শিরোনাম
সোমবার, ৫ মার্চ, ২০১৮ ০০:০০ টা

ইসলামের দৃষ্টিতে মুক্তিযুদ্ধ

মুফতি উসামা ইসলাম

ইসলামের দৃষ্টিতে মুক্তিযুদ্ধ

দেশপ্রেমকে ইসলামে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্মস্থান আরব দেশের একটি বহুল পরিচিত প্রবাদ হলো ‘হব্বুল ওয়াতান মিনাল ইমান’ অর্থাৎ জন্মভূমিকে ভালোবাসা ইমানের অংশ। আল্লাহ পৃথিবীতে যত নবী-রসুল পাঠিয়েছেন তারা তাদের জন্মভূমি ও দেশকে ভালোবাসতেন। স্বদেশের জন্য গভীর টান ও মায়া-মমতা প্রকাশ পেয়েছে হজরত নূহ (আ.), হজরত ইব্রাহিম (আ.), হজরত ইয়াকুব (আ.), হজরত মূসা (আ.)সহ অনেক পয়গাম্বরের জীবন ও আচরণে।

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজের জন্মভূমি ও দেশকে ভালোবাসতেন। জন্মভূমি মক্কা মোকাররমার প্রতি মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অপরিসীম ভালোবাসার কথা কে না জানে। সে অর্থে দেশকে ভালোবাসা মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাত। পৌত্তলিকদের অত্যাচারের মুখে মক্কা ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় তিনি পেছন ফিরে বারবার মক্কার দিকে তাকাচ্ছিলেন আর বলছিলেন, ‘আল্লাহর কসম! হে মক্কা, নিশ্চয়ই তুমি সবচেয়ে প্রিয় ও পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম স্থান। আমাকে যদি এখান থেকে বের করে না দেওয়া হতো আমি কিছুতেই তোমাকে ছেড়ে যেতাম না।’ (জামে তিরমিজি : ৫/৭২২)।  বিশ্বাসীদের আদিপিতা হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর জন্মভূমি ফিলিস্তিনের খলিল জনপদে। আল্লাহ প্রদত্ত দায়িত্ব পালনে তিনি পবিত্র মক্কা নগরীতে অবস্থান করতেন।

কাজ শেষে তিনি নিজ দেশে ফিরে আসতেন। পবিত্র কাবাগৃহ পুনঃনির্মাণ করা, ইসমাঈল (আ.)-এর কোরবানি, মক্কাকেন্দ্রিক দাওয়াত প্রচারের জন্য আল্লাহর হুকুমে তিনি সপরিবারে যখন মক্কা নগরীতে বসবাস করতেন তখন আল্লাহর এই নবীর চিন্তাচেতনা ও দোয়া প্রার্থনায় এই জনপদের প্রতি গভীর আগ্রহ, প্রেম ও ভালোবাসার প্রকাশ ঘটেছে। পবিত্র কোরআনের সূরা বাকারায় তার এমন একটি দোয়ার কথা উল্লেখ আছে। যখন ইব্রাহিম (আ.) বললেন— ‘হে আমার প্রতিপালক! এই নগরীকে নিরাপদ রাখুন এবং এর অধিবাসীদের ফল-ফসল থেকে রিজিক দান করুন যারা আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস করে।’

আমাদের মহান মুক্তিযোদ্ধারা বাংলাদেশের মজলুম মানুষের অধিকার আদায়ে লড়েছিলেন। কেউ যদি নিজের অধিকার, প্রাপ্য সম্পদ বা প্রাণ রক্ষা করতে গিয়ে নিহত হন তবে ইসলামের দৃষ্টিতে তিনি শহীদ। নবীজী (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি নিজের সম্পদ, পরিবার-পরিজন, নিজের প্রাণ বা নিজের ধর্ম রক্ষা করতে গিয়ে নিহত হয় সে শহীদ।’ (তিরমিজি : ৪/৩০; আবু দাউদ : ৪/২৪৬)। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ ছিল অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের সংগ্রাম। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জয়ী হওয়া সত্ত্বেও পাকিস্তানের সামরিক শাসকরা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে অস্বীকৃতি জানায়। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতের আঁধারে তারা মারণাস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাঙালিদের ওপর। শুরু করে গণহত্যা। বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ অবস্থায় দেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন ও মুক্তিযুদ্ধের ডাক দেন। পাকিস্তানি হানাদারদের হাতে গ্রেফতার হওয়ার পূর্ব মুহূর্তে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তিনি অসীম সাহসিকতা ও দেশপ্রেমের পরিচয় দেন। ইসলামের ইতিহাস পাঠে আমরা দেখতে পাই, পূর্বসূরিরা স্বদেশ ও স্বজাতিকে নিজের সন্তান-পরিজনের মতো ভালোবাসতেন। মদিনার স্বাধীনতা রক্ষায় রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একের পর এক যুদ্ধ করেছেন। হজরত ইমাম হোসাইন (রা.) তার পরিবারের অনেক সদস্য, ওমর বিন আবদুল আজিজ (রা.), নবাব সিরাজউদ্দৌলা, সাইয়্যেদ আহমদ শহীদ, ইসমাঈল শহীদ, মীর নিসার আলী তিতুমীর, টিপু সুলতানসহ অসংখ্য মুসলিম নেতা দেশের স্বাধীনতা, মানুষের ধর্মীয় ও জাগতিক অধিকারের জন্য জীবন দান করে অসামান্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন।

আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষ জীবন দিয়েছেন। দুই থেকে তিন লাখ মা বোনের সম্ভ্রমহানি ঘটেছে। পাকিস্তানি হানাদাররা পুড়িয়ে দিয়েছে হাজার হাজার ঘরবাড়ি। মসজিদও তাদের জিঘাংসা থেকে রক্ষা পায়নি। রক্ষা পায়নি মুসল্লিরাও। নিষ্পাপ শিশুদেরও তারা হত্যা করেছে নিষ্ঠুরভাবে। পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে সংগঠিত হয় বাংলাদেশের মানুষ। আল্লাহর অসীম রহমতে মুক্তিযুদ্ধে অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের পক্ষ জয়ী হয়। জুলুমকারীদের বিরুদ্ধে জয় হয় মজলুমের।

মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সুসংহত হয়। মহান মুক্তিযুদ্ধে যারা শাহাদাতবরণ করেছেন, তাদের আত্মত্যাগকে আল্লাহ গ্রহণ করুন। আল্লাহ আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের দুনিয়াতে নেক হায়াত এবং আখেরাতে জান্নাতের অনন্ত জীবন দান করে ধন্য করুন। আমিন।

লেখক : খতিব, তাকওয়া মসজিদ, ধানমন্ডি, ঢাকা।

 

সর্বশেষ খবর