শনিবার, ১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

বল্লভ ভাই প্যাটেল

ড. নিমচন্দ্র ভৌমিক

বল্লভ ভাই প্যাটেল

ভারতীয় উপমহাদেশের পাঁচ হাজার বছরের সভ্যতার ইতিহাসে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এই গণতান্ত্রিক আন্দোলনে সর্বস্তরের মানুষ অংশগ্রহণ করেছিল। এই আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে ভারতীয় উপমহাদেশ বিভক্ত হয়ে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ধারণ করে কংগ্রেসের নেতৃত্বে ভারত স্বাধীনতা লাভ করে। বিভিন্ন দেশীয় রাজ্যকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করে সূচনাকালে শক্তিশালী ভারত প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং গণতান্ত্রিক সংবিধানের মাধ্যমে ১৯৫০ সালে প্রজাতন্ত্র ঘোষিত হয়। এই দীর্ঘ আন্দোলনে এবং কর্মকাণ্ডে যে কয়েকজন নন্দিত নেতা বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছেন তার মধ্যে অন্যতম হলেন বল্লভ ভাই প্যাটেল। বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী বল্লভ ভাই প্যাটেলের জন্ম ১৮৭৫ সালে এবং মৃত্যু ১৯৫০ সালে। স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহর লাল নেহরু সরকারে তিনি ছিলেন উপপ্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। অল্প বয়সে তার কাজের প্রতি নিষ্ঠা, একাগ্রতা লক্ষ্য করা যায়। তিনি ইংল্যান্ড গিয়েছিলেন বার অ্যাট ল পড়তে। ৩৬ মাসের পাঠক্রম তিনি ৩০ মাসেই সম্পন্ন করতে পেরেছিলেন। ভারতের জাতির জনক মহাত্মা গান্ধীর সংস্পর্শে এসে তিনি কংগ্রেসে যোগদান করেন। তিনি গান্ধীর অহিংসা ও অসহযোগ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। তিনি পশ্চিম ভারতের বিভিন্ন এলাকায় কংগ্রেসকে সংগঠিত করেন এবং প্রায় ৩ লাখ সদস্য সংগ্রহ করেন। তৃণমূলের নেতৃত্ব দিয়ে তিনি ধাপে ধাপে শীর্ষ পর্যায়ে পৌঁছে যান। তার অনন্যসাধারণ গুণাবলির কারণে তিনি শীর্ষ পর্যায়ে পৌঁছতে পেরেছেন। মহাত্মা গান্ধীকে কারাগারে নেওয়া হলে ১৯২৩ সালে ভারতের পতাকা উত্তোলনে ব্রিটিশ সরকারের নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে তিনি সত্যাগ্রহ আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের নেতা হিসেবে তিনি ১৯৩১ সালে কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তিনি দলকে সুসংগঠিত করেন। ১৯৩৪ ও ’৩৭ সালের নির্বাচনের জন্য এবং ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলন বেগবান করার জন্য তিনি প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে আলোচনা করতেন এবং পরামর্শ নিতেন। ১৯৪২ সালে ভারত ছাড় আন্দোলনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। সরদার প্যাটেলসহ অনেক স্বাধীনতাসংগ্রামীকে জেলে যেতে হয়েছিল।

তিনি তিন বছর ছিলেন কারান্তরালে। ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশ বিভক্ত হয়ে ভারত ও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়। তার বিরুদ্ধে দুটি অভিযোগ আছে— একটি হলো ভারত বিভক্তির ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা রাখা এবং মহাত্মা গান্ধীকে এ ব্যাপারে প্রভাবিত করা। মাওলানা আবুল কালাম আজাদ তার ‘ইন্ডিয়া উইনস ফ্রিডম’ বইতেও উল্লেখ করেছেন, বল্লভ ভাই প্যাটেল মহাত্মা গান্ধীর কাছে বার বার গিয়ে ভারত বিভক্তির বিষয়ে নমনীয় করেছিলেন। তার ধারণা ৪০-এর দশকের শেষ দিকে সংঘাত ও সংঘর্ষের রাজনীতি যে পর্যায়ে পৌঁছে তাতে ভারত বিভক্তি অবধারিত। পার্টিশান কাউন্সিলে তিনি ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন এবং নেহরুর নেতৃত্ব মন্ত্রিপরিষদ গঠনের বিষয়টি উত্থাপন করেন। তার সম্পর্কে দ্বিতীয় অভিযোগ কংগ্রেসের ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শের প্রতি তার আস্থার অভাব ছিল। এ ব্যাপারে আমরা দেখতে পাই, অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রণয়নে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন ড. ভিমরাও আম্বেদকর। তিনি তাকে খসড়া কমিটির চেয়ারম্যান নিয়োগে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিলেন। তিনি নিজেও মৌলিক অধিকার, আদিবাসী, উপজাতি, সংখ্যালঘুর অধিকারবিষয়ক কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। আমরা জানি, ১৯৫০ সালের জানুয়ারিতে ভারতকে ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সংবিধানের মাধ্যমে প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করা হয়। পণ্ডিত জওহর লাল নেহরুর নেতৃত্বাধীন সরকার গণপরিষদে এ ব্যাপারে মুখ্য ভূমিকা রাখে। তবে যারা বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছিলেন এর মধ্যে বল্লভ ভাই প্যাটেল অন্যতম। এ ছাড়া ভারত বিভক্তির প্রাক্কালে এবং পরবর্তী সময়ে যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হচ্ছিল তার বিরুদ্ধে তিনি কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন এবং নিজেও দাঙ্গাকবলিত এলাকায় অবস্থান করে প্রতিরোধের ব্যবস্থা নিয়েছিলেন। উপরোক্ত আলোচনা থেকে প্রমাণিত হয়, তিনি নীতিগতভাবে এবং কার্যক্ষেত্রেও ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন, এ ব্যাপারে তার বলিষ্ঠতার প্রমাণ পাওয়া যায়। ভারতের স্বাধীনতার পরপরই ৫৬৫টি দেশীয় রাজ্যের অনেক মহারাজা ও নবাব ভাবতে থাকেন, তারা ব্রিটিশ-পূর্ব ভারতের মতো স্বাধীন প্রশাসক হিসেবে তাদের অঞ্চলে দায়িত্ব পালন করবেন। কিন্তু বল্লভ ভাই প্যাটেলের প্রজ্ঞা ও কূটনীতির পাশাপাশি সামরিক ব্যবস্থা দেশীয় রাজ্যকে ভারতে একীভূত করার ব্যাপারে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখে। দলমতনির্বিশেষে প্যাটেলের এই ভূমিকা সবার কাছে প্রশংসিত, কোনো কোনো বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী নেহরুর সঙ্গে তার দ্বিমত ছিল। পাকিস্তান যখন ১৯৪৭-এ সেপ্টেম্বরে কাশ্মীরে প্রবেশ করে তখন তিনি সেনাবাহিনীকে কাশ্মীরে পাঠানোর পক্ষে ছিলেন। কিন্তু নেহরু রাজি না হওয়ায় তিনি তা স্থগিত রাখেন। পরে কাশ্মীরের রাজা হরি সিং ও মুখ্যমন্ত্রী শেখ আবদুল্লাহর সম্মতিতে সেনাবাহিনী পাঠিয়ে কাশ্মীরের বিরাট অংশ ভারতের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। বিভিন্ন ভাষাভাষী, ধর্মাবলম্বী ও অঞ্চল নিয়ে যে শক্তিশালী গণতান্ত্রিক ভারত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তার প্রাথমিক পর্যায়ে তিনি বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছিলেন। সে কারণে তিনি ভারতের লৌহমানব হিসেবে পরিচিত। স্বাধীনতা-উত্তর ঐক্যবদ্ধ ভারতের তিনি অন্যতম স্থপতি। ১৯৯১ সালে তাকে মরণোত্তর ভারতরত্ন হিসেবে ভূষিত করা হয়।

 

লেখক : শিক্ষাবিদ ও সাবেক রাষ্ট্রদূত।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর