অফিস-আদালতি কার্যদিবসের অঙ্কে প্রলম্বিত কারাবাসের ফাঁদে পড়ে গেছেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। সাপ্তাহিক কার্যদিবসের প্রথম দিন ২৫ ফেব্রুয়ারি রবিবার ১৫ কার্যদিবস পিছিয়ে গেল তার জামিনের বিষয়টি। ১৫ দিন কার্যদিবস কার্যত ২০ দিনের মতো। তার জামিন বিবেচনার জন্য গ্রাউন্ড হিসেবে দেখানো হয়েছে ৪৪ যুক্তি। বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে তিনি নারী, বয়স, অসুস্থতা, তিনবারের প্রধানমন্ত্রী ও তার সামাজিক অবস্থানকে। জামিনের সবিনয় আরজিতে বলা হয়, ৭৩ বছর বয়সী খালেদা জিয়া নানা অসুখে ভুগছেন। তার ২০ বছর ধরে ডায়াবেটিস। ৩০ বছর ধরে গেঁটে বাত। ১০ বছর ধরে একদিকে হাইপ্রেসার, আরেকদিকে আয়রনস্বল্পতা। ১৯৯৭ সালে বাম হাঁটু এবং ২০০২ সালে ডান হাঁটু প্রতিস্থাপনের কারণে তার গিঁটে যন্ত্রণাদায়ক ব্যথা। তাকে হাঁটাহাঁটি না করতে চিকিৎসকের পরামর্শ রয়েছে।
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় তার দণ্ডপ্রাপ্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই রাজনীতির বাজারে এসেছে ভোটের নতুন তত্ত্ব ও অঙ্ক। এই হট আইটেমের উদ্যোক্তা বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য প্রবীণ নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ। তার মতে, খালেদা জিয়াকে জেলে নেওয়ায় বিএনপির প্রতিদিন ১০ লাখ ভোট বাড়ছে। আর আওয়ামী লীগের কমছে ১০ লাখ করে। মওদুদের এ অঙ্ক দিতে দেরি হলেও প্রতিক্রিয়ায় একটুও দেরি করেননি আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। অ্যাকাউন্টিংয়ের কোম্পানি হিসাবের মতো অঙ্কটা উল্টো করে দেন তিনি। বলেন, খালেদা জিয়াকে জেলে নেওয়ায় বিএনপির নয়, আওয়ামী লীগেরই দৈনিক ১০ লাখ ভোট বাড়ছে। একই নির্বাচনী এলাকা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ ও ওবায়দুল কাদেরের। নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জের এই দুই নির্বাচনী তারকার অঙ্কে যোগ হন আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ। বিএনপিকে ছেলে ভোলানো পরামর্শ দেন ভোলার এই কৃতী সন্তান। খালেদা জিয়া জেলে যাওয়ায় দৈনিক ১০ লাখ করে ভোট বাড়লে তার মুক্তির জন্য বিএনপিকে আন্দোলন বা আদালতে আবেদন না করার বুদ্ধি দেন তোফায়েল।
ভোটের হিসাবটা আসলেই ইন্টারেস্টিং। দিনে ১০ লাখ ভোট মানে মাসে ৩ কোটি। নির্বাচন হতে প্রায় ১০ মাস বাকি। অর্থাৎ সেই সময় পর্যন্ত বেগম খালেদা জিয়া জেল খাটলে তা হবে কাঁটায় কাঁটায় ৩০ কোটি। অ্যাকাউন্টিংয়ের শিক্ষার্থীদের কোম্পানি হিসাব আর জেনারেল ম্যাথ যে হিসাবেই হোক, বর্তমান হিসাবে বাংলাদেশে ভোটার সংখ্যা এখন ১০ কোটি ৪০ লাখ ৫১ হাজার ৮০৩। ভোট ও সিটের আশাবাদী এমন অঙ্ক শুরু হয়েছে খালেদা জিয়া জেলে যাওয়ার আগেই।মাস তিনেক আগে, আগামীতে বিপুল ভোটে জয়ী হওয়ার গাণিতিক হিসাব ঘটা করে সংবাদ সম্মেলন ডেকে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর পুত্র ও উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়। জানান, তার দল আগামীতে আরও বেশি ভোটে ফের মসনদে বসবে। বিদায়ী বছরের ১১ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের আবার বিপুল ভোটে বিজয়ের শুভসংবাদটি দেন তিনি। দলের নাম্বার ওয়ান না হলেও সেদিন মা শেখ হাসিনার দেশে অনুপস্থিত অবস্থায় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিকে নিয়ে বৈঠক করেন নাম্বার ওয়ান স্টিয়ারিংয়ে বসেই। পরে কথা বলেন সংবাদ সম্মেলনে। জানান একটা সুখবর দিতেই তিনি ধানমন্ডি অফিসে এসেছেন। দলকে জানাতে চাই আমার জরিপের রেজাল্ট বলছে, আজ নির্বাচন হলেও আগের চেয়ে বেশি ভোট পাবে আওয়ামী লীগ। ২০০৮ সালের চেয়েও বিপুল বিজয় আসবে। বাতকে বাত প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যও কাছাকাছি। তিনি অঙ্ক উল্লেখ না করে কনফিডেন্সের সঙ্গে বলেছেন, বিএনপি আর কখনো ক্ষমতায় আসতে পারবে না।
বিশাল বিজয়ের এ ধরনের আগাম তথ্য দিয়েছেন বেগম খালেদা জিয়াও। জেলে যাওয়ার কদিন আগে তিনি বলেছেন, ভোট দেওয়ার সুযোগ পেলে জনগণ আওয়ামী লীগকে চিরতরে ছুড়ে ফেলবে। আর ক্ষমতার অলিগলি চেনা বিএনপির হেভিওয়েট নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ বলেছেন, আগামী নির্বাচন ৫০% নিরপেক্ষ হলেও বিএনপি নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় ক্ষমতায় আসবে। দেশের সব মানুষ বিএনপির জন্য অপেক্ষমাণ। সরকারের শরিক জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের কথাবার্তাও এ স্টাইলেই। বিশেষ করে রংপুর সিটি নির্বাচনের পর থেকে তিনি বেশি বেশি করে বলছেন, বড় দুই দলকে মানুষ আর চায় না। তার জন্যই উন্মুখ গোটা জাতি। রংপুরের নির্বাচনের পর এরশাদের কাছাকাছি প্রতিক্রিয়া আরেক সাবেক রাষ্ট্রপতি নবগঠিত যুক্তফ্রন্টের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরীরও। তিনি বলেছেন, আওয়ামী লীগ-বিএনপির জনপ্রিয়তা তলানিতে চলে গেছে। সে ক্ষেত্রে উপচে পড়ছে কার জনপ্রিয়তা? তা পরিষ্কার করেননি বি. চৌধুরী।
ভোটের এ রকম অঙ্কবাজির মধ্যেই বেগম খালেদা জিয়ার কারাবাস। এর পরও কেউ কারও চেয়ে কম নন। আগামীতে সবারই জেতার আশা। পরাজয়ের গ্লানি তবে তাদের কাউকেই স্পর্শ করবে না। আশাবাদে মত্ত থাকা ভালো লক্ষণ। এ কনফিডেন্স আগামী দিনের জন্য আশাজাগানিয়া। অংশগ্রহণ-মূলক নির্বাচনের বারতা। কিন্তু কোন ভরসায়? কোন ম্যাজিকে? আর ঠকবেই বা কে? সবাই জিতলে বিরোধী দলের আসন কি ফাঁকাই থেকে যাবে? এসব প্রশ্নের জবাব কঠিন। আবার সহজও। পরাজয় আতঙ্কে না ভুগে সবার জয়ের আশার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় শব্দদূষণ হলেও রাজনীতিতে বায়ুদূষণ কমতে পারে।
লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট
বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।