সোমবার, ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

বিএনপি ভীত ও আতঙ্কিত হচ্ছে কেন?

মেজর জেনারেল এ কে মোহাম্মাদ আলী শিকদার পিএসসি (অব.)

বিএনপি ভীত ও আতঙ্কিত হচ্ছে কেন?

আজকের বিষয়ের সঙ্গে প্রতীকী ছোট একটা গল্প দিয়ে লেখাটি শুরু করতে চাই। গত শতকের ষাটের দশকের কথা। আমরা তখন মাধ্যমিকে পড়ি। ওই সময়ে গ্রামাঞ্চলে রাস্তাঘাট, আলো-বিদ্যুৎ, টেলিফোন, কিছুই ছিল না। মানুষ এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়ি বা এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে চলাচলের জন্য পায়ে হাঁটতে হাঁটতে যে পথ তৈরি হয়ে যেত, সেটাই হতো সবার চলার অবলম্বন। সন্ধ্যার পরে কুপি-হারিকেন জ্বলত ঘরে ঘরে। তবে কেরোসিনের দাম চড়া থাকায় সূর্য ডোবার পরপরই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব গ্রামের মানুষ রাতের খাবার-দাবার খেয়ে ঘুমিয়ে যেত। তাই একটু রাত নেমে আসতেই সর্বত্র একটা নীরব নিস্তব্ধ পরিবেশ বিরাজ করত। কখনো কখনো বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে বা হাটবাজার থেকে বাড়ি ফিরতে কারও কারও কিছুটা রাত হয়ে যেত। আমার নিজেরও এরকম অভিজ্ঞতা বহুবার হয়েছে। গ্রাম্য পথ ধরে রাতের অন্ধকারে তখন আগে শোনা সব ভূত-প্রেতের কল্পকাহিনী একে একে মনের মধ্যে এসে জড়ো হতো। অজানা ভয়ে, অযথাই মনে হতো এই বোধ হয় আমার পেছনে পেছনে কেউ হাঁটছে। গা ছমছম করত। ভয়ে পেছন ফিরে তাকানোর সাহস পেতাম না। আসলে মনে মনে ভীষণ ভয় পাওয়ার কারণে এমন মনে হতো। তখন বন্ধুদের আড্ডায় নিজেকে সাহসী প্রমাণের জন্য সবাই কম-বেশি ধেড়ে গলায় উচ্চৈঃস্বরে গান গাইত। আমি নিজেও এরকম অনুশীলন করিনি, তা কিন্তু নয়। সবাইকে দেখানো আমি ভয় পাইনি। আসলে ভয় পেয়েছি, উচ্চৈঃস্বরে গান গাওয়াটাই ভয় পাওয়ার লক্ষণ।

বহুকাল পরে কথাগুলো মনে পড়ল সম্প্রতি বিএনপির কিছু কর্মকাণ্ড দেখে। একটা মামলার রায়কে কেন্দ্র করে একটি প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল এত ভীতসন্ত্রস্ত ও আতঙ্কিত হতে পারে তা এর আগে কখনো দেখিনি, ইতিহাসেও পড়িনি। ২০১২ সালের ৮ এপ্রিল সর্বশেষ জাতীয় নির্বাহী কমিটির সভা হওয়ার প্রায় পাঁচ বছর পর গত ৩ ফেব্রুয়ারি পুনরায় অনুষ্ঠিত দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরামে বেগম খালেদা জিয়া যে বক্তৃতা করেছেন, তার প্রায় পুরোটা জুড়েই ছিল আমার গল্পের মতো অজানা ভয়ের বহির্প্রকাশ। তিনি বারবার বলেছেন, ‘আমি কোনো কিছুতে ভয় পাই না, আমাকে ভয় দেখিয়ে লাভ নেই।’ আবার নেতা-কর্মীদের বলেছেন, আপনারা ভয় পাবেন না। জাতীয় নির্বাহী কমিটির সভা নিয়মিত হওয়ার কথা। কিন্তু তা যখন পাঁচ বছর পর হঠাৎ করে একটা মামলার রায়কে সামনে রেখে ডাকা হয় এবং সেখানে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গুরুত্বপূর্ণ কোনো ইস্যু সম্পর্কে কথা না বলে শুধু ভয় না পাওয়ার বক্তৃতা দেওয়া হয় তখন নিশ্চয়ই মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, ভয় না পেলে এত তড়িঘড়ি করে নির্বাহী কমিটির সভা ডেকে সবাইকে কেবল ভয় না পাওয়ার জন্য এত কথা বলার প্রয়োজন হলো কেন। আসলে ভয় না পেলে কাউকে বলার প্রয়োজন হয় না আমি ভয় পাইনি। বেগম খালেদা জিয়ার বক্তৃতায় উল্লেখ করা কয়েকটি বিষয়ের দিকে তাকালে এ ভয় পাওয়ার ব্যাপারটা আরও স্পষ্ট হয়। তিনি বক্তৃতার এক জায়গায় বলেছেন, ‘ভয় নেই বিএনপির সঙ্গে প্রশাসন, পুলিশ, সশস্ত্র বাহিনী আছে। কাজেই বিএনপির কোনো ভয় নেই, ভয়টা আওয়ামী লীগের।’ এতদিন বিএনপি যা বলে  আসছে তার সঙ্গে এ কথার কোনো মিল পাওয়া যায় না। বর্তমান সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনে না যাওয়ার কারণ হিসেবে বিএনপি সবচেয়ে বড় অজুহাত দেখায় প্রশাসন, পুলিশসহ সবাই আওয়ামী লীগের হয়ে গেছে। তাই দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না। সেদিন যা বলছেন, সেটা সত্য হলে বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাওয়া বিএনপির জন্য কোনো সমস্যা নয়, বরং প্লাস পয়েন্ট হবে। মৌলিক কথা হলো প্রশাসন, পুলিশসহ প্রজাতন্ত্রের সব কর্মকর্তা-কর্মচারী জনগণের সেবক। তারা রাষ্ট্রের  সংবিধান ও আইন অনুসারে কাজ করবে, কোনো দলের হয়ে নয়। যদিও বাস্তবে মাঝে মধ্যে সব সরকারের সময়ই আমরা ভিন্ন চিত্র দেখে অভ্যস্ত। কিন্তু একজন দলীয়প্রধান যে দল দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় ছিল, তিনি যখন প্রকাশ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে বলেন, প্রশাসন, পুলিশ, সশস্ত্র বাহিনী সবাই তাদের দলের সঙ্গে আছে তাহলে ব্যাপারটি কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়? এরপর কি ওই দলের পক্ষে দাবি তোলা চলে যে, প্রশাসনকে নিরপেক্ষ করতে হবে। ডাবল স্ট্যান্ডার্ডের আরেকটি উদহারণ সৃষ্টি হলো। আসলে এসব অযৌক্তিক এবং পারস্পরিক বিরোধী কথা বলাই প্রমাণ করে বিএনপি হয়তো সত্যিই ভয় পেয়ে গেছে এবং তার জন্যই জোরেশোরে বলছে আমরা ভয় পাইনি। ভয় পাওয়ার আরেকটি লক্ষণ, বিএনপি মনে করছে বেগম খালেদা জিয়া জেলে থাকলে দল ভেঙে যাবে। এটা এক কথায় দলের অভ্যন্তরীণ ভয়ঙ্কর দুর্বলতা ও ক্ষয়িষ্ণুতারই বহির্প্রকাশ। এ ভয় পাওয়ার জায়গাটিও বেগম খালেদা জিয়ার বক্তৃতায় স্পষ্টভাবে এসেছে। যারা দল ভাঙার ভূমিকা রাখতে পারে তাদের উদ্দেশে তিনি বলেছেন, ‘একবার ক্ষমা করেছি। কিন্তু ক্ষমা বারবার করা যায় না। যারা দলের প্রতি অনুগত থাকবেন, তাদের মূল্যায়ন করা হবে। যারা থাকবেন না, তাদের আর ক্ষমা করা হবে না।’ সম্প্রতি দলের গঠনতন্ত্রের একটি উল্লেখযোগ্য ধারা বাতিল ও বাদ দেওয়ায় বিএনপির ভয় পাওয়ার বিষয়টি আরও বেশি করে ধরা পড়েছে। আগের গঠনতন্ত্রের ৭ নম্বর ধারার ‘ঘ’-তে বলা ছিল, সমাজে দুর্নীতিপরায়ণ ও কুখ্যাত বলে পরিচিত ব্যক্তি বিএনপির সব পর্যায়ের কমিটির সদস্য এবং জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলের প্রার্থী পদের অযোগ্য বলে বিবেচিত হবে। নতুন করে নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া গঠনতন্ত্র থেকে এ ধারাটি বাতিল ও বাদ দেওয়া হয়েছে। এর অর্থ দাঁড়াল, আনুষ্ঠানিকভাবে দলের সংবিধানে নীতি হিসেবে সন্নিবেশিত হলো এখন থেকে দুর্নীতিবাজ ও কুখ্যাত লোকদের জন্য বিএনপির দরজা উন্মুক্ত। এ রকম আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত একটি রাজনৈতিক দল যখন গ্রহণ করে তখন বোঝা যায় দলটি কত বড় সংকটে পড়েছে এবং আতঙ্কের মধ্যে আছে। আর সংকট এতটাই প্রকট যে, চোখ-কান বন্ধ করে দলের নীতিতে বলা হচ্ছে দুর্নীতিবাজ ও কুখ্যাতরা দলে থাকলে কোনো অসুবিধা নেই। মনে হচ্ছে বিএনপির হাতে অন্য কোনো বিকল্প নেই। আসলে এ রকম নেতিবাচক দিকে হেঁটে দল ও নেতা-নেত্রী কোনো কিছুকেই শেষ পর্যন্ত রক্ষা করা বিএনপির জন্য কঠিন হবে। কারণ এ বিশ্বায়নের যুগে শুধু দলীয় অন্ধ সমর্থকদের দ্বারা গণআন্দোলন এবং ক্ষমতায় যাওয়া কোনোটাই সম্ভব হবে না। আলোচ্য সংশোধনী সম্পর্কে বিএনপি নেতারা বলছেন, দলনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে দুর্নীতির মিথ্যা অভিযোগে শাস্তি প্রদান করে সরকার তাদের দল ভাঙার চেষ্টা করছেন এবং তা ঠেকানোর জন্যই সংশোধনীটি আনা হয়েছে। এতে বোঝা যায় জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় বেগম খালেদা জিয়ার সাজা এড়ানোর পক্ষে যৌক্তিক আইনি কোনো উপায় বিএনপির বড় বড় ব্যারিস্টাররা আদালতে উপস্থাপন করতে পারেনি বলেই মামলার রায় ঘোষণার আগেই তড়িঘড়ি করে উপরোক্ত সংশোধনীটি এনেছে। তা না হলে দল ভাঙার যুক্তি ধোপে টিকে না। পাকিস্তান আমল থেকে এ পর্যন্ত আমরা দেখে আসছি রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতা-নেত্রীদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত প্রমাণ ব্যতীত শুধু রাজনৈতিক কারণে হয়রানির জন্য সরকার মামলা করলে এবং শাস্তি প্রদান করলে তাতে সব সময়ই ওই রাজনৈতিক দল এবং নেতা-নেত্রীর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়, রাজনৈতিকভাবে লাভবান হয়। সুতরাং বিএনপির বক্তব্য সঠিক হলে ভয় পাওয়ার তো কোনো কারণ থাকতে পারে না। আর তার জন্য আগ বাড়িয়ে দুর্নীতিবাজ ও কুখ্যাতদের প্রোটেকশন দেওয়ার জন্য দলের গঠনতন্ত্র সংশোধনের প্রয়োজন পড়ে না।

আসলে মুখে যা-ই বলুক, বোঝা যাচ্ছে দলের অভ্যন্তরীণ ক্ষয়িষ্ণুতা নিয়ে বিএনপি এখন মহা চিন্তাগ্রস্ত। বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলাও যে সরকারের সাজানো মিথ্যা মামলা নয়, সেটাও তারা বুঝতে পেরেছে। জানা যায় ১৯৯৩ সালে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট, অর্থাৎ জিয়া এতিমখানার নামে কুয়েত থেকে টাকা আসে। ওই টাকা কোন জায়গায়, কত সংখ্যক এতিমের জন্য, কতদিনে খরচ হয়েছে তার কোনো বিবরণ বিএনপির আইনজীবীরা দিতে পারেননি। কেউ জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের ঠিকানাও বলতে পারেনি। তাতে বোঝা যায়, কাগুজে প্রতিষ্ঠানের নামে টাকা এসে তা হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। গত বৃহস্পতিবার ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় বেগম খালেদা জিয়ার পাঁচ বছরের শাস্তি হয়েছে। তাই আগামীতে দেখার বিষয় বিএনপি কি ভয়কে জয় করে আবার ঘুরে দাঁড়াবে, নাকি এ ভয়ই তাদের দলের জন্য কফিনের শেষ পেরেক হবে।

 

লেখক : কলামিস্ট ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক।

নিউ অরলিনস, ইউএসএ

[email protected]

সর্বশেষ খবর