শুক্রবার, ৯ মার্চ, ২০১৮ ০০:০০ টা

স্বাধীনতা সংগ্রাম ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

নূরে আলম সিদ্দিকী

স্বাধীনতা সংগ্রাম ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

দুই.

সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশের মানুষের ভাষা, সংস্কৃতি, মননশীলতা ও মানসিকতাকে পদদলিত করার কুটিল ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠে পশ্চিম পাকিস্তানিরা। তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানকে শোষণের চারণ ক্ষেত্র বানানোর লক্ষ্যে বাংলার মানুষের বুকের রক্ত জোঁকের মতো শুষে নিয়ে রক্তশূন্য করার লিপ্সায় তাদের ওপর নির্মম রাজনৈতিক নিপীড়ন ও নিগ্রহ চলতে থাকে। ভাষা আন্দোলন চলাকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের নেতৃত্বে ২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে খণ্ড খণ্ড মিছিল বের হলে পুলিশ প্রথমে ফাঁকা গুলি ছোড়ে এবং একপর্যায়ে ছাত্রদের লক্ষ্য করে গুলি চালালে সালাউদ্দিন, সালাম, বরকত, রফিক, শফিউর, জব্বার শহীদ হন। সমস্ত বাংলাদেশ আগ্নেয়গিরির গলিত লাভা ও দাবানলের মতো জ্বলে ওঠে। ’৫৪-এর নির্বাচনে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট গঠনেও ছাত্রসমাজ তথা ছাত্রলীগের অবদান ছিল প্রণিধানযোগ্য। ইতিমধ্যে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হয় ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি হন এবং তারই প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় ও প্রণোদনায় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হয়। জনাব মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে সভাপতি এবং টাঙ্গাইলের শামসুল হককে সাধারণ সম্পাদক, জনাব অলি আহাদকে সাংগঠনিক সম্পাদক ও খন্দকার মোশতাক আহমদ (ইতিহাসের নৃশংস খুনি) ও শেখ মুজিবুর রহমান— দুজনকে যুগ্মসাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়। এ কথাগুলো উল্লেখ করার প্রাসঙ্গিকতা হলো, তখনকার জাতীয় রাজনীতিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রনেতাদের গুরুত্ব ও অবদান তুলে করা। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের পর ৯২(ক) ধারা জারি করে শেরেবাংলার নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট সরকারকে বরখাস্ত ও শেরেবাংলাকে অন্তরীণ করা হয়। মওলানা ভাসানী, শেখ মুজিবসহ অগণিত নেতা-কর্মীকে কারারুদ্ধ করা হয়। কিন্তু প্রবল গণআন্দোলনের মুখে কেন্দ্রীয় সরকার সব নেতাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।

’৬২-এর শিক্ষা আন্দোলনের বাহ্যিক দাবি ছিল হামুদুর রহমান শিক্ষা কমিশন বাতিল। কিন্তু তার অন্তর্নিহিত মূল সত্তাটি ছিল আইয়ুব খানের মৌলিক গণতন্ত্রব্যবস্থা বাতিল করে সর্বজনীন ভোটাধিকার অর্জনে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মুক্তি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা এই আন্দোলনটি ব্যাপক সফলতা লাভ করে; যার ফলে হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশনের সুপারিশ পুরোপুরি বাতিল হয়ে যায় এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীও মুক্তিলাভ করেন। কিন্তু নির্বাচনের প্রশ্নে মৌলিক গণতন্ত্রের পদ্ধতিটি বহাল থেকে যায়। এ প্রশ্নে আইয়ুব খান অনড় ছিলেন। ওই সময়ের আন্দোলনের একটা পর্যায়ে মৌলিক গণতন্ত্রের পন্থার বিপরীতে ইলেকটোরাল কলেজ সিস্টেম মেনে নিতেও আন্দোলনরত ছাত্রসমাজ ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব সম্মত ছিলেন। কিন্তু আইয়ুব খান এ প্রশ্নে বিন্দুমাত্র ছাড় দিতে রাজি হননি। মাদার এ মিল্লাত ফাতেমা জিন্নাহর সঙ্গে ১৯৬৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনটিও মৌলিক গণতন্ত্রের পদ্ধতিতেই অনুষ্ঠিত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিতে একমাত্র চালকের আসনে না থাকলেও মুখ্য ভূমিকা পালন করে। এটা বলে রাখা অত্যাবশ্যক, প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিটি রাজনৈতিক আন্দোলনে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করলেও শিক্ষা-দীক্ষা এবং জ্ঞানচর্চার প্রশ্নে নিঃসন্দেহে প্রাচ্যের শীর্ষস্থানে অবস্থানের ক্ষেত্রে কখনই কোনো হেরফের হয়নি। তখনো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাচ্যের তথা ভারতবর্ষের সর্বশীর্ষে অবস্থান করত। বিশেষ করে মুসলিম ছাত্রদের আগ্রহের প্রশ্নে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে একটা প্রতিযোগিতা ছিল বলেও তখনকার ইতিহাস হতে জানা যায়। ৬০০ একর জমির ওপর অবস্থিত পরম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত সবুজে ঘেরা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের উল্লেখযোগ্য শিক্ষকমণ্ডলীর মধ্যে সত্যেন্দ্রনাথ বসু, শ্রীনিবাস কৃষ্ণান, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, রমেশ চন্দ্র মজুমদার, এ এফ রহমান, সুরেন্দ্রনাথ ঘোষ, ড. কাজী মোতাহার হোসেন, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, মুনীর চৌধুরী, গোবিন্দ চন্দ্র দেব, ড. মুহম্মদ এনামুল হক, ফজলুল হালিম চৌধুরী, আবদুর রাজ্জাক, ড. ললিত মোহন নাথ, গোলাম মোহাম্মদ ভূঁঞা, ড. হিরন্ময় সেনগুপ্ত প্রমুখ। প্রসিদ্ধ শিক্ষকমণ্ডলীর সমাহার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতিকে সুউচ্চ শিখরে পৌঁছে দেয়। এর প্রথম উপাচার্য পি জে হার্টগ, পরবর্তীতে মাহমুদ হাসান এদের সযত্ন লালিত্য ও প্রতিভাদীপ্ত চেতনায় উদ্ভাসিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এই উপমহাদেশে গৌরবমণ্ডিত এবং জ্ঞানে প্রদীপ্ত সূর্যের মতো বিকীর্ণ অগ্নিকণায় সত্যিকার অর্থে একটা জাজ্বল্যমান দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়ায়। পাশ্চাত্য এবং প্রাচ্যের জ্ঞানপিপাসুদের নজর কাড়ে। আপন মহিমায় বিকশিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাচ্যের একটি অনন্যসাধারণ খ্যাতির সুউচ্চ গিরিশৃঙ্গমালায় অবস্থিত বিদ্যাপীঠ হিসেবে প্রতিস্থাপিত হয়। জ্ঞানপিপাসু শিক্ষক ও ছাত্রদের সমাহারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এতই দেদীপ্যমান শিখার মতো প্রজ্বলিত হয় যে, তখনকার এই উপমহাদেশের বহু প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে নিষ্প্রভ ও ম্রিয়মাণ হয়ে ওঠে। এ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিভিন্ন সময়ে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি পেয়েছেন এ পর্যন্ত ৫২ জন। পৃথিবী খ্যাত কীর্তিমানেরা এই ডক্টরেট ডিগ্রির সম্মান অর্জন করেছেন। তাঁদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু, শরত্চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, এ কে ফজলুল হক, স্যার যদুনাথ সরকার, চন্দ্রশেখর ভেঙ্কটরমণ, আবদুস সালাম, চু এন লাই, ড. মাহাথির বিন মোহাম্মদ, বান কি মুন, ড. মুহম্মদ ইউনূস, অমর্ত্য সেন, প্রণব মুখার্জি প্রমুখের নাম উল্লেখ করা যায়। মর্যাদার দিক থেকে এই সম্মানসূচক ডিগ্রি নোবেল প্রাইজের পরই অবস্থান করে। বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে তো বটেই সামগ্রিকভাবে শিক্ষাঙ্গন ও সুশীলসমাজে এভাবেই স্বীকৃত হতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়-প্রদত্ত সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মান ও মর্যাদার কারণে অনেক শিক্ষক বিশেষ করে অমুসলিম শিক্ষকরা কলকাতাসহ ভারতের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার আমন্ত্রণ পাওয়া সত্ত্বেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আকর্ষণ পরিত্যাগ করে যাননি। শিক্ষক ও ছাত্রদের কাছে তখনকার দিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল গৌরবদীপ্ত আদর্শের পীঠস্থান।

স্বায়ত্তশাসন থেকে স্বাধিকারে উত্তরণের আন্দোলনে ছাত্রসমাজের তথা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান এতটাই গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে আন্দোলনের প্রসূতিকাগার বা পাদপীঠ হিসেবে চিহ্নিত করা হতো। ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন ছিল মূলত ছাত্রসমাজের সর্বদলীয়। সরকার সমর্থিত এসএফের একটি বিরাট অংশ ’৬২-এর শিক্ষা আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল। এই এসএফ থেকেই একটি অংশ বেরিয়ে এসে আইয়ুব-মোনায়েমের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় সরকারি লেজুড়বৃত্তিতে নিবিষ্ট হয়; যাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা সরকারের লাঠিয়াল বাহিনী হিসেবে ঘৃণার চোখে দেখত। কালে কালে স্কলারশিপ ও বিদেশযাত্রার অভিলাষে অনেক মেধাবী ছাত্রও এই সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠা এনএসএফে যোগ দিতে বাধ্য হয়। একমাত্র ফজলুল হক হল ও ইকবাল হল বাদে সলিমুল্লাহ মুসলিম হল ও ঢাকা হলে প্রচণ্ড প্রভাব বিস্তার করে তারা ছাত্র সংসদ দখল করতে সক্ষম হয়। এনএসএফের দাপটে মূল সংগঠন এসএফ আস্তে আস্তে বিলুপ্তই হয়ে যায়।  আমাদের সময়ে স্বায়ত্তশাসন থেকে স্বাধিকার ও স্বাধিকারের মোড়কে স্বাধীনতার চেতনাটি তিলে তিলে বাস্তব রূপ নিতে থাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে। যদিও এনএসএফের দোর্দণ্ড প্রতাপে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থরথর করে কাঁপত। যে কোনো ছাত্রছাত্রীর জীবন তখন অনিশ্চিত ও আতঙ্কিত ছিল। পাঁচপাত্তু গলায় সাপ ঝুলিয়ে এবং কেউ কেউ কোমরে পিস্তল গুঁজে একটা বিভীষিকা ও আতঙ্কের সৃষ্টি করতে চাইত। তার বিপরীতে বাঙালি জাতীয় চেতনাভিত্তিক আন্দোলনে যে তীব্রতা সৃষ্টি করতে ছাত্রলীগ সক্ষম হয়, তার মধ্যেও কখনো কখনো বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ তৈরি হলেও আন্দোলনের তীব্রতায় ক্রমে ক্রমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এনএসএফের বিভীষিকা স্তিমিত হতে হতে নিঃশেষিত হয়ে যায়।

’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের পর শাজাহান সিরাজ যখন সাধারণ সম্পাদক ও আমি সভাপতি নির্বাচিত হই, তখন ক্রমান্বয়ে গোটা বিস্তীর্ণ বাংলার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ও ছাত্রলীগের পরিপূর্ণ করায়ত্তে চলে আসে। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন কলাভবনে ছাত্রলীগের প্রায় সব সভা কানায় কানায় ছাত্রছাত্রীতে পরিপূর্ণ হয়ে যেত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম সরাসরি ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রলীগ যে অবিস্মরণীয় বিজয় অর্জন করে, তখনকার সর্বজনপঠিত বাঙালির চিন্তার দর্পণ ইত্তেফাক আট কলাম কাঠের শিরোনাম করেছিল— ‘এ যৌবন জলতরঙ্গ রোধিবি কী দিয়া? বালির বাঁধ?’ ওই নির্বাচনের পর ছাত্রছাত্রীরা তো বটেই, সমগ্র শিক্ষকসমাজ ছাত্রলীগের প্রতি প্রচণ্ডভাবে আকৃষ্ট ও দুর্বল হয়ে পড়ে। তাদের আবেগাপ্লুত হৃদয়ের প্রত্যক্ষ সমর্থন দেশি-বিদেশি সংবাদমাধ্যম প্রত্যক্ষভাবে অবলোকন করে। আমার স্পষ্ট মনে আছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন কলাভবনের দোতলার বারান্দায় অসংখ্য চেয়ার পেতে সব বিভাগ ও অনুষদের শিক্ষকরা আমাদের বক্তৃতা শুনতে আসতেন। অর্থাৎ, তাঁদের হৃদয়ের সমর্থন প্রকাশ করতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বারান্দা নয়, সমগ্র বিশ্ববিদ্যালয়টিকে দিগন্তবিস্তৃত আলোকরশ্মিতে উদ্ভাসিত করে উপাচার্য হিসেবে আবু সাঈদ চৌধুরী এসেও যখন শিক্ষকদের সঙ্গে বারান্দায় বসতেন, তখন সবার মধ্যে যে আবেগ ও উন্মাদনা সৃষ্টি হতো, তা অবর্ণনীয়। আমি অজানা এক বিস্ময়কর উন্মাদনায় উদ্ভাসিত হয়ে পাগলপ্রায় উত্তেজনায় বক্তৃতা করতাম। ছাত্রসভার কলেবর তো বটেই, শিক্ষকবৃন্দ— বিশেষ করে আবু সাঈদ চৌধুরীর উপস্থিতি সমুদ্রের উচ্ছ্বসিত তরঙ্গমালার মতো আমার হৃদয়কে উদ্বেলিত করত।

তখন স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উত্তাল তরঙ্গমালা সারা বাংলাদেশের প্রান্তিক জনতার হৃদয়কে এমনভাবে আপ্লুত করে যে দু-একটি ব্যতিক্রম বাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বস্তরের শিক্ষক-শিক্ষিকা এই চেতনার পথে একান্তভাবে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন। জীবনের সব নদী-সমুদ্রের মোহনায় এসে অভূতপূর্বভাবে একই স্রোতধারায় মিলিত হয়ে যায়।

টিএসসির একটি ছাত্রসভায় উপাচার্য আবু সাঈদ চৌধুরী তার উদ্বেলিত হৃদয়ের আবেগ এবং নির্মল উচ্ছ্বাসের প্রকাশ ঘটিয়ে এক বক্তৃতায় বললেন, ‘আমার সামনে যখন সুখের দিন আসে, কোনো অভাবনীয় আনন্দে আমার হৃদয় যখন আপ্লুত হয়ে ওঠে; তখন নানা সুহৃদ ও শুভাকাঙ্ক্ষীর স্মৃতি আমাকে বিমোহিত করে, বিমুগ্ধ করে। কিন্তু আমার জীবনে যখন কোনো দুঃসময় আসে, দুঃখ-বেদনা, দ্বিধা-সংশয়, দুঃসময়ের কালো মেঘ যখন আমার হৃদয়ের সমস্ত অনুভূতিকে ঢেকে ফেলতে চায় তখন আমার শ্রান্ত ক্লান্ত অনুভূতির মানসপটে দুটি মুখ ভেসে ওঠে। একটি মুখ আমার পিতা আবদুল হামিদ চৌধুরীর, অন্য মুখটি আমার সন্তান নূরে আলম সিদ্দিকীর।’ সমগ্র টিএসসি ও তার চতুষ্পার্শ্বে তখন উচ্ছ্বসিত সমুদ্রের গর্জনের মতো করতালিতে মুখরিত হয়ে ওঠে। আবু সাঈদ চৌধুরী আমাকে কেন্দ্র করে যে শব্দটি উচ্চারণ করেন, তার গভীরে ছিল স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতি তাঁর প্রগাঢ় প্রতীতির অভিব্যক্তি। যে চেতনাটিকে ছাত্রলীগ সভাপতি হিসেবে আমি হয়তো বার বার স্পর্শ করতে পেরেছিলাম।

সেই উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা বানানোর পেছনের অভিসন্ধিটা শুধু ভাষাকেন্দ্রিক ছিল না। সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানের শোষণের চারণ ক্ষেত্র বানিয়ে বাঙালি জাতিকেই দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত করার দুরভিসন্ধি ছিল। আশ্চর্যের বিষয় হলো, ’৪৭ সালে দ্বিজাতিতত্ত্বের (টু নেশন থিওরি) ভিত্তিতে যে দেশটির জন্ম হলো এবং ’৪৬ সালের নির্বাচনে এ দেশের মানুষ বুক উজাড় করে পাকিস্তানের সপক্ষে মুসলিম লীগকে ভোট প্রদান কারে, তারাই ’৪৮ সালে পাকিস্তানের জাতির জনক কায়েদে আজম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা বানানোর উক্তির শুধু প্রতিবাদই করল না; ’৫৪-এর নির্বাচনে শেরেবাংলা, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্টের অভূতপূর্ব বিজয়ের মাধ্যমে গঠিত প্রাদেশিক পরিষদে সর্বসম্মতভাবে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানের গৌরবদীপ্ত ইতিহাস সৃষ্টি করে; যা আজো পৃথিবীর ইতিহাসে একটি বিরল দৃষ্টান্ত। এই সফল আন্দোলনের উদ্ভব, বিস্তৃতি ও সফলতা সবটুকুই ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন এবং এর সাফল্যের পেছনে পরিচালিত আন্দোলন সবটুকুই ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক। তারই রেশ ধরে স্বাধীনতা আন্দোলনের সূতিকাগার ও সফলতার পাদপীঠ হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে অভিহিত করা যায়। আমতলা ও বটতলা এই দুটিই ছিল ভাষা আন্দোলন, স্বায়ত্তশাসন থেকে স্বাধিকার ও স্বাধিকার থেকে ছয় দফাভিত্তিক স্বাধীনতা আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু। এর উন্মেষ, বিকাশ, ব্যাপ্তি ও সফলতার পাদপীঠ হয়ে দাঁড়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। যদিও মধুর ক্যান্টিনের কর্মিসভা, বটতলা ও আমতলার ছাত্রসভায় জগন্নাথ কলেজের জাগ্রত মিছিলই প্রাণ সঞ্চার করত; তবুও ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানেরও লীলাক্ষেত্র ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ষাটের দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় দাঁড়িয়ে আমি প্রায়শই আমার বক্তৃতায় উদ্ধৃত করতাম— গোখলে বলতেন, what Bengal thinks today, the whole India thinks it tomorrow. এর সূত্র ধরে আমি বলতাম, what we think today, the rest of politicians think it tomorrow.

এরই ধারাবাহিতায় ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রলীগের একক বিজয়ের গৌরব অর্জন এবং ’৭০-এর নির্বাচন ও ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রলীগের নিরঙ্কুশ বিজয়, ’৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জয়লাভে মারাত্মকভাবে প্রভাব বিস্তারে সক্ষম হয়। এ দেশের যে কোনো গণতান্ত্রিক আন্দোলনের বিজয়ে এবং ’৭১-এর মার্চে ঐতিহাসিক গণজাগরণ তৈরি ও তাকে লালন করে নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশকে শত্রুমুক্ত করার সফলতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অভূতপূর্ব প্রভাবকে অবারিত চিত্তে স্বীকৃতি দিতেই হয়। পৃথিবীর কোনো জাতির স্বাধীনতা আন্দোলনে এমনকি ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনেও ছাত্রদের এমন ব্যাপক ও অগ্রণী ভূমিকা কোনো দিনই ছিল না। ভ্রান্তি ও ভুল বোঝাবুঝি এড়াতে অবশ্যই বলতে হয়, বঙ্গবন্ধু সমগ্র আন্দোলনের মূর্তপ্রতীক ছিলেন। তিনি স্বাধীনতা আন্দোলনের স্থপতি। তবুও বলি, এই আন্দোলনের মূল কারিগর হলো ছাত্রলীগ। এই নিরিখে নিশ্চিতভাবে উপসংহার টানা যায়, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সারা বাংলাদেশ যে একটি সমুদ্রের মোহনায় একীভূত চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে স্বাধীনতা অর্জনের অভিপ্রায়ে সব মানুষ উদ্বেলিত চিত্তে এক ও অভিন্ন সত্তায় বিলীন হয়ে যায়, সেখানেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাব ছিল অভাবনীয়। 

লেখক : স্বাধীন বাংলা ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের অন্যতম নেতা।

সর্বশেষ খবর