বৃহস্পতিবার, ১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

কী এমন ক্ষতি হতো, আমাকে সংসদ অধিবেশন দেখতে দিলে?

মো. আনিসুজ্জামান খোকন

কী এমন ক্ষতি হতো, আমাকে সংসদ অধিবেশন দেখতে দিলে?

জাতীয় সংসদের অধিবেশন দেখতে ২৩ জানুয়ারি মঙ্গলবার সন্ধ্যায় গিয়েছিলাম সংসদ ভবনে। আজ থেকে প্রায় ৪০ বছর আগে জনগণের ভোটে কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলাম সাবেক আইন ও সংসদ বিষয়ক এবং অর্থমন্ত্রী বাবু মনোরঞ্জন ধরকে হারিয়ে। তাই সংসদ অধিবেশন দেখার সব সময় একটা আগ্রহ এবং কৌতূহল থাকে। সাবেক সংসদ সদস্য হিসেবে পার্লামেন্টেন্স ক্লাবের আজীবন সদস্য কার্ড দেখিয়ে সংসদ ভবনে প্রবেশের অনুমতি পেলেও সংসদ অধিবেশন দেখার জন্য প্রয়োজনীয় দর্শানার্থী কার্ড সংগ্রহ করতে ধরনা দিলাম সেবা শাখায়। ওরা বিনয়ের সঙ্গে সার্জেন্টস অ্যাট আর্মস্ অফিসে যোগাযোগ করতে বললেন। ষষ্ঠতলায় সেই অফিসে গেলে কর্তব্যরত সামরিক কর্মকর্তা অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে এ ব্যাপারে তার অপারগতার কথা জানিয়ে তার অধস্তন ডেপুটি সার্জেন্টস অ্যাট আর্মস (অপারেশন) অফিসে যাওয়ার জন্য পরামর্শ দিয়ে একজন সহকারীকে আমার সঙ্গে পাঠালেন, প্রথম তলায় সেই অফিসে আমাকে নিয়ে গেলেন সেই অমায়িক সহকারী। ডেপুটি সার্জেন্ট অফিসারের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন স্যার আপনার কাছে ওনাকে পাঠিয়েছেন একটা দর্শনার্থী পাস দেওয়া যায়  কিনা। ডেপুটি সার্জেন্ট অফিসে তখন আরও দুজন পুলিশ কর্মকর্তা কথা বলছিলেন। আমাকে আন্তরিকভাবে বসতে বলে এক কাপ চাও খেতে দিলেন। ডেপুটি সার্জেন্ট অ্যাট আর্মস (অপারেশন) এর টেবিলে কম্পিউটার মনিটরে সংসদ অধিবেশনের লাইভ ভিডিও দেখছিলাম। বললাম একটা কোনো পাস কি দেওয়া যায়? তিনি সবিনয়ে বললেন, তিনি কেবল মাত্র রিকুইজিশন অনুযায়ী পাস ইস্যু করে থাকেন। তার নিজের কোনো ক্ষমতা নেই কাউকে পাস দেওয়ার। নতুন বিধিমালা দেখিয়ে বললেন, স্পিকার, সংসদ সচিব, ডেপুটি সচিব, এমপি সাহেবরাই কেবল পাসের রিকুইজেশন দিতে পারেন। সাবেক এমপিদের পাস দেওয়ার কোনোই বিধান নেই। তবে বর্তমান এমপিদের কাছ থেকে পাস নেওয়ার পরামর্শ দিলেন আমাকে। আমি হতাশ হয়ে তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে এলাম।

সংসদ লবিতে দেখা হলো জোট সরকারের মন্ত্রী ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদের সঙ্গে। আমাকে দেখে বিস্মিত হলেন, বললেন গত মাসেই তো তোমার সঙ্গে দেখা হলো আমেরিকার ফ্লোরিডায়, ফোবানা সম্মেলনে, এখন আবার ঢাকায়। ১৯৭৯ সালে আমরা একই দলে একই সঙ্গে এমপি ছিলাম। দুজনের নামের মিল থাকায় তিনি আমাকে দোস্ত বলে সম্বোধন করতেন। সংসদ অধিবেশন চলতে থাকলেও তিনি বিশেষ কাজে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন। সংসদ চত্বরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান কামাল সাহেবের সঙ্গে কথা হলো, বললেন, মনিপুরীপাড়ার বাসিন্দা হিসেবে তিনি আমাকে নান্নুর বন্ধু হিসেবে আগে থেকে চেনেন। নান্নুর আসল নাম কামাল। তিতুমীরের ভিপি ছিল। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহকর্মী, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ৩নং আসামি, পাকিস্তান নৌবাহিনীর কর্মকর্তা সুলতান উদ্দিনের ছোট ভাই। নিউইয়র্ক থেকে প্রচারিত, আমার মালিকানাধীন বহিঃবিশ্বে প্রথম বাংলা টেলিভিশন রূপসী বাংলা টিভির জন্য সাক্ষাৎকার দিতেও রাজি হলেন, বললেন অফিসে যোগাযোগ করতে। আমি সংসদ ভবন থেকে বেরিয়ে গাড়িতে বাড়ি ফিরে আসতে আসতে মনে মনে বললাম কত দর্শনার্থী, এমপি সাহেবদের কর্মী সমর্থক ক্ষমতাসীন দলের নেতানেত্রীরা সংসদ অধিবেশন দেখলেন। ৪০ বছর আগে এই সংসদ ভবন যখন চালু হয় নাখালপাড়া থেকে শেরেবাংলা নগরে আমি সেই উদ্বোধনী দিনে উপস্থিত ছিলাম, সর্বকনিষ্ঠ সংসদ সদস্য হিসেবে। আইয়ুব খানের আমলে আমেরিকার টাকায়, শেরেবাংলা নগরে এই সংসদ ভবনটির অসমাপ্ত কাজ শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়ার, একান্ত প্রচেষ্টায় সম্পন্ন এই সংসদ ভবনটি উদ্বোধন করেছিলেন তারই ভাইস প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আবদুস সাত্তার, জিয়ার মৃত্যুর পর ১৯৮১ সালে। একবার সংসদ ভবনে প্রবেশের সময় একজন পুলিশ কর্মকর্তার কাছে অনুমতি চাইলে তিনি বলেছিলেন, এই সংসদ ভবন তো সংসদ সদস্যদের জন্যই নির্মিত হয়েছে। এখানে আপনারা প্রবেশ করবেন না তো কে করবে? আমরা তো কেবল পাহারাদার আর নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত। কথাটা খুব ভালো লেগেছিল। যে সংসদে তার সাবেক সদস্যদের প্রবেশাধিকার নেই সেই সংসদ কতটুকু প্রাতিষ্ঠানিক? বর্তমান রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ অ্যাডভোকেট যখন স্পিকার ছিলেন তখন তাকে অনুরোধ করেছিলাম সংসদ অধিবেশনে সাবেক এমপিদের জন্য কয়েকটি পাস রিজার্ভ রাখার জন্য। জবাবে তিনি বলেছিলেন সাবেক এমপিদের জন্য পাস রিজার্ভ রাখলে ওনারা যদি কেউ সংসদে না আসেন সেক্ষেত্রে ভিআইপি সিটগুলো খালি পড়ে থাকবে। তার কথায় অবশ্যই যুক্তি রয়েছে। তবে কোনো সাবেক এমপি যদি  আগ্রহ করে তার রাজনৈতিক জীবনের স্মৃতি বিজড়িত সংসদ অধিবেশন দেখতে আসেন সেক্ষেত্রে কীভাবে তিনি একটি পাস পেতে পারেন? এই প্রশ্নের জবাব কারও জানা নেই। কয়েকজন এমপিকেও এই ব্যাপারে অনুরোধ করেছিলাম, সদুত্তর পাইনি। বর্তমান ভোটবিহীন সংসদের আগে বিএনপি যখন বিরোধী দলে ছিল সেই সময় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের চিফ হুইপ বাউফলের এমপি আ স ম ফিরোজকেও এই ব্যাপারে বলেছিলাম। ১৯৭৯-এর সংসদে আমি এবং ফিরোজ দুজনেই কম বয়সী এমপি ছিলাম। কিন্তু তিনিও বিষয়টি নিয়ে খুব একটা গুরুত্ব দেননি। মনে পড়ল সেই পুরনো প্রবাদ ‘গৈটা পুড়ে, গোবর হাসে’ কারণ গোবর জানে না সেও একদিন গৈটা হবে আর আগুনে পুড়বে। জানি না সংসদীয় গণতন্ত্রের ধারক-বাহকরা এই বিষয়টির আদৌ কোনো সুরাহা করবেন কি না?

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য।

সর্বশেষ খবর