থানকে সমর্থন করেছে। ফলে মিয়ানমারের সামরিক শাসকদের আন্তরিকতা ও সদিচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরে বাধ্য হয়েছে। দুই দেশের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নিয়ে ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠিত হয়েছে। মাঠ পর্যায়ে প্রত্যাবাসনের কাজ করার জন্য ফিজিক্যাল অ্যারেঞ্জমেন্ট চুক্তি মিয়ানমার স্বাক্ষর করেছে। এই সমঝোতা ও চুক্তির মাধ্যমে ১০ লাখ রোহিঙ্গা কত দিনে, কত বছরে নিজ ভূমিতে ফেরত যেতে পারবে সে ব্যাপারে প্রবল সন্দেহ থাকলেও একটি বিষয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তা হলো মিয়ানমার আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করে নিল, তাদের নাগরিকরা জীবনের নিরাপত্তার অভাবে অবৈধভাবে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে বাধ্য হয়েছে, যার দায় মিয়ানমার সরকারকেও বহন করতে হবে। রোহিঙ্গা সমস্যাটি বহু পুরনো ও দীর্ঘদিনের। বাংলাদেশ এর সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে ১৯৭৮ সাল থেকে, প্রায় ৩৯ বছর। স্থায়ী সমাধানের কোনো পথ এ পর্যন্ত বের হয়নি। বরং মিয়ানমারের সামরিক শাসকদের ভ্রান্তনীতি, বাংলাদেশের উগ্র ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর উন্মাদনা, সঙ্গে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইর অপতৎপরতা এবং আন্তর্জাতিক জিহাদিতন্ত্রের বিরূপ প্রভাব, সব মিলে সমস্যাটিকে দিনকে দিন আরও জটিল করে ফেলেছে। কিন্তু ২০১৭ সালে এসে বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতির সমীকরণের জায়গা থেকে এ সমস্যাটির সমাধানে চীনের ভূমিকাই মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভূ-রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতায় চীনকে দুই কূলই রক্ষা করতে হবে। এটা চীন জানে ও বোঝে। কিন্তু কাজটি অত্যন্ত কঠিন।  এই কঠিন কাজটির প্রাথমিক প্রক্রিয়াটি শুরু হতেই দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীরা সেটিকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করে দেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে।  তারই বহিঃপ্রকাশ দেখা যাচ্ছে, যে কথা লেখার শুরুতেই উল্লেখ করেছি।

লেখক : কলামিস্ট ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক, নিউ অরলিনস, ইউএসএ।

[email protected]

সর্বশেষ খবর