শিরোনাম
সোমবার, ৫ মার্চ, ২০১৮ ০০:০০ টা

এই হামলা মুক্তচিন্তার ওপর খড়গ

শিক্ষক সমাজের ওপর হামলার এ ধারাবাহিকতা বেশ পুরনো। প্রগতিশীল চিন্তার কারণে জঙ্গিদের ছুরি-চাপাতির আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়েছেন শিক্ষকরা। জাতি গড়ার কারিগর এ শিক্ষকদের রক্তে রঞ্জিত হয়েছে রাজপথ। অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবালের ওপর হামলার পেছনে রয়েছে এ জঙ্গিরাই। গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এ মন্তব্য করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক এ কে আজাদ চৌধুরী এবং বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক জয়শ্রী ভাদুড়ী

এই হামলা মুক্তচিন্তার ওপর খড়গ

এ কে আজাদ চৌধুরী

অপরাধের বিষ মাথা থেকে বের করে দিতে হবে

     ———————— এ কে আজাদ চৌধুরী

 

বাংলাদেশ প্রতিদিন : অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবালের ওপর হামলার কারণ কী হতে পারে বলে আপনার ধারণা?

এ কে আজাদ চৌধুরী : প্রগতিশীল চিন্তার কারণেই হামলা হয়েছে ড. জাফর ইকবালের ওপর। জঙ্গিরা মনে করে শিক্ষকদের হত্যা করলেই জঙ্গিবাদের বিস্তার সহজ হবে। ড. জাফর ইকবালের ওপর এ হামলা স্বাধীনতাকামী বাঙালির চিন্তার ওপর আঘাত। কুসংস্কারমুক্ত সমাজের বাধা হিসেবে শিক্ষকদের সরিয়ে দিতে সক্রিয় রয়েছে এ বিপথগামী তরুণরা।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : এসব হামলা সমাজের ওপর কী ধরনের প্রভাব ফেলছে?

এ কে আজাদ চৌধুরী : মানুষ কখনই অন্যায়-অত্যাচার মেনে নেয় না। এভাবে শিক্ষকের ওপর হামলায় নিন্দার ঝড় উঠেছে। ধর্ম মানুষকে সহনশীলতা, স্বচ্ছতা, ন্যায়পরায়ণতা এবং পরমতসহিষ্ণু হতে শেখায়। ইসলাম ধর্ম মানুষকে ত্যাগ শেখায়, হত্যা নয়। অথচ ধর্মের নামে এভাবে টার্গেট করে শিক্ষকদের হত্যা বিপথগামিতার প্রমাণ দেয়।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : তরুণদের জঙ্গি সম্পৃক্ততা থেকে সরিয়ে আনতে বিভিন্ন ভাবে চেষ্টা চলছে। কিন্তু তারপরেও থেমে নেই এই অপকর্ম। এর কারণ কী বলে আপনার মনে হয়?

এ কে আজাদ চৌধুরী : আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অপরাধীদের খুঁজে বের করে শাস্তির দোরগোড়ায় আনতে পারে। কিন্তু যারা এসব অপরাধের বীজ ছড়িয়ে বেড়ায় তাদের মাথা থেকে এই বিষ বের করে দিতে হবে। তরুণদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করতে হবে। ধর্মের সঠিক বার্তা এবং মানুষ হিসেবে তাদের কর্তব্য কী তা শিক্ষা দিতে হবে। নয়তো এভাবেই আরও শিক্ষককে হত্যা বা হত্যাচেষ্টা প্রত্যক্ষ করতে হবে সমাজকে।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবালের ওপর হামলার এ ঘটনায় রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা কী হওয়া উচিত বলে আপনি মনে করেন?

এ কে আজাদ চৌধুরী : ড. জাফর ইকবালের ওপর হামলার প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছে দলমত নির্বিশেষে পুরো দেশের মানুষ। সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক সংগঠন তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী তীব্র নিন্দা জানিয়ে ড. জাফর ইকবালের সুচিকিৎর নির্দেশনা দিয়েছেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের কঠোর সমালোচনা করে নিন্দা জানিয়েছেন এ হামলার। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও এ ঘটনায় নিন্দা এবং দোষীদের দ্রুত শাস্তির আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন। রাজনৈতিক দলের কর্মীরা মাঠে সোচ্চার রয়েছেন এ হামলার ঘটনায়।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : শিক্ষকের ওপর হামলায় ফুঁসে উঠেছে দেশের বিভিন্ন শিক্ষাঙ্গনের ছাত্ররা। ছাত্র-শিক্ষক এই সম্পর্ককে কীভাবে দেখছেন?

এ কে আজাদ চৌধুরী : ছাত্ররা কখনই শিক্ষকের ওপর হামলা মেনে নেয় না। ছাত্ররা শুধু আন্দোলনই করে না, এসব অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধও গড়ে তোলে। শিক্ষকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ছাত্ররাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কিছু বিপথগামী তরুণ আমাদের দেশের ছাত্র-শিক্ষক সম্প্রীতির এই সম্পর্ক নষ্ট করতে পারবে না। বিপথগামী মুষ্টিমেয় তরুণ এই অপরাধ ঘটাচ্ছে। উদারমানসিকতা ও ধর্মের প্রকৃত শিক্ষা না পাওয়ায় বিপথগামী হচ্ছে তারা। মুক্তচিন্তা মানে যে ধর্মের বিরোধিতা নয়, তা এই পথভ্রষ্ট তরুণদের শেখাতে হবে।

 

 

একে অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপালে হবে না

     ————————  সেলিনা হোসেন

 

বাংলাদেশ প্রতিদিন : দেশের শিক্ষক-লেখক সমাজের ওপর বার বার হামলার ঘটনা ঘটছে। নির্দিষ্ট একটি গোষ্ঠীর ওপর হামলার কারণ কী বলে আপনি মনে করেন?

সেলিনা হোসেন : মানুষের মূল্যবোধ তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। যারা মুক্তচিন্তার চর্চা করে, প্রগতিশীলতাকে ধারণ করে তাদের জন্য নেমে এসেছে হামলার খড়গ। মানুষের পরমতসহিষ্ণুতার যে গুণ রয়েছে তা তাদের মধ্যে নেই। পথভ্রষ্ট হয়ে নিজের মতকে প্রতিষ্ঠা করতে এই বিপথগামীরা ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের মতো শিক্ষকের ওপর আক্রমণ করেছে।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : জঙ্গিবাদের পথ থেকে ফিরিয়ে আনতে বিভিন্ন ধরনের প্রচার চলছে। গ্রেফতার-শাস্তি অব্যাহত আছে। কিন্তু তারপরেও থামছে না এই ভুল পথের স্রোত। তাই জঙ্গিবাদের বীজ উপড়ে ফেলতে কোন পদক্ষেপ জরুরি বলে আপনি মনে করেন? 

সেলিনা হোসেন : আসলে যারা এই মানুষ হত্যার মিশনে নেমেছে তারা তরুণদের মস্তিষ্কে বিষবাষ্প প্রবেশ করাচ্ছে। এসব অপরাধীকে শাস্তির আওতায় আনতে হবে। এদের সমূলে উত্পাটন করতে হবে। অভিভাবকদের সন্তানদের সঙ্গে বন্ধুর মতো মিশতে হবে। তাদের সমস্যাকে নিজের সমস্যা ভেবে সমাধান করতে হবে। ভয়ভীতি নয়, প্রয়োজন বন্ধুবৎসল সৌহার্দ। কারও সন্তান বিপথগামী হলে সে দায় শুধু তার নয়, সমাজের ওপরও বর্তায়। তাই নিজের সন্তান ভেবে প্রত্যেকের জায়গা থেকে এগিয়ে আসতে হবে।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবালের ওপর হামলার এ ঘটনায় রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা কী হওয়া উচিত বলে আপনি মনে করেন?

সেলিনা হোসেন : রাজনৈতিক দলগুলো এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। সরকারি দলের পাশাপাশি সব রাজনৈতিক দলকেই এই হামলা প্রতিহত করতে এগিয়ে আসতে হবে। একে অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপালে হবে না। দোষ চাপানোর সংস্কৃতি সমস্যার সমাধান না করে তা দীর্ঘায়িত করে। এই দায় চাপানোর সুযোগে আড়াল হয়ে যায় মূল অপরাধী।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : এই হামলা প্রতিহত করতে কোন বিষয়গুলোতে জোর দেওয়া প্রয়োজন?

সেলিনা হোসেন : দেশের শক্তি সঞ্চয়ের জায়গা হলো তরুণ সমাজ। অথচ স্বাধীনতাবিরোধী জঙ্গিগোষ্ঠী এই তরুণদেরই হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। ছেলেমেয়েদের ভুলপথে পরিচালিত করে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করছে। আমাদের প্রথম কর্তব্য তরুণদের সৎপথে ফিরিয়ে নিয়ে আসা। সামাজিক মূল্যবোধ তাদের মধ্যে জাগ্রত করতে হবে। প্রতিটি ছেলেমেয়ে সঠিক পথে পরিচালিত হবে— সেটাই আমাদের কাম্য। এই দায়িত্ব শুধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাঁধে না চাপিয়ে সবাইকে নিজের জায়গা থেকে চেষ্টা করতে হবে।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : কোন বিষয়গুলো এই অপরাধ সংঘটনে অনুঘটক বলে আপনি মনে করেন?

সেলিনা হোসেন : জঙ্গিগোষ্ঠী তাদের স্বার্থ উদ্ধারে তরুণদের ব্যবহার করছে। একের পর এক শিক্ষক এবং লেখক সমাজ হামলার শিকার হচ্ছে। জাতির জন্য যারা সম্পদ তাদের বুকের রক্ত ছড়িয়ে পড়ছে রাজপথে। এসব হত্যাকাণ্ড এবং হত্যাচেষ্টার বিচার দ্রুত করতে হবে। বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী তাদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। অপসংস্কৃতির হাত থেকে দেশের তরুণ সমাজকে বের করে নিয়ে আসতে হবে। সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিলে এ ধরনের অপচেষ্টা প্রতিহত করা সম্ভব। যে জাতি মাতৃভাষার জন্য জীবন দিতে পারে, এ ধরনের অন্যায় প্রতিহত করা তাদের জন্য চ্যালেঞ্জ নয়।

 

সর্বশেষ খবর