রাখাল চন্দ্র নাহা একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। মোটেই ভুয়া নয়। তার প্রমাণ সে আজ ২৩ বছর যাবৎ কারাগারে বন্দী। দেনদরবার করার তেমন কেউ নেই। তবু প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা বলে এমনিতেই তালিকাভুক্ত হয়েছে। ২০০৮ সালে ওয়ান-ইলেভেনের সময়ের কথা। এক সন্ধ্যায় ১০-১২ জন ছেলেমেয়ে মোহাম্মদপুরের বাসায় এসেছিল। আমি তাদের কাউকে চিনতাম না। তারা কেউ রাখাল চন্দ্র নাহাকে চিনত না। পত্রিকায় খবর বেরিয়েছিল, আগামীকাল গভীর রাতে কুমিল্লা কারাগারে রাখাল চন্দ্র নাহা নামে এক বীর মুক্তিযোদ্ধার ফাঁসি হবে। এখন সরকারি কর্তৃপক্ষ ধরেই নিয়েছে সব অপরাধে এক শাস্তি— ফাঁসি। ফাঁসি কোনো শাস্তি নয়, ফাঁসি সর্বৈব এক অসভ্যতা। আমাদের মধ্যে যেদিন আবার মানবতা জাগবে সেদিন আমরা বুঝতে পারব। অযোগ্য শাসকদের কারণে অস্থির পৃথিবীতে দাঙ্গা-হাঙ্গামা, খুন-খারাবি বেড়ে যাওয়ায় অনেকেই অধৈর্য হয়ে ফাঁসি আর ফাঁসি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। কিন্তু ফাঁসি কোনো সমস্যার সমাধান নয়। পৃথিবীর বহু স্থানে বহু ক্ষেত্রে এর নজির রয়েছে। একসময় অনেক দেশ থেকে ফাঁসির প্রচলন উঠে গিয়েছিল। এখনো পৃথিবীর কিছু কিছু দেশে মৃত্যুদণ্ড কল্পনারও বাইরে। কিন্তু আমাদের দেশে বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর ফাঁসির যেন মহামারী লেগেছে।
খবরটি বুকের ভিতর এক অকল্পনীয় অনাবিল নির্মল আনন্দ সৃষ্টি করেছিল। ’৭১-এর ১৬ ডিসেম্বরের মতো মনে হচ্ছিল যখন নিয়াজির দফতরে আমাদের সামনে মাথা নত করে বসে ছিল, যখন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আত্মসমর্পণ পত্রে স্বাক্ষর করছিল সেই দুর্লভ মুহূর্তগুলোর মতো।
একদিন পর কুমিল্লা কারাগারে গিয়ে রাখাল চন্দ্র নাহাকে দেখে এসেছিলাম। গেটের বাইরে একদল কারারক্ষী চমৎকার গার্ড অব অনার দিয়েছিল। কদিন আগে ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে এ নিয়ে কথা হচ্ছিল। তিনি বলছিলেন, আপনাকে ওভাবে গার্ড অব অনার দিয়ে কারা কর্তৃপক্ষ গর্বিত হয়েছে। তবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছিল বলে এটা সম্ভব হয়েছে। আওয়ামী লীগ-বিএনপির সরকার হলে সম্ভব হতো না। কথাটা একেবারে মিথ্যা নয়। আমার ওসব নিয়ে কোনো আগ্রহ নেই, আমার আগ্রহ কাজ করার। নাহাকে দেখে খুব ভালো লেগেছিল। খুব সম্ভবত সেদিন মৌলভীবাজারের ’৭৫-এর প্রতিরোধসংগ্রামী তরুণের বিয়েতে অংশ নিয়েছিলাম। ফিরেছিলাম পরদিন অনেক রাতে। বড় ভালো লেগেছিল একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার জীবন বেঁচে যাওয়ায়।
১৯৯৮-এর একেবারে শেষে বা ’৯৯-এর শুরুতে নাহার এক প্রতিবেশী খুন হয়। রাখাল চন্দ্র নাহা তখন বাড়ি ছিল না। তার ধারণাও ছিল না তাকে আসামি করা হবে। কিন্তু ২৬.০২.১৯৯৯ সালে তাকে হঠাৎই গ্রেফতার করা হয়। কুমিল্লা জজ কোর্টে তার নামে মিথ্যা খুনের মামলা চলে। চার বছর মামলা চলার পর ০২.০১.২০০৩ সালে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। একটা মানুষ কত দরিদ্র এবং অসহায় হলে জজ কোর্টের ফাঁসির আদেশের বিরুদ্ধে আপিল পর্যন্ত করেনি! ফাঁসির দণ্ড মাথায় নিয়ে সেই কারাদণ্ড ভোগ করতে থাকাকালে ২৫.০৬.২০০৮ সালে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের সিদ্ধান্ত হয়। ফাঁসির মঞ্চ সাজিয়ে, আলো জ্বালিয়ে সবকিছু ঠিকঠাক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে কুমিল্লা কারাগারকে প্রস্তুত করা হয়। এই খবর বেশ কটি পত্রপত্রিকায় ছাপা হলে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০-১২ জন ছেলেমেয়ে ছুটে আসে আমার কাছে। একজন মুক্তিযোদ্ধার ফাঁসি হবে— এ কথা শুনে খুবই মর্মাহত হয়ে রাষ্ট্রপতি, সেনাপ্রধান, প্রধান উপদেষ্টার কাছে ছোটাছুটি করে তার ফাঁসির দণ্ড রোধ করেছিলাম। কী দেশে বাস করি! ফাঁসির দণ্ড মওকুফ করে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়নি, তাকে দেওয়া হয় যাবজ্জীবন। সে জেলই খাটছিল। হঠাৎ অসুখের কথা শুনে কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগারে গিয়েছিলাম। সপরিবারে রাখাল চন্দ্র নাহাকে দেখে বেশ খুশি হয়েছি। কারা কর্তৃপক্ষ তাকে বেশ আদরযত্ন করে। কিন্তু একসময় সিদ্ধান্ত হয়েছিল সব মুক্তিযোদ্ধা কয়েদি-হাজতিকে ডিভিশন দেওয়া হবে। কিন্তু তাকে তা দেওয়া হয়নি। ভেবেছিলাম, একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে রাষ্ট্রপতির কাছে মার্জনা চাইব। কিন্তু কারাগারে গিয়ে শুনলাম তিন বছর আগেই তার যাবজ্জীবন কারাবাসের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। তবু সে মুক্তি পায়নি। এই হলো মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি আমাদের আচরণ! আগে যাবজ্জীবন ছিল ২০ বছর। কারাগারে ভালো আচরণ করলে ১২ বছরে মুক্তি পেত। বিচারপতি সাহাবুদ্দীন সাহেব হঠাৎই অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন। তিনি জীবনে জেলে যাননি, যাবেনও না। তাই মানুষের কষ্ট বোঝেননি। তিনি যাবজ্জীবনের সাজা বৃদ্ধি করে ২০ বছরের স্থলে ৩০ বছর করেছিলেন। সেই ৩০ বছর মেয়াদে ভালোভাবে ২০ বছর সাজা খাটলেই সব সাধারণ কয়েদি মুক্তি পায়। সেই হিসেবে রেয়াতসহ নাহার মুক্তির সুপারিশ করা হয়েছে ০৩.০৮.২০১৫ সালে। অথচ সে মুক্তি পায়নি। তাই মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে সাজা মওকুফের আবেদন না করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে রাখাল চন্দ্র নাহাকে অনতিবিলম্বে মুক্তির অনুরোধ জানিয়েছি। যেখানে মুক্তি তার প্রাপ্য সেখানে মুক্তি না দিয়ে তাকে কারাগারে বন্দী রেখে সরকারের অপরাধের বোঝা দিনের পর দিন বাড়ছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাকে তাত্ক্ষণিক মুক্তি দিয়ে সেই পাপের বোঝা লাঘব করতে পারেন। বিনা অপরাধে কাউকে কারাগারে রাখা যায় না এটাই সভ্যতার বিধান। তাই অনুরোধ জানিয়েছি। স্বাধীনতার পরপর দালাল আইনে খুলনার খান এ সবুর খান বন্দী ছিলেন। ব্যাপারটা বঙ্গবন্ধুকে জানালে পরদিনই তিনি তাকে মুক্তি দিয়েছিলেন। সবুর খান তো ছিলেন পাকিস্তানের কোলাবরেটর। কিন্তু রাখাল চন্দ্র নাহা একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। তাই তার আশু মুক্তি প্রয়োজন। আশা করব, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা রাখাল চন্দ্র নাহাকে অনতিবিলম্বে মুক্তি দিয়ে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানবীর তালিকায় নিজের নাম অন্তর্ভুক্ত করবেন।
লেখক : রাজনীতিক।