রবিবার, ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

অভিবাসীদের কল্যাণ নিশ্চিত করতে হবে

হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ

অভিবাসীদের কল্যাণ নিশ্চিত করতে হবে

চলতি মাসের শুরুতে পাঁচ দিনব্যাপী শ্রমকল্যাণ সম্মেলন হয়ে গেল রাজধানী ঢাকায়। ২৬ দেশের ২৯টি শ্রমকল্যাণ উইংয়ের নতুন চারজনসহ মোট ৪৪ জন গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা অংশগ্রহণ করেছিলেন এ সম্মেলনে। ৪ ফেব্রুয়ারি উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসি। উপস্থিত ছিলেন একই মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. নমিতা হালদার এনডিসি, জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর মহাপরিচালক মো. সেলিম রেজা, ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের মহাপরিচালক গাজী মোহাম্মদ জুলহাস, এনডিসি এবং বোয়েসেলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মরণ কুমার চক্রবর্তী, অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) মো. আমিনুল ইসলাম প্রমুখ। মূলত বৈদেশিক কর্মসংস্থানের আরও সুযোগ তৈরি এবং প্রবাসী বাংলাদেশি কর্মীদের কল্যাণ নিশ্চিত করা— এ দুটি উদ্দেশ্য সামনে রেখেই শ্রমকল্যাণ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছিল। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট আর জনশক্তির বাজারে বিদ্যমান চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার কৌশলগত বিবেচনায় সন্দেহাতীতভাবে এ সম্মেলন আয়োজন এক বিরাট ইতিবাচক পদক্ষেপ। এ সম্মেলনের মধ্য দিয়ে আমাদের শ্রমকল্যাণ উইংয়ের কর্মকর্তারা নিশ্চিতভাবেই সরকারের দেওয়া মূল বার্তা ও নির্দেশনাগুলো সঠিকভাবে পেয়েছেন। উদ্বোধনী দিনে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসি বলেছেন, ‘বর্তমান সরকারের সাফল্য অর্জনে অন্যতম অংশীদার প্রবাসী বাংলাদেশি কর্মীরাও। তারা বিদেশে কর্মসংস্থান তৈরি, রেমিট্যান্স প্রেরণসহ দেশের সার্বিক উন্নয়নে অবদান রাখছেন। বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে শ্রমকল্যাণ উইংয়ে দূরদূরান্ত থেকে যেসব কর্মী সেবা নিতে আসেন তারা যেন হাসিমুখে সেবা নিয়ে কর্মস্থলে ফিরে যান সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। কোনো কর্মীই যেন সেবা না নিয়ে ফিরে যান সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে।’ তিনি ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডসহ অন্যসব কল্যাণমূলক সেবা ও সুযোগ-সুবিধার সহযোগিতা প্রদানে সবাইকে একযোগে কাজ করার আহ্বান জানান।

গণমাধ্যমে আসা প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রীর বক্তব্য পড়ে বোঝা যায় তিনি অভিবাসীদের সার্বিক কল্যাণের পথটাই অনুসন্ধান করেছেন এবং সেই লক্ষ্য অর্জনে শ্রমকল্যাণ সম্মেলনে গুরুত্বপূর্ণ মত দিয়েছেন। তবে আগামীতে মন্ত্রী মহোদয়ের বক্তব্য বা মতামত যদি নির্দেশনা আকারে আসে তাহলে তা আরও কার্যকর ফল রাখতে সক্ষম হবে। শ্রমকল্যাণ সম্মেলনে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান সচিব ড. নমিতা হালদার এনডিসি বলেছেন, ‘বিশ্বের শ্রমবাজারে প্রতিনিয়ত পরিবর্তন ঘটছে। কিছু কিছু শ্রমবাজার যেমন সংকুচিত হচ্ছে আবার নতুন নতুন শ্রমবাজার সম্প্রসারিত হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে শ্রমকল্যাণ উইংয়ের কর্মকর্তাদের কৌশল নির্ধারণের ধারণা প্রদানই শ্রমকল্যাণ সম্মেলনের অন্যতম উদ্দেশ্য; যাতে সফল শ্রমকূটনীতি দ্বারা শ্রম অভিবাসীদের সমস্যার সমাধান করা সহজ হয়।’ প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে সচিবের দায়িত্ব পাওয়ার পর আমরা ড. নমিতা হালদারকে দেখেছি অভিবাসী কর্মীদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষার ক্ষেত্রে তিনি কোনোরকম আপস করেননি; যা প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়সহ সরকারের ভাবমূর্তি উজ্জ্বলে ভূমিকা রাখছে।

বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের শ্রম উইংয়ের সার্বিক তৎপরতা নিয়ে অভিযোগ-অনুযোগ পুরনো বিষয়। বিদেশফেরত অনেকেই অভিযোগ করেন, বিদেশে কর্মসংস্থান তৈরি এবং কর্মীদের পেশাগত নিরাপত্তা ও কল্যাণে অন্য দেশের শ্রম উইংগুলো যতটা দক্ষতা প্রদর্শন করতে সক্ষম হয় সেই তুলনায় বাংলাদেশের শ্রম উইংগুলো ততটা পেশাদারিত্ব দেখাতে সক্ষম হয় না। ফলে নানা ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে শ্রমিকদের বিবিধ নাজুক ও ঝুঁঁকিপূর্ণ অবস্থার মধ্যে পড়তে হয়। কর্মক্ষেত্রের নিরাপত্তায় বেশি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে রয়েছেন মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে কর্মরত নারী কর্মীরা। সৌদি আরব, জর্ডান, লেবাননসহ বিভিন্ন দেশে নিয়োগকর্তা কর্তৃক নারী কর্মীদের নির্যাতনের বিষয়ে নির্যাতনকারীর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণে দৃশ্যমান তেমন কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। তবে এ কথাও সঠিক, আমাদের লেবার উইংয়ের কর্মকর্তারা সীমিত সুযোগ-সুবিধা নিয়ে বিভিন্ন দেশে তাদের সাধ্যমতো অভিবাসী কর্মীদের সুরক্ষায় কাজ করে আসছেন। বিশেষ করে আমরা লক্ষ্য করেছি যুদ্ধবিধ্বস্ত ইরাকে নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হওয়ার প্রেক্ষাপটে সেখানে কর্মরত রাষ্ট্রদূত আবু মাকসুদ এম ফরহাদ ও লেবার কনস্যুলার মো. রেজাউল কবির সার্বক্ষণিক সে দেশে বাংলাদেশের কর্মীদের কর্মসংস্থানের আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। বর্তমানে বিশ্বখ্যাত কোরিয়ান কোম্পানি হানওয়া ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন, হুন্দাই কনস্ট্রাকশন, জিএস ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড কনস্ট্রাকশনসহ বিভিন্ন নির্মাণপ্রতিষ্ঠান যুদ্ধবিধ্বস্ত ইরাক পুনর্নির্মাণে কাজ করছে। এই নির্মাণপ্রতিষ্ঠানগুলোয় দীর্ঘদিন থেকেই বাংলাদেশি কর্মীদের চাহিদা রয়েছে ব্যাপক। এ ছাড়া সৌদি আরবের রাষ্ট্রদূত মো. গোলাম মসিহ, লেবার কনস্যুলার কে এম সালাউদ্দিন, মো. শফিকুল ইসলাম, কুয়েতের মো. সারওয়ার আলম, কাতারের সিরাজুল ইসলাম, ইউএইর এ এস এম জাকির হোসেন, সিঙ্গাপুরের আয়শা সিদ্দিকা শেলী, আবুধাবির স্কোয়াড্রন লিডার মো. আরমান উল্লাহ চৌধুরী, লিবিয়ার এ এস এম আশরাফুল ইসলামসহ সবাই আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছেন প্রবাসী আয় বৃদ্ধির লক্ষ্যে কীভাবে কর্মীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করে সেসব দেশে কর্মসংস্থান তৈরি করা যায়।

বর্তমানে বিশ্বের ১৬১টি দেশে বাংলাদেশিরা শ্রমে নিয়োজিত রয়েছেন। কিন্তু মাত্র ২৯টি দেশে লেবার অ্যাটাশে রয়েছে। এবার আরও নতুন চারটি দেশে লেবার অ্যাটাশে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। লেবার অ্যাটাশে না থাকায় অনেক দেশে অভিবাসনসংক্রান্ত সমস্যা সেখানকার কূটনৈতিক মিশনগুলো যথাসময়ে সমাধান করতে পারছে না। ফলে অনেক দেশের দূতাবাসে কাঙ্ক্ষিত সেবা না পাওয়ার অভিযোগ তৈরি হচ্ছে। সবচেয়ে যে অসুবিধাটা হয় তা হলো অভিবাসীদের সুরক্ষায় সঠিক সময়ে কার্যকর নেগোসিয়েশন করতে না পারা। এদিকে কূটনৈতিক মিশনের সেবাসংক্রান্ত তথ্য অভিবাসীদের কাছে পৌঁছানোর সুব্যবস্থা এখন পর্যন্ত পুরোপুরি তৈরি হয়নি। এ কারণে বেশির ভাগ অভিবাসীই জানতে পারেন না কীভাবে সহযোগিতা নিতে হবে। অবশ্য এও সত্য, কূটনৈতিক মিশন বা শ্রম উইংগুলোয় আগে থেকেই জনবল ও সুযোগ-সুবিধার অভাব প্রকট। এ সমস্যা সমাধানেও খুব সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়নি। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে কূটনীতিকদের অপেশাদারি মনোভাবের কারণে অভিবাসন সমস্যা সমাধানে কাঙ্ক্ষিত নেতৃত্ব তৈরি হয়নি।

বিএমইটির হিসাবমতে এখন পর্যন্ত ৬ লাখ ৯৬ হাজার জন নারী শ্রম অভিবাসী রয়েছেন। নারী শ্রমিকের বড় অংশ মূলত সৌদি আরব, আরব আমিরাত, ওমান, জর্ডান, লেবানন, কুয়েত, মালয়েশিয়ায় কর্মরত। সর্বশেষ ২০১৭ সালে বাংলাদেশ থেকে যে ১০ লাখ ৫০ হাজার শ্রম অভিবাসী হয়েছেন এর মধ্যে নারী অভিবাসী ১ লাখ ২১ হাজার ৯৮৫ জন। ১৯৮০ সাল থেকে বাংলাদেশের পুরুষদের পাশাপাশি বৈশ্বিক শ্রমবাজারে নারীরা প্রবেশ করলেও তা ছিল একেবারেই সীমিত পরিসরে। প্রথম দিকে মূলত দক্ষ নারীরাই বিদেশে কাজের সুযোগ লাভ করেন। পরে স্বল্প বা কম দক্ষ নারীদেরও বিদেশে যাওয়ার সুযোগ তৈরি হয়। কিন্তু বহুবিধ কারণে এবং নানান শর্তারোপের জালে পড়ে নারীদের বিদেশগামিতা কমে যেতে থাকে। কখনো কখনো বিবিধ নিষেধাজ্ঞাও দেওয়া হয়। তবে ২০০৩ সালে সরকার নারীদের বিদেশ যাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নিলে আবার নতুন করে বিদেশে বাংলাদেশের নারী কর্মীর চাহিদা তৈরি হয়। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের এক গবেষণায় দেখা যায়, ১৯৯১ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত অভিবাসীর মধ্যে নারীদের হার ছিল মাত্র ১ শতাংশ। কিন্তু ২০০৩ সালে নারী অভিবাসন বিষয়ে নীতিমালা পরিবর্তনের কারণে ২০০৯ সালে এ হার ৫ শতাংশে উত্তীর্ণ হয়। অভিবাসী নারীদের এ হার এখন দ্রুতই বৃদ্ধি পাচ্ছে। শুধু তাই নয়, পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, পুরুষের তুলনায় উপার্জিত অর্থ নারীরা বেশি পরিমাণে দেশে প্রেরণ করেন। যেখানে বেশির ভাগ পুরুষ শ্রমিক গড়ে ৫০ শতাংশ টাকা দেশে প্রেরণ করেন সেখানে নারী শ্রমিকরা গড়ে ৯০ শতাংশ টাকা দেশে পাঠান। জিরো মাইগ্রেশন খরচে নারী শ্রমিকের বিদেশগমন অভিবাসনে গতি সৃষ্টি করেছে। আমরা এমনও দেখেছি, গ্রামের যে মেয়ে আগে কখনো নিজ জেলা শহরে যাননি তিনিও নামমাত্র খরচে পাড়ি জমিয়েছেন মধ্যপ্রাচ্যের কোনো দেশে। নারী কর্মীদের বেতন বৃদ্ধি ও কর্মক্ষেত্রের নিরাপত্তায়ও কার্যকর কৌশল ও পরিকল্পনা গ্রহণ করা দরকার।

অভিবাসী শ্রমিকদের পাঠানো রেমিট্যান্সকে দেশের অর্থনীতির অক্সিজেন বললেও ভুল হবে না। সবচেয়ে ভয়াবহ দুর্যোগের সময়ও আমরা দেখেছি প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ আমাদের অর্থনীতিকে বাঁচিয়ে রেখেছে। বিএমইটির তথ্যমতে, বর্তমানে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের মোট শ্রম অভিবাসীর সংখ্যা ১ কোটি ১৪ লাখ ৬৪ হাজার ৯৪৩। এ সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। শ্রমবাজার সম্প্রসারণের জন্য সরকারের আন্তরিকতার কোনো ঘাটতি নেই। সদ্য শেষ হওয়া শ্রমকল্যাণ সম্মেলনেও এই অভিব্যক্তি গুরুত্বসহকারে ব্যক্ত করা হয়েছে। তবে শুধু শ্রম অভিবাসীর সংখ্যা বাড়লেই হবে না, তাদের অধিকার সুরক্ষার কৌশলসমূহও মজবুত করতে হবে। অভিবাসীদের সার্বিক কল্যাণকে যদি গুরুত্ব দিয়ে না দেখা হয় তাহলে আমাদের টেকসই উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হবে।

বর্তমান সময়ে অভিবাসন প্রক্রিয়া বেশ জটিল অবস্থার মধ্যেই পতিত বললে ভুল হবে না। বিভিন্ন দেশ কর্তৃক বহুবিধ নিয়ম আর শর্ত আরোপ করায় এবং অভিবাসনে ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ায় অভিবাসীদের উন্নয়নে তা নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। বর্তমান সময়ে আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো নিরাপদ, সুষ্ঠু ও নিয়মতান্ত্রিক অভিবাসন। নিরাপদ অভিবাসন নিশ্চিত করতে কূটনৈতিক তৎপরতা আরও জোরদারের বিকল্প নেই। ঢাকায় যে শ্রমকল্যাণ সম্মেলন হয়ে গেল আমরা প্রত্যাশা করি আমাদের দূতাবাসের কর্মকর্তারা নারীসহ শ্রম অভিবাসীদের নিরাপত্তা, সুরক্ষা, কল্যাণ— সব বিষয়ে আরও বেশি সংবেদনশীল ও কৌশলী হবেন। শ্রম উইংয়ের কর্মকর্তারা যত সুদক্ষ ও মানবিক হবেন ততই আমাদের নিরাপদ অভিবাসন আরও ত্বরান্বিত হবে। অভিবাসীদের সার্বিক কল্যাণ টেকসই উন্নয়নকে নিশ্চিত করবে। একই সঙ্গে মাইগ্রেশন ডিপ্লোম্যাসি পরিকল্পনাভিত্তিক ও সুদক্ষভাবে সম্পন্ন করা গেলে অভিবাসীদের সার্বিক কল্যাণ এবং টেকসই উন্নয়ন দুটোই সমান্তরালভাবে এগিয়ে যাবে।

লেখক : শ্রম অভিবাসন বিশ্লেষক ও চেয়ারম্যান, ডিবেট ফর ডেমোক্রেসি ইমেইল : [email protected]

সর্বশেষ খবর