জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ, যে ভাষণ শুধু বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়কেই নাড়া দেয়নি, ভাষণটি সারা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। আমরা আগে বলতাম বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষণ। আমরা এই ভাষণকে অনেক সময় তুলনা করতাম গেটিসবার্গ অ্যাড্রেসের আবরাহাম লিঙ্কনের ভাষণের সঙ্গে। কিন্তু জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠান ইউনেস্কো ৭ই মার্চের ভাষণকে বিশ্ব-ঐতিহ্যের প্রামাণ্য দলিলের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেছে। ইউনেস্কোর মহাপরিচালক ২৭ অক্টোবর এ সিদ্ধান্তটি গ্রহণ করে ৩০ অক্টোবর প্যারিসে জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে তা ঘোষণা করেন। আজ বিশ্ববাসীর কাছে প্রতীয়মান হয়েছে, বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ভাষণ। কারণ, এই ভাষণের মধ্য দিয়ে তিনি সমগ্র জাতিকে জাতীয় মুক্তির মোহনায় দাঁড় করিয়েছিলেন। একটি ভাষণের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সামগ্রিক দিকনির্দেশনা দিয়েছেন।
তিনি বলেছিলেন, ‘আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি।’ তিনি যদি হুকুম দিবার নাও পারেন তাহলে এই ভাষণ জাতির সামনে থাকবে এবং এই ভাষণে তিনি যা উল্লেখ করেছেন সেগুলোই আমাদের বাস্তবায়ন করতে হবে। ভাষণে সেই নির্দেশ তিনি দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু ছিলেন রাষ্ট্রনায়ক। যা বিশ্বাস করতেন তাই বলতেন এবং যা একবার বলতেন তার সঙ্গে কখনো আপস করতেন না। এমনকি ফাঁসির মঞ্চে গিয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতেন কিন্তু সিদ্ধান্ত থেকে সরে যেতেন না। এর বড় প্রমাণ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে তিনি হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করেছিলেন এই পাকিস্তান বাঙালিদের জন্য হয়নি। একদিন বাংলার ভাগ্যনিয়ন্তা বাঙালিদের হতে হবে। সেই উপলব্ধি থেকে ১৯৪৮-এর ৪ জানুয়ারি প্রিয় ছাত্রপ্রতিষ্ঠান ছাত্রলীগ এবং ’৪৯-এর ২৩ জুন আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা করে মহান জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে একটি জাতিকে তিনি মুক্তিযুদ্ধের পথে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন।
আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছি। মুজিব বাহিনীর অন্যতম প্রধান হিসেবে দেরাদুনে যখন ট্রেনিং হয় সেই দেরাদুনসহ বিভিন্ন ক্যাম্পে বক্তৃতা করেছি। বক্তৃতায় বলতাম, ‘বঙ্গবন্ধু মুজিব আপনি কোথায় আছেন, কেমন আছেন, আমরা জানি না। কিন্তু প্রিয় নেতা যতক্ষণ বাংলাদেশকে আপনার নির্দেশিত পথে হানাদারমুক্ত করতে না পারব, ততক্ষণ আমরা মায়ের কোলে ফিরে যাব না।’ ’৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর হানাদারমুক্ত করে আমরা বাংলা মাকে স্বাধীন করেছি এবং ’৭২-এর ১০ জানুয়ারি যেদিন বঙ্গবন্ধু স্বজন হারানোর বেদনা নিয়ে পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করে লন্ডন, দিল্লি হয়ে বাংলার মাটি স্পর্শ করলেন সেদিনই বাংলার মানুষ স্বাধীনতার পূর্ণতা অর্জন করল। জাতির দুর্ভাগ্য, জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর বিশ্ববিখ্যাত এই ভাষণটি দীর্ঘদিন রাষ্ট্রীয় প্রচারমাধ্যমে ছিল উপেক্ষিত। আমরা যখন কারাগারে বন্দী— ১৯৭৫ থেকে ’৭৮ পর্যন্ত প্রায় তিন বছরের মতো আমি কারাগারে বন্দী ছিলাম, ময়মনসিংহ, কুষ্টিয়া বিভিন্ন কারাগারে— পত্রপত্রিকায় দেখেছি তখন জাতির পিতার জন্মদিন ১৭ মার্চ, শাহাদাত দিবস ১৫ আগস্ট, একে তো অনুষ্ঠান করতে দিত না, আর দ্বিতীয়ত এই বক্তৃতাটি যাতে মাইকে প্রচারিত না হয় সেজন্য বাধা দেওয়া হতো। ১৯৯১ সালে বেগম খালেদা জিয়া যখন প্রধানমন্ত্রী সেই পঞ্চম জাতীয় সংসদে ’৯৩-এর ৭ মার্চ দাবি তুলে বলেছিলাম, ‘মাননীয় স্পিকার! আপনি জানেন যে, আজকে ঐতিহাসিক ৭ই মার্চ। এই দিন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মূলত স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন এবং ঐতিহাসিক অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলেন— যার ওপর ভিত্তি করে নয় মাস সশস্ত্র যুদ্ধ করে আমরা আমাদের প্রিয় এই বাংলাদেশকে স্বাধীন করেছি। আজকে সেই ৭ই মার্চে বিভিন্ন মহল থেকে আপনি জানেন, এই দিনটিকে পালন করার জন্য আমরা অনুরোধ করেছিলাম। রেডিও, টিভিতে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কর্মসূচি হয়। এমনকি মরহুম জিয়াউর রহমান সাহেবেরও জন্মবার্ষিকী, মৃত্যুবার্ষিকী ইত্যাদি বিভিন্ন কর্মসূচি হয়ে থাকে, অন্যান্য কর্মসূচি হয়ে থাকে। এ ব্যাপারে আমাদের কিছু বলার নাই, মিস্টার স্পিকার। কিন্তু আজকে ৭ই মার্চের কোনো কর্মসূচি আমাদের টিভি, আমাদের রেডিও কোনো জায়গায় নেই। এটা উপেক্ষিত। এর সঙ্গে সঙ্গে যারা স্বাধীনতাবিরোধী তারা এই সুযোগে স্বাধীনতার ইতিহাসের ভুল ব্যাখ্যা দিচ্ছে। ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে এই স্বাধীনতার ইতিহাসকে ম্লান করছে। আমরা ভেবেছিলাম, একটা নির্বাচিত সরকার ক্ষমতাসীন হয়ে এই স্বাধীনতার ইতিহাসকে তারা সমুন্নত রাখবে। আমাদের তিন জোটের রূপরেখা, সেই ঐতিহাসিক ঘোষণায় সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ ছিল, “স্বাধীনতার মূল্যবোধকে আমরা যে কোনো প্রকারেই রক্ষা করব।” কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও এটাই বাস্তব যে, এটাই সত্য যে, আজকে এই বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পরে, এই ৭ই মার্চ পালন করা হচ্ছে না। যে ১৫ই আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে, সেই দিন পালন করা হচ্ছে না। এই ব্যাপারে আজকে আমরা এই সংসদে দাঁড়িয়ে এর তীব্র প্রতিবাদ করছি এই কারণে যে, এই ৭ই মার্চ জাতির পিতা বলেছিলেন, “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।” এই ৭ই মার্চে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু মুজিব বলেছিলেন, “যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থেকো, রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেব, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশা আল্লাহ।” সেই ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ সামনে রেখে, নয় মাস যুদ্ধ করে যে দেশ আমরা স্বাধীন করেছি, সেই দেশে আজ পতাকা আছে, জাতীয় সংগীত আছে, নেই সেই স্বাধীনতার মূল্যবোধ। আজকে রেডিও-টিভিতে নেই সেই ঐতিহাসিক ভাষণ, যেই ভাষণ আমাদের নয় মাসের যুদ্ধের প্রেরণা জুগিয়েছিল। তাই আজকে এর তীব্র প্রতিবাদ করছি এই সরকারের কাছে, এই সংসদে দাঁড়িয়ে এখনো আমি অনুরোধ করছি, যাতে আজকে রাতের বেলায় টিভিতে যে অনুষ্ঠান হবে সেই অনুষ্ঠানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু মুজিবের ৭ই মার্চের ভাষণ যেন প্রচার করা হয়। দেশবাসীকে জানানো হয়, যাতে নতুন প্রজন্ম স্বাধীনতার ইতিহাসকে জানতে পারে।’ সেদিন জাতীয় সংসদের বক্তৃতায় যে অনুরোধ করেছিলাম বিএনপি তা প্রত্যাখ্যান করেছিল। তবুও আমাদের দমাতে পারেনি। গর্বের সঙ্গে বলতে চাই, পৃথিবীর কোনো ভাষণ কোনো দেশে এতবার উচ্চারিত হয়নি। আজ ৭ই মার্চের সেই ঐতিহাসিক ভাষণ বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম ভাষণ হিসেবে বিশ্বসভায় স্বীকৃত। ভাবতে কত ভালো লাগে জাতির জনক নেই, কিন্তু তার ভাষণ শ্রেষ্ঠ ভাষণের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত। যত দিন বাংলার মাটি ও মানুষ থাকবে তত দিন তিনি বাঙালি জাতির হৃদয়ের মণিকোঠায় বিরাজ করবেন।
বঙ্গবন্ধু কোনো দিন লিখিত বক্তৃতা দিতেন না। শুধু জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণটা লিখিত থাকত। যেমন ’৭০-এর নির্বাচনের প্রাক্কালে লিখিত বক্তৃতা দিয়েছেন। ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবসে জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণ ছিল লিখিত। জাতিসংঘেও লিখিত ভাষণ দিয়েছেন মাতৃভাষা বাংলায়। তবে সেসব ভাষণ তারই ডিক্টেট করা। জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধুকে বলা হয়েছিল, ‘আপনি ইংরেজিতে বক্তৃতা করেন।’ তিনি বলেছিলেন, ‘না, যে ভাষার জন্য আমার ভাইয়েরা রক্ত দিয়েছেন, শহীদ হয়েছেন, সেই ভাষায় বক্তৃতা করে বিশ্বের দরবারে আমার মায়ের ভাষাকে সমৃদ্ধ করতে চাই।’ স্মৃতির পাতায় ভেসে ওঠে সেই দিনটির কথা। পিনপতন নিস্তব্ধতার মধ্যে বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন। আজকে যিনি আলজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট আবদুল আজিজ বুতাফ্লিকা তিনি সে-সময় পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন। ’৭৪-এ লাহোরে অনুষ্ঠিত ইসলামিক সম্মেলনে তিনি বঙ্গবন্ধুকে নিতে এসেছিলেন। সেই আবদুল আজিজ বুতাফ্লিকা আলজেরিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে সভাপতিত্ব করছিলেন। মঞ্চ থেকে নেমে এসে বঙ্গবন্ধুকে মঞ্চে তুলে নিয়েছিলেন। ভাষণ শেষে বিশ্বের বরেণ্য নেতৃবৃন্দ বঙ্গবন্ধুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। কোনো কোনো নেতা এমনও বলেছিলেন, ‘শেখ মুজিব বাংলাদেশের নেতা নন, শেখ মুজিব শুধু এশিয়ার নন, শেখ মুজিব পৃথিবীর নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষের শ্রেষ্ঠ নেতা।’ বঙ্গবন্ধু পৃথিবীর বহু দেশ সফর করেছেন এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে বক্তৃতা করেছেন। কানাডায় কমনওয়েলথ রাষ্ট্রপ্রধানদের সম্মেলন, লাহোরে ইসলামী সম্মেলন, আলজেরিয়ায় জোটনিরপেক্ষ সম্মেলন, নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশন— পৃথিবীর যেখানে গেছেন তিনিই ছিলেন মূলত আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। কাছে থেকে দেখেছি বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রনায়কদের গভীর শ্রদ্ধা-ভালোবাসা বঙ্গবন্ধুর প্রতি। এমন একজন মহান নেতা যার কোনো তুলনা হয় না। এই বাংলাদেশ তার স্বপ্নের বাংলাদেশ, এই বাংলাদেশ তার রক্তে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ। এই বাংলাদেশের জন্যই তিনি স্বপ্ন দেখেছেন। এই বাংলাদেশের জন্যই তিনি যৌবনের ৪ হাজার ৬৮২ দিন পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী ছিলেন। যিনি জেলখানার সামনে থেকে ’৬৮-তে আগরতলা মামলার আসামি হিসেবে বন্দী হয়ে মাটি কপালে মুছে বলেছিলেন, ‘এই মাটি আমি তোমাকে ভালোবাসি। যদি আমার মৃত্যু হয়, আমি যেন তোমার কোলে ঠাঁই নিতে পারি।’ পাকিস্তানের কারাগারে জেলের মধ্যে সেল, সেলের সামনে কবরের পাশে দাঁড়িয়েও তিনি মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে বলেছিলেন, ‘এই কবরে না, আমার লাশটি আমার বাংলার মানুষের কাছে পৌঁছে দিও। যে বাংলার মাটিতে আমি লালিত-পালিত, যে বাংলার আকাশে-বাতাসে বর্ধিত, সেই বাংলার মাটিতে আমি চিরনিদ্রায় শায়িত থাকতে চাই।’ সত্যিই তিনি সেই বাংলার মাটিতে শায়িত আছেন গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায়। আর কোনো দিন তিনি ফিরে আসবেন না। কিন্তু বাংলার মানুষের হৃদয়ে বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকবেন চিরদিন। তাকে মুছে ফেলার সাধ্য কারও নেই। যত দিন বাংলার মাটি আর মানুষ থাকবে তত দিন বাঙালি জাতির হৃদয়ের মণিকোঠায় জাতির জনক চিরদিন অক্ষয় এবং অমর হয়ে থাকবেন।
লেখক : আওয়ামী লীগ নেতা, সংসদ সদস্য, বাণিজ্যমন্ত্রী, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার।