বৃহস্পতিবার, ১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

অনেক বৈতরণী পার হয়ে এসেছি আমরা

আবু হেনা

অনেক বৈতরণী পার হয়ে এসেছি আমরা

স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশ ৪৮ বছরে পা রাখতে চলেছে। পেছনে ফেলে গেল ৪৭ বছরের অনেক বিচিত্র অবিস্মরণীয় ঘটনা, সংঘাত, সংঘর্ষ আর সমঝোতার কাহিনী। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে সমতা, সামাজিক ন্যায়বিচার আর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার নিয়ে যে দেশটি পৃথিবীর মানচিত্রে স্থান করে নিয়েছিল, তা এই দীর্ঘ পরিক্রমায় ক্ষমতার লড়াইয়ে একটি কুরুক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। একাত্তরের মুক্তি-সংগ্রামের মূল চালিকাশক্তি ছিল এ দেশের জনগণের জন্য এক মহৎ, সমৃদ্ধ ও কল্যাণময় জীবনকে বাস্তব রূপ দেওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা। এ দেশের স্বাধীনতা-সংগ্রামের লক্ষ্য ছিল এক ঐক্যবদ্ধ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সমাজ গড়ে তোলা। এই স্বপ্নের রূপায়ণের পথে এবং প্রত্যাশা পূরণের প্রক্রিয়ায় যেমন জনগণের সমর্থন এসেছে তেমনি বাধা এবং প্রতিবন্ধকতাও এসেছে অনেক। তারপরও অনেক অর্জন সম্ভব হয়েছে। কিন্তু এই অর্জনকে ধরে রাখতে হলে এবং তাকে আরও ত্বরান্বিত করতে হলে সব স্বপ্ন আর প্রত্যাশাকে সুবিন্যস্তভাবে সাজিয়ে অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে সব প্রতিবন্ধকতাকে চিহ্নিত করতে হবে। সব সমস্যা সমাধানের কার্যকর সুচিন্তিত পন্থা নির্ণয় করতে হবে। আগামীতে আমরা কেমন বাংলাদেশ দেখতে চাই তার উত্তর এক এবং অভিন্ন। আমরা সবাই চাই এমন একটি গণতান্ত্রিক পরিবেশ যেখানে এ দেশের সব মানুষ শান্তি আর সমৃদ্ধিতে জীবন অতিবাহিত করবে। এর জন্য প্রয়োজন একটি স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক, প্রতিনিধিত্বশীল, জননির্ভর সক্রিয় অংশীদারিত্বের গণতান্ত্রিক রাজনীতি।

দীর্ঘ সময় ধরে একটি তাৎপর্যময়, সুশৃঙ্খল এবং সমৃদ্ধ জনজীবনের আবহ সৃষ্টি করা এবং সব নাগরিকের সম্ভাবনার পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটাতে যেমন অবিরাম প্রচেষ্টা চলেছে তেমনি একে প্রতিহত করারও ঘৃণ্য চক্রান্ত চলেছে একইভাবে। এরই ধারাবাহিকতায় স্বপ্নদ্রষ্টা মহান নেতৃত্বের যেমন বিকাশ ঘটেছে তেমনি স্বার্থান্বেষী ক্ষুদ্র মনের দুষ্টগ্রহেরও উত্থান হয়েছে। সে কারণেই বিগত ৪৭ বছরে কখনো কখনো যেমন জাতীয় মূল্যবোধ আর আশা-আকাঙ্ক্ষার, জাতীয় জীবনে প্রতিফলন ঘটেছে, তেমনি এরই পাশাপাশি মাথাচাড়া দিয়েছে অন্তরায়গুলো। যা জাতীয় জীবনে এনেছে ব্যর্থতা, বিশৃঙ্খলা। ইতিহাস সাক্ষী, বাংলাদেশের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের ভিত রচনা করেছিল খাঁটি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রবল আকাঙ্ক্ষা। পাকিস্তান রাষ্ট্রে যে কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠী গণতন্ত্রকে শৃঙ্খলিত করেছিল এবং বাংলাদেশকে একটি উপনিবেশে পরিণত করেছিল তার বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে নেমেছিল এ দেশের মানুষ। ফলে গণতন্ত্রের ভিত্তিতে রচিত একটি রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থা নির্মাণের স্বপ্ন নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের অভিযাত্রা শুরু হয়। কিন্তু সেই স্বপ্ন আজ দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে। এর কারণ একটিই ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্বৈরশাসন।

১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর দীর্ঘ চার বছর এ দেশে নিরবচ্ছিন্নভাবে চলেছিল রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, সংঘর্ষ, হানাহানি যা জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর শক্তি হরণ করে দেশকে অবক্ষয়ের দিকে ঠেলে দিয়েছিল। চলেছিল বিভিন্ন পন্থায় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের উন্মত্ত প্রতিযোগিতা। ফলশ্রুতিতে ১৯৭৫ এর একদলীয় বাকশালী শাসন এবং রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সপরিবারে নিহত হওয়ার দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা। এ সময় সুস্থ রাজনীতি এবং গণতন্ত্র উভয়ই পথভ্রষ্ট হয়ে পড়ে। স্বাধীনতা যুদ্ধে রাজনৈতিক নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগে সৃষ্টি হয় অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলের একটি দুষ্ট বলয়। এ বলয়টি একদিনে নয়, দীর্ঘ চার বছর ধরে নিম্নচাপের মতো সৃষ্টি করে ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ মহাবিপদ সংকেতের সূচনা করেছিল। এই ঘূর্ণিঝড়ে আওয়ামী লীগের প্রাসাদটি ভেঙে পড়েছিল। খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে গড়ে উঠেছিল আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী জান্তা, যারা বঙ্গবন্ধুর মৃতদেহকে ৩২ নম্বরের বাড়ির সিঁড়িতে ফেলে রেখে শুধু ক্ষমতা গ্রহণই করেনি, সামরিক শাসনও জারি করেছিল। খন্দকার মোশতাক হেলিকপ্টার যোগে তার ছবি এবং টুপির নকশা প্রতি জেলায় অফিস-আদালতে পাঠিয়ে দিয়েছিল। এরপর ৩ নভেম্বর খালেদ মোশাররফের ক্ষমতা গ্রহণ এবং বিচারপতি সায়েমের রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ, জাতীয় চার নেতাকে কারাগারে হত্যা এবং তারপরই কর্নেল তাহেরের গণবাহিনীর নেতৃত্বে সিপাহি-জনতার বিপ্লব এবং জিয়াউর রহমানের রাষ্ট্রীয় প্রশাসনে প্রবেশ। সে সময়ের ঘটনাপ্রবাহ প্রত্যক্ষ করলে দেখা যায়, বিচারপতি সায়েমের এক বছর শাসনের পর ২৮ নভেম্বর ১৯৭৬ সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমানের কাছে রাষ্ট্রপতি এবং প্রধান সামরিক আইন প্রশাসনের দায়িত্ব হস্তান্তর করেন। পরবর্তী ছ’বছরের জিয়ার শাসনামলে বাংলাদেশের জনগণ ফিরে পায় তাদের হারিয়ে যাওয়া বহুদলীয় গণতন্ত্র। সরাসরি নির্বাচনে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি এবং জাতীয় সংসদ। একটি সুশৃঙ্খল, শক্তিশালী সশস্ত্র বাহিনী হিসেবে গড়ে ওঠে বাংলাদেশ সামরিক বাহিনী।

প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সময় রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রক্রিয়া ছিল সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক। এই নির্বাচনে সব রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করে। এতে ১১ জন প্রার্থী নির্বাচনের জন্য মনোনয়নপত্র জমা দেন। এই নির্বাচনে অপর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল (অব.) এম এ জি ওসমানী। তিনি ছিলেন ‘গণতান্ত্রিক ঐক্যজোটের’ মনোনীত প্রার্থী। আওয়ামী লীগ, সিপিবি, জাতীয় জনতা পার্টি, ন্যাপ (মোজাফফর), গণআজাদী লীগ মিলে এই জোট তৈরি করে। নির্বাচনে ৭৬.৩৩ ভাগ ভোট পেয়ে জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। জেনারেল ওসমানী ২১.৭০ ভাগ ভোট পান। ২৯ জুন ১৯৭৮ তিনি মসিউর রহমান যাদু মিয়াকে সিনিয়র মিনিস্টার করে মন্ত্রিসভা গঠন করেন। তারপর ১ সেপ্টেম্বর একটি সংবাদ সম্মেলনে জিয়াউর রহমান দলের প্রধান হিসেবে নতুন দল বিএনপির গঠনতন্ত্র ও কর্মসূচি ঘোষণা করেন। দ্রুতগতিতে জাতীয় ঐক্য আরও সুসংগঠিত করা ও জাতীয় কর্মসূচিকে বাস্তবায়িত করার লক্ষ্যে এই উন্মুক্ত জাতীয়তাবাদী দল গঠন করা হয়। এ সময় ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটি আওয়ামী লীগের সমার্থক হয়ে যাওয়ায় তদস্থলে ডান-বাম সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ‘জিন্দাবাদ’ স্লোগানটি প্রচলিত হয়। ‘জিন্দাবাদ’ একটি ফারসি শব্দ। ব্রিটিশ-ভারতে বিপ্লবীরা শব্দটি ব্যবহার করতেন।

এ সময়ে আরেকটি বিতর্ক মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। বাংলাদেশের জাতীয়তা ‘বাঙালি’ না ‘বাংলাদেশি’ হবে এ নিয়ে সমাজে বিভক্তি শুরু হয়। এ বিতর্কেরও শুরু ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ বঙ্গবন্ধুর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ভাষণ থেকে—‘আমি বাঙালি, আমি মানুষ, আমি মুসলমান।... বাংলাদেশ এখন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র।’ তাঁর এই বক্তব্যে তিনি স্পষ্টই জাতীয়তাবাদের বহুমাত্রিক দিকের প্রতি ঈঙ্গিত করেছিলেন। তা ছাড়া বাংলাদেশে অনেক জাতিসত্তা আছে, যারা নিজেদের বাঙালি বলে পরিচয় দিতে অস্বীকৃতি জানায়। এসব কারণেই জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের নাগরিকের জাতিগত পরিচয় ‘বাংলাদেশি’ হিসেবে নির্ধারণ করেন। এ প্রসঙ্গে ১৯৬৬ সালের আগস্ট-সেপ্টেম্বর কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত ‘পূর্ববঙ্গের সমস্যা’ নামে নিরোদচন্দ্র চৌধুরীর একটি প্রবন্ধের উদ্ধৃতি সঙ্গতিপূর্ণ : ‘ধরিয়াই লওয়া যাক যে, পূর্ববঙ্গের রাজনৈতিক ও সামরিক শক্তি এতটুকু আছে যে, উহার পক্ষে স্বাধীন হওয়া সম্ভব। যদি স্বাধীন হয়ই, তাহা হইলে স্বাধীন বাঙালি মুসলমান কি পশ্চিমবঙ্গের হিন্দুর সহিত যুক্ত হইবে? বর্তমান অবস্থায় যুক্ত হইবার অর্থ শুধু পশ্চিমবঙ্গের সহিত যুক্ত হওয়া নয়, ভারতবর্ষেরও অন্তর্ভুক্ত হওয়া। ইহার স্পষ্ট উত্তর কখনো নয়। পাকিস্তানের সহিত বিযুক্ত হইয়া পশ্চিমবঙ্গের সহিত ভারতভুক্ত হইবার কোনো আগ্রহ পূর্ববঙ্গের মুসলমানের নাই, এবং হইতে পারে না।’

“এই উদ্দেশ্য বাঙালি মুসলমানের বিশিষ্ট জীবনযাত্রা ও সংস্কৃতি বজায় রাখিয়া উহার বিকাশ সাধন। এই উদ্দেশ্যের পথে পাকিস্তান হইতে পূর্ববঙ্গের যে বিপদের সম্ভাবনা দেখা দিয়াছে, তাহার অপেক্ষা অনেক বেশি বিপদের আশঙ্কা ভারতবর্ষ হইতে।

জিয়াউর রহমানের মতে ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ’ হলো সার্বিক জাতীয়তাবাদ। অপরদিকে ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’ এ দেশের মানুষের জাতিসত্তার খণ্ডিত পরিচয় বহন করে। ২৬ নভেম্বর ১৯৭৫ জিয়াউর রহমানের উপদেষ্টা পরিষদে যোগ দেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আবুল ফজল, বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ প্রফেসর এম এন হুদা, বুয়েটের সাবেক উপাচার্য এম এ রশীদ, সাবেক মন্ত্রী কাজী আনোয়ারুল হক, বারডেমের প্রতিষ্ঠাতা ডা. মুহম্মদ ইব্রাহীম, রাঙামাটির রাজমাতা বিনীতা রায়, আকবর কবির, সাইফুর রহমান। পরবর্তীতে যোগ দেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য মুহম্মদ শামসউল হক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান এবং অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ। একই সঙ্গে তিনি বিচারপতি আবদুস সাত্তারকে উপ-রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দেন। তার শাসনামলে জাতীয় সংসদ এবং মন্ত্রিসভায় দেশবরেণ্য রাজনীতিবিদদের মহামিলন ঘটেছিল। তিনি মসিউর রহমান যাদু মিয়াকে সিনিয়র মন্ত্রী করে প্রথম মন্ত্রিসভা গঠন করেন। মন্ত্রিপরিষদে ছিলেন কাজী জাফর, প্রফেসর ইউসুফ আলী, মির্জা গোলাম হাফিজ, এস এ বারী এটি, শাহ আজিজুর রহমান, আবদুস হালিম চৌধুরী, এ কে এম ওবায়দুর রহমান, মওদুদ আহমদ, এনায়েতুল্লাহ খান, বি এম আব্বাস এ টি। পরবর্তীতে সংসদ নির্বাচন হলে শাহ আজিজুর রহমান প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন এবং আসাদুজ্জামান খান বিরোধীদলীয় নেতা নির্বাচিত হন। প্রফেসর বি. চৌধুরী বিএনপি মহাসচিব নিযুক্ত হওয়ায় মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন। এই মন্ত্রিসভায় নির্দলীয় সদস্য ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী শামসউল হক, পরিকল্পনামন্ত্রী ড. ফসিহ উদ্দিন মাহতাব, কৃষিমন্ত্রী মেজর জেনারেল (অব.) নূরুল ইসলাম, শিল্পমন্ত্রী শফিউল আযম এবং বিএনপিতে নানা পেশার নানা মতের মানুষের সমাবেশ ঘটেছিল। তাদের মধ্যে ছিলেন সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তা, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, আইনজীবী, শিল্পপতি ও ব্যবসায়ী। ছিলেন অনেক বিরোধীদলীয় নেতা। মুজিবনগরে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠকারী অধ্যাপক ইউসুফ আলী এবং রিয়াজুদ্দীন আহমদ (ভোলা মিয়া)  আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী ছিলেন, তারাও জিয়ার মন্ত্রিসভায় যোগ দেন।

জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে দুটি অভিযোগ ছিল—তিনি স্বাধীনতা বিরোধীদের রাজনীতিতে পুনর্বাসন করেছেন। এ ছাড়া জনমনে একটা সরলীকৃত ধারণা ছিল আওয়ামী লীগ ভারতপন্থি এবং বিএনপি ভারতবিরোধী। ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হওয়ার পর একমাত্র কাদের সিদ্দিকীই তার কিছু তরুণকে নিয়ে দেশত্যাগ করে ময়মনসিংহ জেলার সীমান্তবর্তী এলাকায় বিচ্ছিন্ন সশস্ত্র কর্মকাণ্ড চালান। তার বাহিনীর নাম ছিল ‘জাতীয় মুক্তিবাহিনী’। ভারতের দেশাই সরকারের সঙ্গে জিয়া সরকারের সম্পর্কের উন্নতি ঘটে। তারপর ভারত সরকার জাতীয় মুক্তিবাহিনীকে সহায়তা দেওয়া বন্ধ করে। জিয়ার সময় গঙ্গার পানিবণ্টন নিয়ে জটিলতার অবসান হয় এবং ১৯৭৭ সালে পাঁচ বছরের জন্য একটি চুক্তি হয়। এরপর ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়ে যায়। এরশাদ শাসনামলে বাংলাদেশের দুই শীর্ষ রাজনৈতিক নেতা বেগম খালেদা জিয়া এবং শেখ হাসিনার আবির্ভাব ঘটে। তাদের দুজনের মিলিত প্রয়াসেই এরশাদ শাসনের অবসান ঘটে। ২৮ অক্টোবর ১৯৮৭ এ দুই নেতার অত্যন্ত অন্তরঙ্গ পরিবেশে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর তারা একটি ইশতেহারও প্রকাশ করেন। ১৯৯০ সালে এরশাদবিরোধী আন্দোলন জোরদার হয়ে উঠলে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আটদলীয় জোট, বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে সাতদলীয় জোট এবং পাঁচদলীয় বামপন্থি দল সমঝোতার ভিত্তিতে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদ ৬ ডিসেম্বর উপ-রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন এবং তারপর এরশাদ নবনিযুক্ত ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগপত্র জমা দেন।

বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে এ সময়টি ছিল অভূতপূর্ব ঐক্যের মহিমায় মহিমান্বিত। এ সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পেশাজীবীদের সংগঠন প্রকৃচি এবং আইনজীবী ঐক্য পরিষদের ভূমিকা ছিল অনন্য সাধারণ। এ সময় শিক্ষক সমিতির আহ্বানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষক একযোগে পদত্যাগের ঘোষণা দেন। ১৯৯০ সালে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল ডাকসু নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয় পায়, আমানউল্লাহ আমান ভিপি এবং খায়রুল কবির খোকন জিএস নির্বাচিত হন। একই সময় রাকসুর ডিপি নির্বাচিত হন রিজভী আহমেদ। এতে প্রমাণিত হয় বিএনপি একটি জনপ্রিয় দল। এসবের প্রতিফলন ঘটেছিল পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে। এই নির্বাচনে বিএনপি সংসদে ১৪০টি আসন পায় এবং বেগম জিয়ার নেতৃত্বে সংসদীয় পদ্ধতিতে সরকার গঠিত হয়। ৬ অক্টোবর আবদুর রহমান বিশ্বাস রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হলে বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদ সাহেব আগের সমঝোতা অনুযায়ী তার পূর্ববর্তী পদে ফিরে যান। তিনি ছুটি নিয়ে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯০-’৯১-এর এসব সংবিধান বহির্ভূত কার্যকলাপ প্রমাণ করে সংবিধানের ভিতরে এবং বাইরে জনগণই রাষ্ট্র। এ সময়ে দেশের বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবী, ছাত্র শিক্ষক, শ্রমিক-জনতার অভূতপূর্ব ঐক্য ছিল একটি অভাবনীয় নিদর্শন।

১৯৯১ সংসদ নির্বাচনে জামায়াত ছিল বিএনপির কৌশলগত মিত্র। কিন্তু গোলাম আযমের নাগরিকত্ব নিয়ে যে জটিলতা সৃষ্টি হলো, তাতে দলটি বিএনপির বিপক্ষে এবং আওয়ামী লীগের পক্ষে অবস্থান নিল। ১৯৯৪ সালের ২৭ জুন আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি এবং জামায়াতে ইসলামী এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদের নির্বাচনের রূপরেখা ঘোষণা করেন। এখান থেকেই অনৈক্য এবং সংকটের শুরু। তিন দলের রূপরেখায় বলা হয়, ‘একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে রাষ্ট্রপতি সংসদ ভেঙে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করবেন।’ ২৮ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগ, জামায়াতে ইসলামী, বাকশাল, ন্যাপ (মোজাফফর), এনডিপির সদস্যরা পদত্যাগ করেন। তারপর ৪১৬ ঘণ্টার হরতাল, জনতার মঞ্চ, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আন্দোলনের ফসল হিসেবে ২৬ মার্চ ১৯৯৬ গভীর রাতে ষষ্ঠ জাতীয় সংসদে ত্রয়োদশ সংশোধনী বিল পাসের মাধ্যমে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা গৃহীত হয়। তারপর আওয়ামী লীগের সার্টিফিকেট নিয়ে জামায়াত অবশেষে ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধ হলেও শীর্ষ নেতাদের হারিয়ে আজ নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত দলের তালিকা থেকে বাদ পড়েছে। ২০০৮ এবং ২০১৪ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ এখন চালকের আসনে। আওয়ামী লীগ নেত্রী এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আর সংসদ ভেঙে দিয়ে পদত্যাগে আগ্রহী নন। ৩০ মে ২০১১ তিনি জানিয়ে দেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা রাখার আর সুযোগ নেই। ওয়েস্ট মিনস্টার ব্যবস্থায় যেভাবে নির্বাচিত সরকারের মেয়াদ শেষ হয়, সেভাবেই দল চলবে।’ ২০১১ জাতীয় সংসদে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাস হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ৪১৬ দিনের হরতালের বিনিময়ে অর্জিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার অবসান ঘটেছে। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামীর জোটবদ্ধ সংসদীয় আসন ছিল ১৮৮ (মহিলা আসনসহ)। ২০০১ এর নির্বাচনে বিএনপির নেতৃত্বে চারদলীয় জোট ২১৭ আসনে জয়ী হয়েছিল। এ দুই দল বিগত ১২ বছর ক্ষমতার বাইরে। জামায়াত-বিএনপির জোট ভাঙতে গিয়ে আওয়ামী লীগ জামায়াতকে নেতৃত্বহীন করেছে। বিএনপির দুই শীর্ষ নেতা বেগম খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমান অসংখ্য মামলার আসামি। আজ আইন, প্রতিষ্ঠান, নীতি, বিধি, রীতি মহাশক্তিধরদের হাতে জিম্মি। ক্ষমতা যে জীবনের মতোই নশ্বর, তার চেয়েও স্বল্পস্থায়ী—এ কথা শাসককুল প্রায়ই বিস্মৃত হয়েছে।

বিখ্যাত ঐতিহাসিক গিবনস তার রোমান সাম্রাজ্যের উত্থান ও পতনগ্রন্থে একটি রোমান প্রথার উল্লেখ করেছেন। যখন কোনো রোমান বিজয়ী সেনাপতি বিজয় রথের মিছিল নিয়ে রাজপথে চলত তখন একজন দাসী তার পেছনে দাঁড়িয়ে মাঝে মাঝে আলতোভাবে তার পিঠে আঙ্গুল ছোঁয়াত এবং মৃদুস্বরে তার কানে কানে বলত, ‘ক্ষমতা ও ঐশ্বর্য ক্ষণস্থায়ী’। উত্ফুল্ল জনতার উল্লসিত বিজয়ধ্বনী দাসীর কণ্ঠস্বর ছাপিয়ে গেলেও তার কথাগুলো বিজয়ী সেনাপতির কানে ঠিকই পৌঁছে যেত। আজ এই জীবনমুখী বাস্তবতার কথা শাসকদের সামনে উচ্চারণ করার সাধ্য কারও নেই। এরই মধ্যে সাধারণ মানুষ আজ চরম হতাশায় হাবুডুবু খাচ্ছে। কেউ জানে না, ওদের ভাগ্যে এ বছর কী আছে। আশাহত জনতার এখন অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। শেষ কথা সাঁই লালনের, ‘এসো দয়াল, পার করো ভবের হাটে।’

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য।

সর্বশেষ খবর