শনিবার, ১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা
বায়তুল মোকাররমের খুতবা

ইসলামের দৃষ্টিতে মাতৃভাষার গুরুত্ব

মুফতি এহসানুল হক
পেশ ইমাম, বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদ

আল্লাহ বিশ্বজগৎ এবং যাবতীয় জীবজন্তু সৃষ্টি করেছেন। তাঁর এই বিশাল সৃষ্টির পেছনে সূক্ষ্ম পরিকল্পনা, নিখুঁত বৈজ্ঞানিক কৌশল ও গভীর তাৎপর্য রয়েছে। ফলে বিশ্বজগতের সবকিছু যথানিয়মে পরিচালিত হচ্ছে। স্রষ্টার ইচ্ছানুযায়ী সৃষ্টি স্ব স্ব সুনির্দিষ্ট পরিণতির দিকে অগ্রসরমান। এ বিশ্বে অসংখ্য সৃষ্টির মধ্যে মানুষ অন্যতম। মানুষ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ বা ‘আশরাফুল মাখলুকাত’। বিশেষ পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও গভীর পর্যালোচনার পর বিজ্ঞ ব্যক্তিরা একমত পোষণ করেছেন যে, জ্ঞান, বিবেক-বুদ্ধি ও বিবেচনায় মানুষ শ্রেষ্ঠতম সৃষ্টির মর্যাদা লাভ করেছে।

আদিমানব হজরত আদম (আ.)-কে আল্লাহ জ্ঞান শিক্ষা দিয়েছেন। জ্ঞান শিক্ষার মাধ্যম হলো ভাষা অর্থাৎ আল্লাহ ভাষার মাধ্যমে আদম (আ.)-কে জ্ঞান শিক্ষা দিয়েছিলেন। অতএব, ভাষার আদি স্রষ্টাও আল্লাহ। এ সম্পর্কে আল্লাহ পবিত্র কোরআনে বলেন, ‘রহমান, তিনি কোরআন শিক্ষা দিয়েছেন, তিনিই সৃষ্টি করেছেন মানুষ, তিনিই তাকে শিক্ষা দিয়েছেন ভাব প্রকাশ করতে। সূর্য ও চন্দ্র নির্ধারিত হিসাব অনুযায়ী রয়েছে।’ (সূরা আর রাহমান : ১-৫)।

মহাগ্রন্থ আল কোরআনের বাণীতে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, মানুষ সৃষ্টির পর মানুষের মনের ভাব প্রকাশের পদ্ধতি ও তার মাধ্যম ভাষা আল্লাহই মানুষকে শিক্ষা দিয়েছেন। সুতরাং ভাষা আল্লাহর দান। আল্লাহর অন্যান্য নিয়ামতের মতো ভাষাও একটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামত। সন্দেহ নেই যে, আদম (আ.)-এর ভাষা ছিল একটা কিন্তু পৃথিবীতে আদমসন্তানের বংশ বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে আদিমানুষের আদিভাষাও স্বভাবত কারণে নানা শাখা-প্রশাখায় বিস্তার লাভ করে। ফলে বিস্তীর্ণ পৃথিবীর বিচিত্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে আজ হাজার হাজার ভাষার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। এই বৈচিত্র্যময় বিশ্বে বিভিন্ন জনপদে নানা ভাষা, বর্ণ, গোত্রে বিভক্ত মানুষ আল্লাহর অসীম কুদরত ও মহান তাৎপর্যের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। এ সম্পর্কে আল কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তাঁর (আল্লাহ) নিদর্শনাবলির মধ্যে রয়েছে আকাশসমূহ ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও রঙের বিভিন্নতা। এতে জ্ঞানীদের জন্য অবশ্যই নিদর্শন রয়েছে।’ (সূরা রুম : ২২)। আল্লাহ নিজেই মানুষের ভাষাকে তাঁর সৃষ্টির অন্যতম নিদর্শন হিসেবে গণ্য করেছেন। এখানে ভাষা বলতে কোনো নির্দিষ্ট ভাষার কথা বলা হয়নি। স্থান-কাল, গোত্র-বর্ণ, মানবসমাজের অসংখ্য বিচিত্র ভাষাও তেমনি আল্লাহর নিদর্শন হিসেবে গণ্য। সেই হিসেবে পৃথিবীর প্রত্যেক ভাষার মর্যাদা সমান। এ সম্পর্কে মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘তিনটি কারণে আমি আরবি ভাষাকে ভালোবাসি। কেননা, আমি আরবি ভাষাভাষী, কোরআনের ভাষা আরবি এবং জান্নাতের ভাষাও হবে আরবি।’ এই হাদিসে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, রসুল (সা.)-এর মাতৃভাষা আরবি হওয়ার কারণে তিনি সেই ভাষাকে ভালোবাসার কারণ ব্যাখ্যা করেছেন। পৃথিবীর প্রতিটি ভাষা কোনো না কোনো মানুষের মাতৃভাষা। কোনো না কোনো ভাষা ছাড়া যেমন মানুষ মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে না, তেমনি মানুষ ছাড়া কোনো ভাষার অস্তিত্বও অকল্পনীয়।

প্রত্যেক মানুষের কাছে তার নিজ মাতৃভাষা অতিশয় প্রিয়। আল্লাহর কাছে তাঁর প্রতিটি বান্দাই যেমন সমান, সাধারণ দৃষ্টিতে মানুষে মানুষে যেমন কোনো বিভেদ নেই, ভাষার মর্যাদার ক্ষেত্রেও তেমনি কোনো প্রভেদ থাকতে পারে না। কিন্তু প্রত্যেক মানুষের কাছেই তার মাতৃভাষার চেয়ে মর্যাদাসম্পন্ন আর কোনো ভাষা নেই। মাতৃজীবের অস্তিত্ব লাভের পর মায়ের রক্তে সেই অস্তিত্বের ক্রমবিকাশ ঘটে। ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর মাতৃস্নেহে বেড়ে ওঠে এবং ধীরে ধীরে মায়ের ভাষা শিখে আস্তে আস্তে নিজের মনের ভাব প্রকাশ করে। তাই মা, মাতৃভাষা আমাদের অস্তিত্বের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। একে অস্বীকার করা নিজের অস্তিত্ব অস্বীকারেরই নামান্তর। আল্লাহ প্রত্যেক মানুষকেই স্ব স্ব মনের ভাব প্রকাশের ক্ষমতা দিয়েছেন। প্রকাশের এই পদ্ধতি বিবিধ। প্রথমে মুখের দ্বারা, দ্বিতীয়ত লেখনীর দ্বারা। মহান আল্লাহ যুগে যুগে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে ও বিভিন্ন ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর মধ্যে তাঁর রসুল পাঠিয়েছেন। এসব সম্মানিত বার্তাবাহক যিনি যে এলাকার জন্য প্রেরিত হয়েছিলেন, সেই এলাকার ভাষাই ছিল তাঁর মাতৃভাষা। তাঁরা তাঁদের মাতৃভাষায় কথা বলেছেন, প্রচার করেছেন এবং প্রেরিত কিতাবসমূহও আল্লাহতায়ালা নবী-রসুলদের মাতৃভাষায় অবতীর্ণ করেছেন। এ সম্পর্কে মহাগ্রন্থ আল কোরআনে আল্লাহ বলেন, ‘আমি প্রত্যেক রসুলকে তার স্বজাতির ভাষাভাষী করে পাঠিয়েছি, তাদের কাছে পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করার জন্য। অতঃপর আল্লাহ পথভ্রষ্ট করেন যাকে চান এবং পথ দেখান যাকে চান, তিনি মহাসম্মানিত, প্রজ্ঞাময়।’ (সূরা ইবরাহিম : ৪)।

আল্লাহ অন্যত্র বলেছেন, ‘আমি আপনাকে সত্যসহ প্রেরণ করেছি সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী হিসেবে। এমন কোনো সম্প্রদায় নেই যাদের কাছে সতর্ককারী প্রেরিত হয়নি।’ (সূরা ফাতির : ২৪)। মহান আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর মহা অনুগ্রহ হয়েছে মুমিনদের ওপর তাদের মধ্য থেকে তাদের জন্য একজন রসুল প্রেরণ করেছেন যিনি তাদের ওপর তাঁর আয়াতসমূহ পাঠ করেন এবং তাদের পবিত্র করেন। আর তাদের কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দান করেন এবং তারা নিশ্চয়ই আগে সুস্পষ্ট গোমরাহিতে ছিল।’ (সূরা আলে ইমরান : ১৬৪)। আল্লাহ অন্য আয়াতে বলেন, ‘এভাবে আমি আপনার প্রতি কোরআন অবতীর্ণ করেছি আরবি ভাষায়, যাতে আপনি সতর্ক করেন সব শহরের মূল মক্কা ও তার চারদিকের জনগণকে এবং আপনি সতর্ক করবেন কিয়ামত দিবস সম্পর্কে, যাতে কোনো সন্দেহ নেই। সেদিন একদল জান্নাতে যাবে একদল জাহান্নামে।’ (সূরা শূরা : ৭)। আল কোরআন পৃথিবীর সর্বকালের সব মানব জাতির উদ্দেশে অবতীর্ণ। এ মহাগ্রন্থ সম্পূর্ণ অবিকৃতভাবে চিরস্থায়ীরূপে সংরক্ষণের দায়িত্বও স্বয়ং বিশ্বনিয়ন্তার হাতে। এ মহাগ্রন্থও যে মহামানবের ওপর অবতীর্ণ হয়েছে তা তাঁর মাতৃভাষা আরবিতে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন,  ‘আমি সেটাকে অবতীর্ণ করেছি আরবি ভাষায় কোরআন, যাতে তোমরা বুঝতে পারো।’ (সূরা ইউসুফ : ২)। আল্লাহতায়ালা আরও বলেন, ‘এক কিতাব বিশদভাবে বিবৃত হয়েছে এর আয়াতসমূহ আরবি ভাষায় কোরআন, বোধশক্তিসম্পন্নদের জন্য।’ (সূরা হা-মিম-আস্ সাজদা : ৩)।

খুতবা লেখক ও প্রাকবয়ান করেন মাওলানা এ কে এম ফজলুর রহমান :

পরিচালক, ইসলামিক ফাউন্ডেশন।

সর্বশেষ খবর