শুক্রবার, ৯ মার্চ, ২০১৮ ০০:০০ টা
স্মরণ

গণমানুষের বন্ধু অ্যাডভোকেট ফিরোজ আহমেদ

প্রফেসর মোহাম্মদ মাজহারুল হান্নান

গণমানুষের বন্ধু অ্যাডভোকেট ফিরোজ আহমেদ

গরিব ও মেহনতি মানুষের অকৃত্রিম বন্ধু ছিলেন অ্যাডভোকেট ফিরোজ আহমেদ। খুলনার কৃতীসন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট ফিরোজ আহমেদ তার নীতি ও আদর্শের প্রশ্নে ছিলেন আপসহীন। কোনো প্রকার প্রলোভনে কখনই বিন্দুমাত্র আদর্শচ্যুত হননি। নিজ আদর্শ ও নীতির প্রতি অবিচল থেকে সব ধরনের প্রাপ্তির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন।

নিতান্তই বেঁচে থাকার জন্য যেটুকু প্রয়োজন তার বেশি কোনো চাহিদাই ফিরোজের ছিল না। অন্যের কথা ভেবে, অন্যের জীবনের চাহিদা মেটাতে তিনি পেতেন আনন্দ। তাই তো নিজের জীবনে বিলাসিতা বলে কিছু ছিল না। মানুষকে ভালোবাসার মধ্যে বেঁচে থাকাই ছিল তার জীবনদর্শন। এমন একটি ঘটনার কথা আমার মনে পড়ছে। একদিন খুব সকালে তিনি আমার কাছে এসে বললেন, ‘কিছু টাকার প্রয়োজন’। আমি তাকে বললাম, হঠাৎ টাকার প্রয়োজন হলো কেন? তিনি কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর বললেন, ‘গতকাল আইলা (২৫ মে, ২০০৯ সালে খুলনার উপকূলীয় অঞ্চলের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া প্রচণ্ড ঘূর্ণিঝড়) উপদ্রুত এলাকায় গিয়েছিলাম। সেখানে ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সঙ্গে তাদের সুখ-দুঃখের বিষয় নিয়ে কথা বলার সময় এক মায়ের কোলে তার শিশুটিকে কাঁদতে দেখলাম। তখন তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, মাগো! তোমার শিশুটি কাঁদছে কেন? মনে হয় ওর খুব খিদে পেয়েছে। যাও ওকে দুধ দাও। ওই মা তখন তার শিশুকে নিয়ে পাশে আড়ালে গেল। কিছুক্ষণ অতিবাহিত হওয়ার পরও শুনতে পেলাম শিশুটি চিৎকার করে কাঁদছে। এতে আমি স্থির থাকতে না পেরে আবার ওই মায়ের কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, তাকে দুধ দেওয়ার পরও সে কাঁদছে কেন? সে কোনো উত্তর করল না, তবে লক্ষ্য করলাম তার দুই চোখ দিয়ে অশ্রু বেয়ে পড়ছিল। তবুও আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম কী হয়েছে? সে মাথা নিচু করে অনেক কষ্টে বলল বুকে দুধ আসছে না। তখন বুঝলাম মা অনাহারে থাকার কারণে তার বুকের দুধ শুকিয়ে গেছে। এ অবস্থায় আমি কীভাবে চুপ করে বসে থাকতে পারি বলুন! তাই এখন আমি কিছু টাকা পেলে খুলনা শহর থেকে ওই শিশুটির জন্য দুধ কিনে দিয়ে আসব।’ আমি তখন ফিরোজকে কিছু টাকা দিয়ে বললাম, যাও তুমি ওদের সাহায্য কর। ফিরোজের মতো এমন মানবদরদি মানুষ আমাদের সমাজে বিরল। ন্যায়-নীতির প্রশ্নে ফিরোজ আহমেদ যেমন ছিলেন নির্ভীক তেমন কোনো প্রকার লোভ তাকে স্পর্শ করতে পারেনি। তিনি তার আদর্শের প্রতি কখনো বিশ্বাসঘাতকতা করেননি। বরং সারাটি জীবন আদর্শের প্রতি অবিচল থেকে লড়াই করে গেছেন। তিনি যেমন ছিলেন মেধাবী তেমন পরিশ্রমী। আবার সততার প্রশ্নে ছিলেন প্রচণ্ড নিষ্ঠাবান। মানবতাবাদী এই মানুষটি যে কোনো মঞ্চে অতি চমৎকার ও বলিষ্ঠ বক্তব্য দিয়ে অনায়াসে শ্রোতা-দর্শকের হৃদয় স্পর্শ করতে পারতেন। দেশ, সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতি, শিক্ষা, সংস্কৃতি প্রতিটি বিষয়ে তার এত স্বচ্ছ ধারণা ছিল যে, তার লেখনীতে তা প্রকাশ পেত। সুবক্তা ও সুলেখক হিসেবে তিনি যেমন যুক্তি উপস্থাপনে দক্ষ ছিলেন, তেমন প্রয়োজনে তার কথা ও লেখায় সে আবেগ সৃষ্টি করতে পারদর্শী ছিলেন।

তিনি প্রগতিশীল ধ্যান-ধারণার মানুষ ছিলেন সত্য; কিন্তু তাই বলে তিনি কখনো তথাকথিত প্রগতির জোয়ারে গা ভাসিয়ে দেননি। বরং যুগের প্রয়োজনে, সময়ের প্রয়োজনে যা বাস্তব, যা সুন্দর, যা বিজ্ঞানসম্মত, যা কল্যাণকর তাই তিনি অনুশীলন করতেন, অনুসরণ করতেন। তিনি যেমন ধর্মান্ধ ছিলেন না তেমনই ধর্মহীনতাকে কখনো প্রশ্রয় দেননি বরং একজন নিষ্ঠাবান মুসলমানের জীবনাদর্শই ছিল তার জীবনের আদর্শ। তিনি বামধারার রাজনীতি করতেন বলে ইসলামের জীবনদর্শন থেকে বিচ্যুত হননি কখনো। তিনি বিশ্বাস করতেন মুসলমান, হিন্দু, খ্রিস্টান বা বৌদ্ধ অথবা অন্য কোনো ধর্মাবলম্বী হওয়া বড় কথা নয়; বরং প্রকৃত মানুষ হওয়াটাই বড়। তাই তো মহান আল্লাহ ও রসুলের বাণী বুকে ধারণ করে আল্লাহর সৃষ্ট মানুষকে ভালোবেসেছিলেন। ভালোবেসেছিলেন আল্লাহর সৃষ্ট প্রকৃতিকে।

বড় মাপের মানুষেরা বুঝি দুনিয়ায় বেশি দিন থাকেন না। তা ছাড়া তাড়াতাড়ি চলে যেতে হবে বলেই ফিরোজ চলেছিলেন খুব দ্রুতগতিতে। অল্প সময়েই নিরলসভাবে প্রচুর কাজ করে গেছেন। তার চলমান জীবনে বিশ্রাম বলে কিছু ছিল না। সে কারণেই মনে হয় ফিরোজ ২০১৪ সালের ৯ মার্চ পৃথিবীর সব মায়া ত্যাগ করে অনেক আগেই চলে গেলেন। আল্লাহ তার আত্মার শান্তি দিন এবং তাকে জান্নাতবাসী করুন— এই প্রার্থনাই করি।

পরিশেষে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সন্তানরা ফিরোজের ত্যাগী জীবনের মহৎ কর্মযজ্ঞে অনুপ্রাণিত হয়ে ন্যায়ভিত্তিক, শোষণমুক্ত, নির্যাতনমুক্ত, সুন্দর ও উন্নত সমাজ গঠনে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করবে— এই প্রত্যাশাই করি।

লেখক : সাবেক ট্রেজারার, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় ও অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, খুলনা।

সর্বশেষ খবর