আলোক রশ্মির মতো কনফুসিয়াসের খ্যাতিও তখন ছড়িয়ে পড়েছে চীনের সর্বত্র। না ছড়িয়েই বা উপায় কী! তার মতো এমন জ্ঞানী, কবি, দার্শনিক, চিন্তাবিদ, রাজনীতিবিদ মহাকালে দু-একটির বেশি কেউ তো জন্মাতে দেখেননি। সে সময়ের চীনের মানুষ তাকে তুলনা করতে শুরু করলেন ঋষিমুনিদের সঙ্গে। প্রায়ই দেখা যায় গ্রামগঞ্জ কিংবা বিভিন্ন শহর থেকে মোষের পালের মতো দল বেঁধে লোক এসে সাক্ষাত্প্রার্থী হয় কনফুসিয়াসের। ঋষিমুনির কাছে সাধারণ মানুষের যে প্রত্যাশা কিংবা আকাঙ্ক্ষা থাকে কনফুসিয়াসের কাছেও তাদের প্রার্থনা সে রকমই- মান্যবর স্বর্গে যাওয়ার পথটা আমাদের একটু দেখিয়ে দিন। কনফুসিয়াস অট্টহাসিতে লুটিয়ে পড়েন মাটিতে। চীনারা এমনিতেই সাধারণত হয় একটু নাটুকেপনা ও হাস্যরস প্রিয়। কনফুসিয়াসও তার ব্যতিক্রম নন। সহজ-সরল লোকজনের অবাক করা মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি বলেন, আমায় ক্ষমা করবেন। সত্যি সত্যি আমার জানা নেই স্বর্গে যাওয়ার পথ। কিন্তু সাধারণ মানুষ সেটা বিশ্বাস করবে কেন? যে মানুষটি এত জ্ঞানী, বিজ্ঞ ও প্রাজ্ঞ সেই মানুষটি জানবে না স্বর্গে যাওয়ার সঠিক পথ, তা কী করে হয়? প্রখ্যাত এ চিন্তাবিদ ও দার্শনিকের জন্ম হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব ৫৫১ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর চীনের লু রাষ্ট্রের ছুফু শহরে। তিনি কিছুকাল একাধারে লু রাষ্ট্রের আইন ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তারপর রাজাদের সঙ্গে নানা বিষয়ে মতের বিরোধ হওয়ায় তিনি রাজনীতি ছেড়েছুড়ে শিষ্যদের নিয়ে বেরিয়ে পড়েন জ্ঞান অন্বষণে। তার দর্শন ও রচনাবলি চীনসহ পূর্ব এশিয়ার জীবনদর্শনে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে গভীর প্রভাব বিস্তার করেছে। সে যাই হোক আগে যে কথা বলছিলাম দলে দলে লোকজন আসে আর কনফুসিয়াসের মুখ থেকে তার অপারগতার কথা শুনে ফিরে যায় বিফল মনোরথে। শতসহস্র মানুষের এমন যাওয়া-আসা দেখে কনফুসিয়াসের পরিবারের সদস্যরাও বিশ্বাস করতে শুরু করলেন যে, কনফুসিয়াসের সত্যি মনে হয় এ ধরনের ক্ষমতা-টমতা কিছু আছে। তা না হলে নিত্যদিন এত লোক বাড়িতে ভিড় জমাবে কেন? কনফুসিয়াস তাই একদিন তার পুত্রকে ডেকে বললেন, দেখ পুত্র, তুমি তো আমার ঔরসজাত সন্তান, তোমার কাছে তো লুকোছাপা করে কোনো লাভ নেই। আমার সত্যিই সে ধরনের কোনো ক্ষমতা নেই। তবে হ্যাঁঁ এই যে আমার হাতে একটি বই দেখছ, এতে আছে চীনের বিখ্যাত সব কবির কবিতা। এসব কবিতার সমন্বয়ে আমি একটি সংকলন করেছি ‘বুক অব পয়েট্রি’ নামে। যদি এ বইটি কেউ মনোযোগ দিয়ে পড়ে তবে সে স্বর্গে যাওয়ার রাস্তা পেলেও পেতে পারে। কনফুসিয়াসের মুখে এমন কথা শুনে পুত্র বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলেন পিতার দিকে। গল্পটি আলোকিত মানুষ গড়ার কারিগর ও আমার প্রিয় শিক্ষক আবদুল্লাহ আবু সাইদের মুখ থেকে শুনেছিলাম বহু বছর আগে। তখন আমি ঢাকা কলেজের ছাত্র। কবিতা আসলে কী? সত্যি কি কবিতা আমাদের স্বর্গে যাওয়ার পথ দেখাতে পারে। কেনইবা আমরা কবিতা পড়ি কিংবা অব্যাহতভাবে তা পড়তে থাকব। অ্যারিস্টটলের মতে কবিতা হলো দর্শনের চেয়ে বেশি। ইতিহাসের চেয়ে বড়। শেলীর ভাষ্য অনুযায়ী কবিতা হলো পরিতৃপ্ত এবং শ্রেষ্ঠ মনের পরিতৃপ্তি এবং শ্রেষ্ঠ মুহূর্তের বিবরণ। বসওয়েল একবার জিজ্ঞেস করলেন জনসনকে— স্যার তাহলে কাকে বলে কবিতা? জনসন এখানে একেবারে অকপট। কেন, কবিতা কি নয় সেটা বলে দেওয়াই তো সবচেয়ে সহজ। আলো কি জিনিস আমরা সবাই জানি। কিন্তু আলো কি সেটা বলা আদৌ সহজ নয়। জনসন আসলে ঠিকই বলেছেন কবিতাকে কোনো সংজ্ঞার আওতায় ফেলা খুবই দুষ্কর। কবিতা বিশুদ্ধ শিল্প হলেও এটি কিন্তু সত্যি সত্যি একটি গোলমেলে বিষয়। আর এ জন্যই কবি পূর্ণেন্দু পত্রী বলেছেন, যে কবি বাস্তববাদী নন, তিনি মৃত। আর যে কবি শুধুই বাস্তববাদী, তিনিও ততধিক মৃত। যে কবি অযৌক্তিকতায় আচ্ছন্ন, তার কবিতা বুঝবেন কেবল তিনি আর তাকে যারা ভালোবাসে। এটা খুবই দুঃখের। যে কবি তত্ত্ববাগীশ, তাকেও বুঝবে কেবল তার সাঙ্গপাঙ্গরা। এটাও খুব দুঃখের। কবিতার জন্য কোথাও কোনো ধরাবাঁধা নিয়ম নেই। ঈশ্বর অথবা শয়তান, কেউই তৈরি করে দেননি কোনো ফর্মুলা। অথচ এই দুই মহামান্য ভদ্রলোক, ঈশ্বর এবং শয়তান, কবিতার জগতে হাঁকিয়ে চলেছেন এক লাগাতার যুদ্ধ। যুদ্ধে কখনো জিতছেন ইনি, কখনো উনি। কিন্তু কবিতা রয়ে যাচ্ছে অপরাজেয়।
কবিতা অপরাজেয় হলেও নিশ্চয়ই সব কবিতা অপরাজেয় নয়। সৃষ্টির শুরু থেকে আজ পর্যন্ত যত কাব্য, মহাকাব্য কবিতা সৃষ্টি হয়েছে সবই কি পদবাচ্য হয়েছে? সবই কি একাধিকবার পড়ার মতো কবিতা? আমার সঙ্গে বেশিরভাগ মানুষই সম্ভবত একমত হবেন যে নিশ্চয়ই তা নয়। শুধু কিছু কবিতাই হৃদয়ের বীণায় মূর্ছনা তোলে। মনের তন্ত্রিগুলোতে শিহরণ জাগায়। এ জন্যই বোধকরি কবি জীবনানন্দ দাশ বলেছেন, সবাই কবি নন, কেউ কেউ কবি। শুধু কিছু কবির কবিতাই বারবার পড়া যায়। পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বপ্রথম যে সাহিত্যকর্মটির আবিষ্কার হয়েছে সেটিও কিন্তু কবিতা। আরও সুনির্দিষ্ট করে বলতে গেলে বলতে হয়, এটি একটি মহাকাব্য, নাম ‘গিলগামেশ’। গিলগামেশ উপাখ্যানটি মেসোপটেমিয়া অঞ্চলের। একটি ব্যাবিলনীয় সাহিত্যের অন্তর্গত। গিলগামেশ রচিত হয়েছিল এখন থেকে প্রায় চার হাজার বছর আগে।
তখন কাগজ আবিষ্কৃত হয়নি, ফলে কাগজের ওপরে কোনো কিছু লিপিবদ্ধ করার প্রশ্নই ওঠে না। মেসোপটেমিয়ায় পাথরও ছিল না যে লোকজন তার ওপরে কিছু খোদাই করে লিখবে। মেসোপটেমিয়াবাসী অন্য পন্থা অবলম্বন করেছিল। এঁটেল মাটির তৈরি তক্তিতে তারা ছুঁচালো কাঠি দিয়ে দাগ কেটে কেটে লিখত। এ লিপির নাম বাণমুখ বা কীলক লিপি, ইংরেজিতে বলে কিউনিফর্ম।পৃথিবীতে প্রাচীন মহাকাব্য যে কটি বর্তমান তন্মধ্যে দুটি রচিত হয়েছিল এ উপমহাদেশে। রামায়ণ আর মহাভারত। কারা রচনা করেছিলেন তাও আমরা জানি। বাল্মীকি লিখেছিলেন রামায়ণ, আর মহাভারতের কবির নাম কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস। এর অর্থ কিন্তু এই নয় যে, রামায়ণ ও মহাভারত কেবল বাল্মীকি ও ব্যাসদেবই রচনা করেছিলেন সুসম্পূর্ণ গ্রন্থ দুটি। আসলে কালে কালে আরও কত কবির অজস্র পঙিক্ত যে এই দুই মহাকাব্যের ভিতরে মিশে গিয়ে তাদের লাবণ্য ও শ্রী বৃদ্ধি করেছে তার ইয়ত্তা নেই। ইলিয়াড ও ওডেসি এবং তাদের রচয়িতা গ্রিক মহাকবি হোমার সম্বন্ধেও অনুরূপ ধারণাই ব্যক্ত করা চলে।
এ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, এগুলো সেই জাতের মহৎ সাহিত্য যার ‘ভিতর দিয়া একটি সমগ্র দেশ, একটি সমগ্র যুগ, আপনার হৃদয়কে, আপনার অভিজ্ঞতাকে ব্যক্ত করিয়া তাহাকে মানবের চিরন্তন সামগ্রী করিয়া তোলে।’ কোনো দেশের ‘সহস্র বৎসরের হৃিপণ্ড স্পন্দিত’ হয়ে ওঠে এ জাতীয় রচনায়। গিলগামেশ, ইলিয়াড, ওডেসি, রামায়ণ ও মহাভারত মহাকাব্যগুলোও এর ব্যতিক্রম নয়।
১৮০০ শতকের দিকে ধীরে ধীরে গদ্যসাহিত্য জনপ্রিয় হওয়ার আগ পর্যন্ত পদ্যেরই ছিল জয়জয়কার ও একচ্ছত্র আধিপত্য। কবিতা একাই দাপিয়ে বেড়িয়েছে বিশ্বসাহিত্যে। এরই ধারাবাহিকতায় জন্ম নেয় মিলটনের ‘প্যারাডাইস লস্ট’, শেকসপিয়রের ‘সনেট’, দান্তের ‘ডিভাইন কমেডি’, ভার্জিলের ‘ইনিদ’ প্রভৃতি মহাকাব্য। এ ছাড়া জন্ম হয় পের্ত্রাক, বোক্কাচিত্তর মতো কবি, যারা সূচনা করেছিলেন রেনেসাঁ যুগের। তবে অনেকে মনে করেন দান্তের ডিভাইন কমেডির মধ্যেই নিহত ছিল রেনেসাঁ যুগের বীজ। এরপর অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে এলো রোমান্টিসিজম। ইংরেজি সাহিত্য তথা সমগ্র বিশ্বসাহিত্যে রচিত হলো এক নতুন ইতিহাস। ১৭৯৮ খ্রিস্টাব্দে ওয়ার্সওয়ার্থ ও কোলরিজ বন্ধুদ্বয় মিলে লিখলেন ‘রিলিক্যাল ব্যালাডস’ নামে কাব্যগ্রন্থটি। কোলরিজ লিখলেন তার জীবনের শ্রেষ্ঠ কবিতা ‘রাইম অব দ্য এনসিয়ান্ট ম্যারিনার’। অনেকের মতো আমারও উচ্চ মাধ্যমিকে কবিতাটি পাঠ্য ছিল। চোখ বুজলে এখনো শুনতে পাই কবিতার সাড়া জাগানো সেই লাইন—‘ওয়াটার ওয়াটার এভরিহয়ার নর অ্যানি ড্রপ টু ড্রিংক’। এ রোমান্টিসিজমের বদৌলতে ইংরেজি সাহিত্যে জন্ম নিল একঝাঁক তরুণ কবি—বায়রন, শেলি, কিটসসহ আর অনেকে।
বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ-পরবর্তী বহু কবির জন্ম হয়েছে। নজরুল এসেছেন উল্কার বেগে। জনপ্রিয়তার বিচারে সে সময়ে নজরুল ছিলেন রবীন্দ্রনাথের চেয়েও জনপ্রিয়। তারপর বুদ্ধদেব বসু। সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, অমিয় চক্রবর্তী, বিষ্ণু দে, প্রেমেন্দ্র মিত্র এরা রাজত্ব করেছেন কিছুকাল। জীবনানন্দ দাশ এদের মধ্যে সমসাময়িক হলেও তিনি ছিলেন একেবারে আলাদা। যাকে বলা চলে মুকুটহীন সম্রাট। ‘কবিরা কে কখন থাকে, কে হারিয়ে যায়’ নামক একটি প্রবন্ধে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় অবশ্য জীবনানন্দ দাশের চেয়ে সুভাষ মুখোপাধ্যায়কেই বড় কবি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
সুভাষ মুখোপাধ্যায় যে শক্তিমান কবি তাতে সন্দেহ নেই এতটুকু। কেবল তার মতো কবির কলমেই বেরিয়ে আসে ‘ফুল ফুটুক আর নাই ফুটুক আজ বসন্ত’-এর মতো কবিতা। কিন্তু রবীন্দ্র-উত্তর কবিদের মধ্যে আমি জীবনানন্দকেই এগিয়ে রাখি। রবীন্দ্রনাথের পরে আমাদের দেশেও জন্ম নিয়েছে প্রথিতযশা ও শ্রুতকীর্তসব কবি। তাদের সংখ্যাও নেহাতই কম নয়। কবি আবুল হোসেন, আল মাহমুদ, শামসুর রাহমান, শহীদ কাদরী, রফিক আজাদ নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহাসহ আরও অনেকে। পদ্যের এ খরার মৌসুমেও বাংলাদেশের অনেক কবির হাত দিয়েই বেরোচ্ছে উত্কৃষ্ট সব কবিতা। তাদের মধ্যে সর্বাগ্রে আসে ময়ূখ চৌধুরীর নাম। তিনি ছাড়াও মোহাম্মদ সাদিক, সৈকত হাবিব, পারভেজ হোসেন, রেজাউদ্দিন স্টালিন, রহমান হেনরী, মাসুদ হাসান, মাহবুব আজিজ সজল সমুদ্র এরা ভালো কবিতা লেখেন। তবে এবারের বইমেলায় দারুণ একটি ঘটনা ঘটেছে! কবি হেলাল হাফিজের ‘যে জলে আগুন জ্বলে’র পর এই প্রথম এমন একটি ঘটনা ঘটল। তরুণ এক কবির একটি কাব্যগ্রন্থ প্রথম সংস্করণ শেষ হয়ে দ্বিতীয় সংস্করণও প্রায় শেষের পথে। কবিতা ভালো লাগা, না লাগার প্রেক্ষাপটে এটি একটি দারুণ খবর। ঘটনাক্রমে এ তরুণ কবিটি আবার আমার ঘনিষ্ঠ সুহৃদ। কবি জুননু রাইনের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘এয়া’ যে মানুষের হৃদয় হরণ করে নেবে এটি আমার মতো অনেকেই ধারণা করেছিলেন। কিন্তু সমগ্র পাঠককুল বইটি যে এভাবে সাদরে গ্রহণ করবে এটি আমরা কেউই ভাবিনি। তবে এই কবিতার বইটি প্রকাশ করেছে প্রকাশনী সংস্থা ঐতিহ্য মিতভাষী মৃদুভাষী এ মানুষটি খুবই কম কথা বলেন। কবিতা নিয়ে কিছু জিজ্ঞাসা করলেই তার উত্তর হ্যাঁ... হুম... এসবের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। আমি বুঝতে পারি, যে নদী যত গভীর তার বয়ে চলাও হয় ততটা নিঃশব্দে। আমি একদিন জিজ্ঞাসা করলাম এই যে আপনি এত ভালো কবিতা লিখেন আপনার পূর্ব পুরুষদের মধ্যে কেউ কবিতা-টবিতা লিখত নাকি? উনি উত্তর দিলেন— আমার জানা মতে তো কেউ লিখত না। তবে আরও সুদূর অতীতে হয়তো কেউ লিখে থাকতে পারেন। জুননু আমাকে বললেন, কবিতার প্রতি আপনার এত অনুরাগ, তো আপনিও লেখা শুরু করুন। আমি বললাম, আপনাকে একটা গল্প বলি তাহলে। কবি এজরা পাউন্ডকে তো চেনেন নিশ্চয়ই। আমেরিকান কবি কিন্তু থাকতেন ইংল্যান্ডে। এলিয়ট, রবার্ট ফ্রস্ট, জেমস জয়েস, ইয়েটস এঁরা সবাই এজরা পাউন্ডকে গুরু মেনে সকাল বিকাল হুজুর হুজুর করতেন। আমি বললাম— কবি ইয়েটসকে চিনেছেন? ওই যে রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলিতে যে কবি ভূমিকা লিখেছিলেন তিনি। সে যা হোক, সেই এজরা পাউন্ড কে একবার প্রশ্ন করা হয়েছিল, ‘প্যারিস রিভিউ’ পত্রিকার পক্ষ থেকে। কেমন করে কবি হলেন আপনি? পাউন্ডের উত্তর— আমার দাদা স্থানীয় ব্যাংকের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে চিঠি লেখালেখি করতেন পদ্যে। আমার দাদি ও তার ভাই তারাও চিঠি চালাচালি করতেন পদ্য লিখে। এতেই প্রমাণ হয়, যে কেউই লিখতে পারে ওটা। তবে হাস্য-পরিহাস যাই করুন ছাপা অক্ষরে আমার প্রথম সাহিত্য কীর্তিটি ছিল কিন্তু কবিতা। আমি যখন দশম শ্রেণিতে পড়ি, তখন আমার একটি কবিতা ছাপা হয় ‘শিশু’ পত্রিকায়। কবিতাটির নাম ছিল ‘মেঘলা দিনে’ বহুকাল পরে একদিন দেখলাম কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীও এ নামে একটি সুন্দর কবিতা লিখেছেন। আমি নগণ্য একজন মানুষ, কবি জুননু রাইনের কাব্যগ্রন্থ ‘এয়া’ সম্পর্কে দেশের সব নামকরা বিশিষ্টজন বড় বড় সব পত্রিকায় ইতিমধ্যে বেশ জমিয়ে লিখেছেন। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী কালের কণ্ঠ পত্রিকায় লিখেছেন— “কবিতার প্রাণ থাকে চিত্রকল্পে ও ধ্বনিতে। জুননু ছোট ছোট সব ছবি এঁকেছে, যেগুলো স্বাভাবিকভাবে এসেছে। কষ্টকল্পিত নয়, যান্ত্রিকও নয়, ছোট নদীর ঢেউয়ের মতো তারা আসে এবং স্পর্শ করে। তাদের ধ্বনিগুলো স্বাভাবিক ও সংযত। এ বইয়ের কবিতাগুলো একবার নয়, একাধিকবার পড়ার মতো। যেমনটি আমি পড়েছি এবং আনন্দিত হয়েছি। সত্যিকারের কবিতার পরিচয় তো এটাই যে পড়লেও পড়াটা শেষ হয় না।”
সৃজন বিডি ডটকমে ময়ূথ চৌধুরী লিখেছেন—বাস্তবের উদ্ভট আধিপত্যের বিপরীতে তিনি দাঁড় করাতে চেয়েছেন প্রতিবাস্তবতা। তিলে তিলে গড়ে তুলেছেন তার অন্তর্লোক, যার অধিষ্ঠার্তী ‘দেবী’ এয়া; যদিও তিনি জানেন যে, মেসোপটেমিয়ার গিলগামেশের এয়া একজন দেবতা—বিশুদ্ধ জল আর জ্ঞানের দেবতা। জলের যে জীবনার্থ, প্রজ্ঞার যে প্রতিশ্রুতি, তা তিনি খুঁজে পেয়েছেন নিবৃত এক নারীর কাছ থেকে। এ সুবাদেই মর্ত্যমানবী এয়ার সঙ্গে পৌরাণিক এয়ার সমানতা।
এ ছাড়াও লিখেছেন আলী রিয়াজ। মঈনুস সুলতান, রেজাউদ্দিন স্টালিনসহ আরও অনেকে। জুননু রাইনের কবিতায় সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তিনি বর্তমানকে এড়িয়ে যাননি। দুঃখ, ব্যথা না পেলে, হৃদয় রক্তাক্ত না হলে নাকি কবিরা লিখতে পারেন না। এ জন্যই বোধকরি তার বেশ কিছু কবিতায় উঠে এসেছে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, সামাজিক অসামঞ্জস্যতা, অন্যায় ও অবিচার। এসব বিষয় নিশ্চয়ই তাকে ভাবিয়ে তুলেছে। করেছে বেদনাতুর। মহামান্যের বিষণ্ন বাগানে নামের কবিতায় তিনি লিখেছেন—এরপর, সন্তানের পিতা হারানোর হাহাকারে/পিতার সন্তানের বিকলাঙ্গতার চিৎকারে/বিশ্বজিত্রা কৃষ্ণচূড়ায় ফুটবে, ফুটতে ফুটতে/ঝরে পড়বে মহামান্যের অলস এবং বিষণ্ন ফুল বাগানে। অন্যদিকে আরেকটি কবিতায় তিনি লিখেছেন—আমি আজরাইল দেখিনি প্রভু/ক্রসফায়ার দেখেছি।
আমার জানামতে বাংলাদেশের অনেক বড় বড় কবির প্রথম কবিতার বইয়ের প্রথম সংস্করণ ছ’মাসের মধ্যেও শেষ হয়নি। কবি শামসুর রাহমান তার আত্মজীবনী ‘কালের ধুলোয়’ লিখেছেন—তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’ প্রকাশিত হওয়ার পর খুব বেশি বিক্রি হয়নি। মনজুরে মওলা থেকে শুরু করে অনেকের ভালো ভালো রিভিউ সত্ত্বেও। কিন্তু কবি জুননু রাইনের ‘এয়া’ দ্বিতীয় সংস্করণও শেষের পথে। এটি খুবই আশাবাদের কথা। এ মুহূর্তে আমার ইংরেজ কবি বায়রনের কথা মনে পড়ে গেল। কবি বায়রনই বোধকরি একমাত্র কবি, যার কবিতার বই প্রকাশিত হওয়ার পর সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠেই জানতে পারলেন, লন্ডন শহরে তার চেয়ে বড় সেলিব্রেটি আর দ্বিতীয় কেউ নেই। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘চাইল্ড হ্যারল্ডস পিলগ্রিমেজ’ প্রকাশিত হয় ১৮১২ সালে। এটি প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে লর্ড বায়রন একেবারে রাতারাতি তারকা খ্যাতি পেয়ে যান। মুদির দোকানের মুদিয়াল মনোহরি দ্রব্যাদি বিক্রি করছে অথচ হাতে বায়রনের কাব্যগ্রন্থ চাইল্ড হ্যারল্ডস পিলগ্রিমেজ। কোনো ইংরেজ নারী তার প্রাণপ্রিয় আত্মজকে স্তন্যপান করাচ্ছেন হাতে বায়রনের কাব্য চাইল্ড হ্যারল্ড। বন্ধু-বান্ধবীরা সবাই একত্রে খোশগল্প মেতেছেন, তবুও হাতে বায়রনের সেই কাব্যগ্রন্থ। এ বিষয়ে জুননু রাইনের প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলেন—আমার কবিতাগ্রন্থ নিয়ে আপনারাই বেশি মাতামাতি করছেন। কবিতার পাঠক বর্তমানে ক্রমহ্রাসমান। গদ্যেরই এখন জয়জয়কার। আমি বলি, কী বলেন এসব! পৃথিবী পাল্টে দিতে পারে কবিতা। ফরাসি বিপ্লব, রুশ বিপ্লব আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধসহ আরও কত বৈশ্বয়িক ক্রান্তিকালে কবিতা মানুষদের জুগিয়েছে প্রেরণা, দিয়েছে মুক্তির দিশা। নেরুদার কবিতা ছিল চিলির সমস্ত স্বৈরশাসকের জন্য একটি মূর্তিমান আতঙ্ক। শ্রমিক, মাঠের কৃষক ও সাধারণ মানুষ দল বেঁধে আবৃত্ত করত নেরুদার রক্তজাগানো সেসব কবিতা। মৃত্যুর মুহূর্তে শেলির পকেটে যেমন কিটসের কবিতা ঠিক তেমনি চে-গুয়েভারার অন্তিম মুহূর্তেও প্রেরণা এবং পরিতৃপ্তির বিশ্বস্ত সঙ্গী হিসেবে হাতের মুঠোয় ধরা দিল নেরুদার কবিতার বই। তিনি ছিলেন বিপ্লবী আন্দোলনে নিপীড়িতদের নির্ভরশীল বন্ধু। বিশ্বাস করেন কবিতা হচ্ছে সোশ্যাল অ্যাক্ট অথচ প্রেমের কবিতার সংখ্যাও তার অজস্র। একবার একশটা সনেট লিখে উৎসর্গ করেছিলেন নিজের প্রিয়তমা স্ত্রী মাতিলদে উরুশিয়াকে। আমি এবার বললাম—আমার দিকে তাকিয়ে বলুন তো, এই একশটা সনেট কি তাজমহলের চেয়ে কোনো অংশে কম? জুননু আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন শুধু কিছুই বললেন না। কবি আজ নীরব।
লেখক : গল্পকার ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী।
ই-মেইল : [email protected]