মঙ্গলবার, ১৩ মার্চ, ২০১৮ ০০:০০ টা

এসব কথা কি না বললেই নয়?

বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম

এসব কথা কি না বললেই নয়?

বেগম খালেদা জিয়াকে মহামান্য হাই কোর্ট জামিন মঞ্জুর করায় হাই কোর্টের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। বিচারিক আদালত আইনের দ্বারা পরিচালিত হওয়া উচিত। বেগম খালেদা জিয়ার জামিন মঞ্জুর হাই কোর্টের ভাবমূর্তিকে অনেক উজ্জ্বল করেছে। মানুষ মরণশীল। ‘সকল জীবকে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে’— এটাই নিয়তির বিধান। ‘জন্মিলে মরিতে হবে, অমর কোথা কে কবে?’ সেই চিরসত্যের মুখোমুখি হয়েছিলাম ৭ মার্চ প্রত্যুষে। সকাল ৬টা ৫-৬ মিনিট হবে। ফজরের নামাজ শেষে বারান্দায় কেবলই বসেছি। বেগম এসে সামনে বসল। বলতে যাব ছোট চাচা ওয়াদুদ সিদ্দিকীকে আনার কথা। আনা হয়ে থাকলে হাসপাতালে যাব। তখনই বেগম বলল, ‘চাচা নেই। কয়েক মিনিট আগে চলে গেছেন।’ বছরখানেক আগে আমার বাল্যবন্ধু হায়দার শিকদার চলে গেছে। তার ঢাকায় যাওয়ার কথা ছিল। মেডিকেলে সব ব্যবস্থা করে রেখেছিলাম। হায়দারের মেয়ে লিজা ১৫-২০ মিনিট আগে এসেছিল অনুমতি নিতে। তাই আমার ধর্মবিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক আবদুল কদ্দুস ফোনে যখন বলেছিল, ‘হায়দার ভাই চলে গেলেন।’ আমি মনে করেছিলাম তারা ঢাকার উদ্দেশে রওনা হয়েছে। এ কথা ও কথার মাঝে আবার বলল, ‘স্যার, হায়দার ভাই চলে গেছেন।’ তখন আর বুঝতে বাকি রইল না যে, হায়দার শিকদার টাঙ্গাইল থেকে ঢাকায় নয়, এ পার থেকে ওপারে না-ফেরার দেশে চলে গেছে। চাচার সংবাদটাও ঠিক তেমনই মনে হয়েছিল। আগের রাতে তার মেয়ে শিল্পী কয়েকবার ফোন করেছিল, ‘ছোটভাই, বাবাকে ঢাকায় আনব।’ একমাত্র ছেলে রাসেলও একই কথা বলেছিল। আমি প্রস্তুত ছিলাম। আমার বাসার পাশেই হৃদরোগ ইনস্টিটিউট। হৃদরোগ নিয়ে কত অভিযোগ শুনি, যন্ত্রপাতি কেনা, দালালদের দৌরাত্ম্য, কিন্তু হাসপাতালের ডাক্তার-কর্মচারী, কর্মকর্তা-নার্স সবাইকে ভীষণ ভালো লাগে। যতবার গেছি, দেখেছি কত মুমূর্ষু রোগীকে কি যত্নই না তারা করে। নিজের সন্তানও অনেক সময় মুমূর্ষু পিতা-মাতার পাশে অমন করে থাকে না। কিন্তু তার পরও শুনি নানা অনিয়ম। শত-সহস্র অনিয়মের দেশে হৃদরোগ ইনস্টিটিউট কী করে বিশুদ্ধ হবে। এনজিওগ্রাম, রিং পরানো, ওপেন হার্ট কত কিছু। হৃদরোগ ইনস্টিটিউট থেকে জেনেছি, শুনেছি, কিছু কিছু শিখেছি। নাজির আহমেদ রঞ্জু এক বীর মুক্তিযোদ্ধা। ’৭১-এ বেশ ছোট ছিল, কিন্তু সাহসী ছিল। দেখতে যেমন রাজপুত্রের মতো, ঠিক তেমনি কোনো অহংকার ছিল না। কত যোদ্ধা বড় হয়ে বিত্তশালী হয়ে রং বদল করেছে। কিন্তু রঞ্জুর পাকা রং। কোনো অদলবদল নেই। মা বেঁচে থাকতে ২৪ ঘণ্টা ওর পরামর্শ নিতাম। এখন আমার স্ত্রীর ডা. রঞ্জুর পরামর্শ ছাড়া চলে না। অন্যদিকে ভিসি কামরুল, ডা. শরীফ, মন্ত্রী আজাদ তার ছোটবেলার খেলার সাথী। এখন তো অধ্যাপক এ বি এম আবদুল্লাহর কথা ছাড়া আমার স্ত্রী নাপা কিংবা প্যারাসিটামলও মুখে তোলে না। চাচার মৃত্যু একটা মারাত্মক নাড়া দিয়েছে। কারণ বাবার দিকের আর কোনো মুরব্বি থাকল না। জানি, জন্মের একটা নিয়ম আছে, বাবার পর ছেলে, ছেলের পর নাতি। কিন্তু যাওয়ার কোনো নিয়ম বা সিরিয়াল নেই। বাবা-মার আগে কত সন্তান চলে যায়, দাদা-দাদির আগে কত নাতি-নাতকুর যায়। কিন্তু আমার চাচা তার বংশের ছোট সন্তান। সবার পরে এসেছেন, সবার পরেই গেলেন।

বাছুর আগলার কথা লিখতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ফিরে গিয়েছিলাম। বোরদার মোড়ের ডা. নাদেরুজ্জামান খান এমপির বাড়ির ওপর দিয়ে উত্তরে শিবগঞ্জ বাজারের দিকে যাওয়ার কথা ছিল। সেসব অনেক ঘটনা লেখার ইচ্ছা ছিল। এর মধ্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আমার প্রিয় বোন জিয়াউর রহমান বীরউত্তমকে নিয়ে অবাক করা এক তথ্য দিয়েছেন— যা দেশকে ভীষণ নাড়া দিয়েছে। অন্যদিকে আমার ছোট চাচা আলহাজ আবদুল ওয়াদুদ সিদ্দিকী ৭ মার্চ সকাল ৫টার দিকে না-ফেরার দেশে চলে গেছেন। তিনি ছিলেন বাবার বংশের শেষ মুরব্বি। বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকীর দু-তিন বছরের বড় ছিলেন তিনি। তাকে নিয়ে না লিখলেই নয়। তাই আন্তরিকভাবে চেষ্টা করব পরে বাবাকে নিয়ে ভারত সীমান্তে যাওয়ার কথা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা সরকার এবং দলের শেষ কথা। তিনি কিছু বললে তা আর নড়াচড়া করার উপায় থাকে না। অতিসম্প্রতি তিনি বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে জিয়াউর রহমানও আন্দোলনরত জনতার ওপর গুলি চালিয়েছেন। তার চারপাশে এখন যারা আছেন তারা কেন যে ওভাবে অসত্য তথ্য দিয়ে তাকে ছোট বা বিব্রত করার চেষ্টা করে বুঝতে পারি না। আমি আমার সমস্ত অন্তর, আত্মা অস্তিত্ব নিয়ে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সন্তান। সৌভাগ্য আর দুর্ভাগ্য যা কিছুই হোক গভীরভাবে মুক্তিযুদ্ধ করেছি। বহু সাধারণ যোদ্ধার মতো শুধু লেফট-রাইট করিনি, ৩০৩ রাইফেল নিয়ে কারও পিছে পিছে ঘোরাফেরা করিনি। বরং আমার পেছনে শত শত হাজার হাজার যোদ্ধা, লাখো মানুষ ঘোরাফেরা করেছে। সেজন্য মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কোনো বানানো তথ্য শুনলে ভালো লাগে না। জিয়াউর রহমান সম্পর্কে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্য যদি আন্তরিক ও বিশ্বাসপ্রসূত হয় তাহলে বলার কিছু নেই। আর যদি ওভাবে উসকে দিয়ে মজা দেখা হয় তাহলে তো সাবধান হতেই হয়। আমার অসুবিধা, আমি যেমন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অবহেলা মেনে নিতে পারি না, তেমনি খালেদা জিয়া অথবা অন্য কাউকে যা ইচ্ছা তাই অপমান-অপদস্থ করা ভালোবাসি না। কয়েক বছর আগে এক ভদ্রলোক এ সম্পর্কে আমাকে লিখেছেন। হঠাৎ সেদিন সে লেখাটা চোখে পড়ে। মনে হয় এখানে সেটা তুলে দেওয়া খুব একটা অপ্রাসঙ্গিক হবে না।

‘শ্রদ্ধেয় কাদের ভাই,

আমার ছালাম এবং শুভেচ্ছা গ্রহণ করবেন। আশা করি আপনি ভালো আছেন। গত সপ্তাহে আপনার বাসায় এসেছিলাম। অল্প সময়ের জন্য আপনার সঙ্গে কথা/আলাপ হয়েছে। আপনার সৌজন্য এবং আতিথেয়তার জন্য ধন্যবাদ।

আজকে সকালে বাংলাদেশ প্রতিদিনে বঙ্গবন্ধুকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি মানুষকে তাচ্ছিল্য না করার আপনার আহ্বান অত্যন্ত সময়োপযোগী এবং যথার্থ বলে আমি মনে করি। শুধুমাত্র আপনজনকেই এ রকমের পরামর্শ দেওয়া যায়। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি আপনার শ্রদ্ধাবোধ থেকেই এ ধরনের পরামর্শ দেওয়ার তাগিদ আপনি অনুভব করেছেন। অন্যদিকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতিও আপনার একটি আন্তরিক ও নীতিবোধের সম্পর্ক রয়েছে। নিঃসন্দেহে আপনি একজন বড় মাপের মানুষ। বঙ্গবীর শুধু একটি শব্দই নয়, কথা এবং কাজে এর ঘনিষ্ঠ সঙ্গতি রয়েছে। আর সে কারণেই বঙ্গবীর উপাধি আপনার জন্যই প্রযোজ্য।

আপনার সুস্বাস্থ্য এবং দীর্ঘায়ু কামনা করছি।

পুনঃ শুভেচ্ছান্তে,

আপনার বিশ্বস্ত

এম. এ. খান।’

মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর জিয়াউর রহমানকে নিয়ে মন্তব্য আমাকে নাড়া দিয়েছে। বঞ্চনা-বৈষম্য পাকিস্তানিরা যেমন করেছে, বাংলাদেশের শুরু থেকে মুক্তিযোদ্ধারা তেমনি হয়েছে। তবু জিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে চট্টগ্রামে আন্দোলনরত জনতার ওপর গুলি চালিয়েছেন এ কথা মেনে নেওয়া যায় না। ইতিহাসে এর কোনো প্রমাণ নেই। আর প্রমাণ না পাওয়া গেলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কথা অসত্য হবে। আমার কাছে প্রধানমন্ত্রী বড় কথা নয়। আমি কখনো শক্তির পূজারি ছিলাম না, আমি ভালোবাসা-অন্তরাত্মা এবং আন্তরিকতার পূজারি ছিলাম। অনেক পণ্ডিত বলেন, ৭ মার্চেই সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা করা উচিত ছিল। তা করলে বাঙালি সেনারা বাদবাকি পাকিস্তানিকে বন্দী-টন্দী করে দেশ স্বাধীন করে ফেলত। এত রক্তের প্রয়োজন হতো না। এ যেন ছেলের হাতের মোয়া। ৭ মার্চের ভাষণে স্বাধীনতা ঘোষণার আর তেমন কিছু বাকি ছিল না। ২৫ মার্চ কালরাতে হানাদাররা হত্যাযজ্ঞে ঝাঁপিয়ে পড়ার আগে পাকিস্তানি ট্রেনিংপ্রাপ্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তেমন কেউ প্রত্যক্ষ সংগ্রামে যোগ দেয়নি, বেঙ্গল রেজিমেন্টেরও তেমন কেউ নয়। ২৫ মার্চের দু-তিন দিন আগে বিডিআরের উইং কমান্ডার মেজর রফিক অবশ্য কিছুটা ছোটাছুটি করেছেন। অন্যদিকে জয়দেবপুরে দ্বিতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্ট যাতে বিদ্রোহ করতে না পারে সেজন্য নানা স্থানে ভাগ-বাটোয়ারা করে রেখেছিল। যে কারণে মানিকগঞ্জ, টাঙ্গাইল এবং ময়মনসিংহে আগে থেকেই বেঙ্গল রেজিমেন্টের তিনটি কোম্পানি ছিল। তাদের ১০-১৫ জন সাধারণ সৈন্য ১৪ মার্চ জয়দেবপুর আসার পথে কোনাবাড়ী থেকে জয়দেবপুরের মাঝামাঝি হাজার হাজার মানুষের ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা, তোমার আমার ঠিকানা, পিন্ডি, না ঢাকা? ঢাকা, ঢাকা’ স্লোগানে উদ্বুদ্ধ হয়ে গাড়ি ফেলে জনতার সঙ্গে মিশে যায়। তারাই ১৪ তারিখ থেকে জনতাকে অস্ত্র চালনা শেখাতে থাকে। যারা সবকিছু ফেলে সাধারণ মানুষের পাশে যাওয়ার আগে দাঁড়িয়েছিল আমরা তাদের কারও নাম-ঠিকানা জানি না। তাদের বীরশ্রেষ্ঠ খেতাব দিলে সেটাও কম হতো। কিন্তু কোথাও তারা নেই। সব নাম আমাদের। সফিউল্যাহ, জিয়া, খালেদ মোশাররফ, শাফায়েত জামিল— আমরাই বীর-মহাবীর। হ্যাঁ, এটা বলা যায় ১৯ মার্চ ব্রিগেডিয়ার জাহানজেব আরবারের নেতৃত্বে জয়দেবপুরের সৈন্যদের অস্ত্রহীন করতে গেলে অবস্থা বেগতিক দেখে পাকিস্তানি ব্রিগেডিয়ার তার লোকজন নিয়ে ঢাকা ফেরার পথে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী ও হাজার হাজার জনসাধারণ তাদের আটকে রেখেছিল। তখন জাহানজেব আরবার মেজর সফিউল্যাহকে ঘেরাওমুক্ত করতে নির্দেশ দেয়। মেজর সফিউল্যাহর নির্দেশে রাস্তা ফাঁকা করতে কিছু সৈন্য তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গুলি চালিয়েছিল। কিছু সৈন্য গুলি চালাতে অস্বীকার করেছিল। হতাহতও হয়েছিল বেশ কয়েকজন। যদি পাকিস্তান থাকত, আমরা যদি সফলকাম না হতাম তাহলে ব্রি. জাহানজেব আরবারের হুকুম মানার জন্য সফিউল্যাহর অবশ্যই প্রমোশন হতো। কিন্তু যে সৈন্যরা ময়মনসিংহের দিক থেকে আসতে গিয়ে জনতার মিছিলে মিশে গিয়ে অস্ত্র প্রশিক্ষণ দিয়েছিল, ১৯ তারিখ মনের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যারা যায়নি তাদের কী হতো— ফাঁসি। ২৫ মার্চ চট্টগ্রাম জেটিতে জাহাজ থেকে অস্ত্র নামাতে জিয়াউর রহমান অবশ্যই যাচ্ছিলেন। কিন্তু চট্টগ্রামে মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে বেঙ্গল রেজিমেন্ট কোথাও কোনো গুলি চালায়নি, চালিয়েছে পাকিস্তানি অবাঙালিরা। কর্নেল অলি আহমদ পাগলের মতো ছুটে গিয়ে টাইগার পাসের কাছে জিয়াউর রহমানের গাড়ির যদি গতিরোধ করতে না পারতেন তাহলে হয়তো ইতিহাস অন্যরকম হতে পারত। যদি তিনি জেটিতে যেতেন, হয়তো অস্ত্র নামাতেন, বীর বাঙালি বাধা দেওয়ায় গুলি চালাতেন তাতে হয়তো মানুষ মরত। কিন্তু তা তো হয়নি। কারণ তিনি যেতে পারেননি। এর পরের ইতিহাস সবার জানা, কালুরঘাট বেতারে জনাব জিয়াউর রহমান বীরউত্তমের ঘোষণা জাতিকে উদ্বেলিত করেছিল, মুক্তিযুদ্ধে প্রভাব ফেলেছিল। স্বাধীনতার পর গণভবনে জিয়াউর রহমানকে পাশে নিয়ে বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলা বেতার শুনতে গিয়ে এম আর আখতার মুকুলের চরমপত্র ও জিয়াউর রহমানের ঘোষণা শুনেছেন। কত প্রশংসা করেছেন। সবই তো তাহলে মাঠে মারা যায়। বিএনপির নেতা-কর্মী ও কিছু পণ্ডিত যখন বলেন জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষক, তার ঘোষণায় যুদ্ধ করেছি। তখন আমরা অনেকেই মেনে নিতে পারি না, ইতিহাস বিকৃতি মনে করি। ইদানীং ইংরেজিতে পারদর্শী বাঙালি এত বোঝে— ‘I, Major Zia, do hereby declare the independence of Bangladesh on behalf of our great national leader Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman! কণ্ঠ ছিল জিয়ার প্রাণ বঙ্গবন্ধু এটা বোঝেন। আশ্চর্য ব্যাপার! তখন কাদের সিদ্দিকী ছিল না, জিয়াউর রহমানও না, সফিউল্যাহ-খালেদ মোশাররফ কেউ কিছু না। আকাশে-বাতাসে সাগরে-নদীতে তখন ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। জিয়াউর রহমান, শেখ মুজিবুর রহমান, রহমানে রহমানে মিল থাকলেও দুই রহমান এক নয়। এখন যেমন আওয়ামী লীগের সবকিছুতে জননেত্রী শেখ হাসিনা, বিএনপিতে খালেদা জিয়া, জাতীয় পার্টিতে এরশাদ, ঠিক তখন ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এখন নেতা-নেত্রীদের প্রতি জনগণের তেমন আস্থা না থাকলেও বঙ্গবন্ধুর প্রতি এই ভূখণ্ডের আকাশ-বাতাস-তরুলতা-মানুষজন-পশুপাখি সবার ছিল এক নিঃস্বার্থ সমর্থন। বীরউত্তম জিয়াউর রহমানের ঘোষণায়ই যদি যুদ্ধ হতো তাহলে কেন মুজিবনগর সরকার হবে? জিয়াউর রহমানের নেতৃত্ব-কর্তৃত্ব থাকলে ‘জিয়ানগর’ সরকার হওয়া উচিত ছিল। কেন তিনি একটি সাধারণ সেক্টর কমান্ডার হবেন? মুক্তিবাহিনীর প্রধান হলেন না, বিপ্লবী সরকারের প্রধান হলেন না তার কথায় আমরা যুদ্ধ করলাম স্বাধীন করলাম এ কি হয়? নিশ্চয় তিনি এখন একজন মস্তবড় নেতা। কিন্তু তখন তিনি আমাদের ছায়া ছিলেন। তোফায়েল আহমেদ, আ স ম আবদুর রব, শাজাহান সিরাজ, আবদুল কুদ্দুস মাখন কিংবা যুবনেতা সিরাজুল আলম খান, শেখ ফজলুল হক মণি, জননেতা আবদুর রাজ্জাকের সমসাময়িকও ছিলেন না, অনেক পেছনে ছিলেন। আমরা সবাই ছিলাম বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক ছায়া, কায়া হওয়া তো দূরের কথা। আর জিয়াউর রহমান তখন আমাদের চেয়ে অনেক দূরের ছায়া ছিলেন। তাই বলে মুক্তিযুদ্ধের সূচনায় তিনি জনতার ওপর গুলি চালিয়েছেন— এ কথা সত্য নয়। এতে ইতিহাস বিকৃতি হয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর মুখ দিয়ে বলিয়ে দুষ্ট লোকেরা তাকে ছোট করার বা অপ্রিয় করার চেষ্টা করছে। সত্যিই যদি তার শুরুর ভূমিকা অমন হতো তাহলে মুক্তিযুদ্ধের সময় তার নামের অক্ষর দিয়ে কেন ব্রিগেড করা হয়েছিল? যে তিনটি ব্রিগেড করা হয়, ‘কে’, ‘এস’, ‘জেড’ ফোর্স। ‘জেড’ ইংরেজি বর্ণমালার শেষ অক্ষর হলেও জিয়াউর রহমানের নামানুসারে ‘জেড’ ফোর্স করা হয়েছিল সবার আগে। তাকে সেক্টর কমান্ডার করেছিল কে বা কারা? করেছিল বাংলাদেশ বিপ্লবী সরকার। সরকার পরিচালনায় বীরউত্তম জিয়ার কোনো কর্তৃত্ব ছিল না। স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু যখন অবিসংবাদিত নেতা, সরকারের প্রধান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তখন ’৭৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধাদের যে বীরত্বসূচক খেতাব দেওয়া হয়। সাতজন বীরশ্রেষ্ঠ, সবাই সশস্ত্র বাহিনীর। ৬৮ জন বীরউত্তমের আমি ছাড়া সবাই সশস্ত্র বাহিনীর। ১৭৫ জন বীরবিক্রম, তাদের ১০-১২ জন বাদে সব সেনা-বিমান-নৌ ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। ৪২৬ জন বীরপ্রতীকের ২০-২২ জন সাধারণ কৃষক-শ্রমিক ছাত্র-জনতা। জিয়াউর রহমানকে যে বীরউত্তম দেওয়া হয়েছে তাও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার দিয়েছে। যে সরকারে জিয়াউর রহমানের কোনো কর্তৃত্ব ছিল না। তাহলে গণবিরোধী এ রকম একজন লোককে যুদ্ধকালীন বিপ্লবী সরকার থেকে শুরু করে বাংলাদেশের স্থায়ী সরকার তাকে অত অত স্বীকৃতি দিল— সেসব সরকার কি অন্ধ, অচল, ব্যর্থ ছিল? ইতিহাস তো অন্য কথা বলে। সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং তাজউদ্দীনের নেতৃত্বের সরকার পৃথিবীতে এক সফল যুদ্ধকালীন সরকার। যারা নিরস্ত্র সংগ্রামকে সশস্ত্র যুদ্ধের রূপ দিয়ে সফলতা এনেছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনার সম্মানের সঙ্গে আমাদের সম্মান জড়িত। আপনি ভালো করলে আমাদের ভালো হয়, আপনার খারাপে আমরাও ক্ষতিগ্রস্ত হই। ওইসব কথা তো এতদিন বলেননি, তাই বিবেকের তাড়নায় কথাগুলো বললাম। কিছু মনে করবেন না। শুনেছিলাম, পড়েছিলাম, কথাই কর্তৃত্ব করে, কথাই নেতৃত্ব করে। কথাগুলো বোধহয় মিথ্যা নয়।

লেখক : রাজনীতিক।

www.ksjleague.com

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর