মঙ্গলবার, ১৩ মার্চ, ২০১৮ ০০:০০ টা

রাজনীতির পানি আর ঘোলা করবেন না

তুষার কণা খোন্দকার

রাজনীতির পানি আর ঘোলা করবেন না

নেতাজী সুভাস চন্দ্র বসুর সংক্ষিপ্ত রাজনৈতিক জীবন ঘটনার ঘনঘটায় ভরা। তিনি তাঁর দলের লোকজনকে ঘটনার ডকুমেন্ট রাখতে নিরুৎসাহিত করতেন। নেতাজী সুভাস তার সহযোদ্ধাদের বলতেন, তুমি ইতিহাস সৃষ্টি কর। ইতিহাসবিদদের দায়িত্ব ইতিহাস লেখা। তোমার সৃষ্ট ঘটনা ইতিহাসবিদরা লিখে ধন্য হবে। এখন জমানা বদলে গেছে। আমাদের দেশে বর্তমান সময়ের রাজনীতিবিদদের অনেকে রাজনীতি কতটুকু চর্চা করেন সেটি জানি না; তবে তারা ইতিহাস নিয়ে অনর্গল চর্চা করতে ভালোবাসেন। স্বাধীনতার পর থেকে রাজনীতিবিদরা ইতিহাস রচনার কাজে বেশি মনোযোগী হওয়ায় ইতিহাস যেমন সত্য থেকে অনেক দূরে সরে গেছে, তেমনি রাজনীতি তার গুণগত স্ট্যান্ডার্ড হারিয়ে স্রেফ চাটুকারিতায় পরিণত হয়েছে। রাজনীতিবিদরা যখন ইতিহাস বানাতে বসেন তখন আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে তাদের নজর থাকে গদির দিকে। ইতিহাস লেখার নামে এরা সিংহাসনের পায়া ছোঁয়ার জন্য অনর্গল হাত-পা ছুড়তে থাকেন। ভাবেন, ইতিহাসের সত্য আঁস্তাকুড়ে যাক। আমি সঠিক কায়দায় কর্তাভজন চালিয়ে যেতে পারলে আমার এমপি পদ থেকে মন্ত্রী পদে প্রমোশন পাওয়ার সম্ভাবনা উজ্জ্বল হবে। আর যদি মন্ত্রী পদে প্রমোশন না পাই তাতেও আপত্তি নেই। এমপি পদে আসীন হয়ে যে হারে ডান-বাঁ করেছি সেটি যেন ভালো ভালোই টিকে থাকে। এই আশা বুকে নিয়ে উনারা মনগড়া ইতিহাস লিখেন আর ভাবেন, গদির পায়ার কাছে বসে নিজের ভাগ্য গড়ার কাজ নিষ্কণ্টক রেখে দিন গুজরান করতে পারলে সেটাই-বা কম কিসে। আজ আমাদের চারপাশে প্রতিনিয়ত যা ঘটতে দেখছি এটি নতুন কিছু নয়। এ ধরনের আচরণ বাঙালি রাজনীতিক এবং এলিট সমাজের ঐতিহাসিক চরিত্র। ভাববেন না এটি আমার নিজস্ব ধারণা। বিশ্বাস করুন, এই ধারণা আমার কল্পনাপ্রসূত নয় কিংবা আমি নিজে থেকে বানিয়ে কিছু বলিনি। সম্রাট বাবর ‘বঙ্গালা মুলুকের’ খুব কাছাকাছি শিবির স্থাপন করে বাঙালি এলিট সমাজ সম্পর্কে যেমন ধারণা পেয়েছিলেন সেটি তার বাবরনামায় বিশদে বাখান করে গেছেন। আমি শুধু সম্রাট বাবরের ধারণা আপনাদের সামনে তুলে ধরছি। কারণ সম্রাট বাবরের সমাজবিক্ষণ বহু শতাব্দী পরেও কতখানি সত্য সেটি আমাদের সবার জানা উচিত।

সম্রাট বাবর যুদ্ধক্ষেত্রে বসে তার আত্মজীবনী বাবরনামা লিখতেন। ভারতবর্ষে অভিযান চালিয়ে বাবর যখন বিহারের শোণ নদের পাড়ে তাঁবু ফেললেন তখন তিনি বঙ্গালা মুল্লুকের অধিবাসী অর্থাৎ বাঙালি জাতি সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়েছিলেন। নদীর ওপারে বসে লোকজন মারফত তত্ত্ব-তালাশ করে বাঙালি রাজনীতিবিদ এবং সামগ্রিক বিবেচনায় বাঙালি এলিট সমাজ সম্পর্কে তিনি মোটাদাগে যে টাটকা তথ্য পেলেন সেটি তার বাবরনামায় যত্ন করে লিখে রেখে গেলেন। তিনি লিখলেন, ‘শোণ নদের ওপারে বঙ্গালা মুল্লুক। বঙ্গালা মুল্লুকে এক অদ্ভুত জাত বাস করে। বঙ্গালা মুল্লুকের বাসিন্দা বঙ্গালা জাতি নাকি কোনো নেতাকে স্থায়ীভাবে মান্য করে না। নেতার প্রতি এই জাতের একটুও আনুগত্য নাই। বঙ্গালা জাত মনে-প্রাণে সিংহাসনের পূজা করে। এক নেতা পরাজিত হয়ে নতুন নেতা সিংহাসনে বসলে ওদের সিংহাসনের প্রতি আনুগত্যে কোনো ব্যত্যয় ঘটে না। সিংহাসনে কে বসল সেটি নিয়ে বঙ্গালা জাতের মাথাব্যথা নাই। রাজার প্রতি আনুগত্যের ধার না ধরে ওরা ওদের সিংহাসন পূজা চালিয়ে যেতে থাকে। ৬০০ বছর আগে সম্রাট বাবর যা বলে গেছেন সে কথা বর্তমান সময়েও সমভাবে প্রযোজ্য। গত ৫০ বছরে বাংলাদেশের ইতিহাসের অদল-বদলের দিকে চেয়ে ভেবে-চিন্তে আপনারাই দেখুন, সম্রাট বাবরের সমাজবিক্ষণ কি এতটুকু ভুল? মোগল আমলের আগে আমাদের দেশের মানুষ তাদের রাজার স্বভাব চরিত্র এবং রাজার রাজনীতির গুণাগুণ নিয়ে সম্ভবত মাথা ঘামাত না। সে জন্য তারা রাজা রেখে সিংহাসনের পূজা করত। আজকের দিনেও রাজনীতিক এবং রাজনীতির উচ্ছিষ্টভোজি এলিট সমাজের এই আচরণের ব্যত্যয় ঘটেনি। বাংলাদেশের রাজনীতিবিদরা তাদের নেতাকে যদি নেতা বলে মানত তাহলে নেতাকে ভালো বুদ্ধি দিতে তারা দ্বিধা বোধ করত না। বর্তমান সময়ের রাজনীতিবিদরা তাদের নেতাকে দেশের মানুষের মনোভাব সঠিকভাবে জানানোর সাহস রাখে বলে আমি মনে করি না। বাঙালি এলিট সমাজ বাবরের আমলে যেভাবে সিংহাসন পূজায় মত্ত ছিল, আজও তারা সিংহাসন থেকে চোখ সরিয়ে নিজেদের বিবেক-বিবেচনাবোধ থেকে রাজনীতি কিংবা বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা করার সাহস রাখেন বলে মনে হয় না। প্রাচীনকাল থেকে আজ পর্যন্ত রাজনীতির নামে দেশে সিংহাসন পূজার রমরমা বাণিজ্য চলছে এবং ভবিষ্যৎ কত প্রজন্ম পর্যন্ত এটি চলতে থাকবে—সেটি শুধু ভবিতব্যই বলতে পারে।

বর্তমান সময়ে রাজনীতিবিদসহ দেশের এলিট সমাজ সিংহাসন পূজায় মত্ত হয়ে কেউ বন্দনাগীতি রচনায় ব্যস্ত কেউ বা প্রশংসা করতে করতে মুখে ফেনা তুলে রাজনীতির মাঠ কাঁপিয়ে দিচ্ছেন। কিন্তু একজন শাসকের নিজের জন্য চাটুকার বাহিনীর বন্দনাগীতি কি অশনি সংকেত নয়? এলিট সমাজ ক্ষমতার পালা বদল হলে ঘাঁপটি মারে তাই বলে বিপদে পড়ে খাবি খায় না। ক্ষমতার পালাবদল হলে শীতল রক্তের প্রাণীর মতো কিছুদিন শীতঘুমে থেকে নড়েচড়ে জেগে ওঠে। তারপর পদ-পদবি ধরে রাখার সুলুকসন্ধি বের করে নিয়ে ফের সিংহাসন পূজায় মত্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে শাসক দলের নেতা এবং দেশের সাধারণ মানুষকে এলিট সমাজের চাটুকারিতার মূল্য শোধ করতে হয়। অথচ দল যতদিন ক্ষমতায় থাকে কোটারি স্বার্থবাদীরা শাসককে ক্রমাগত গণতন্ত্রের পথ থেকে সরিয়ে নিয়ে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করতে থাকে। কোটারি স্বার্থবাদী এলিট সমাজ জানে, শাসক যত জনবিচ্ছিন্ন হবে, এলিট সমাজ ততই নিজেদের মতো করে তাদের মতলবি খেলা খেলতে পারবে। একজন শাসককে ঘিরে যে কোটারি স্বার্থবাদী সমাজ গড়ে ওঠে তারা গণতন্ত্রকে ভয় পায়। দেশে গণতন্ত্র থাকলে শাসককে পাঁচ বছর পরে ভোটের জন্য একবার জনগণের কাছে হাত পাততে হয়। এটি আমাদের দেশে সিংহাসন পূজারি এলিট সমাজের পছন্দ নয়। তারা জানে, শাসক যখন গণতন্ত্র চর্চার অংশ হিসেবে জনগণের কাছে ভোট চাওয়ার তাগিদ বোধ করে না তখন শাসক এবং জনগণের মধ্যে দূরত্বের ফাটল তৈরি হয়। সিংহাসন পূজারি এলিট সমাজ এমন মওকার জন্য ওতপেতে অপেক্ষা করে।

পাকিস্তান আমলে প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের মধ্য দিয়ে ক্ষমতার পালাবদল হওয়ার পরে আইয়ুব খান গদিতে থিতু হয়ে বসে দেশে মৌলিক গণতন্ত্র চালু করেছিলেন। মৌলিক গণতন্ত্র প্রকৃত গণতন্ত্র এই ধারণা আমাদের গেলানোর জন্য আইয়ুব খানের পক্ষে ওকালতি করার জন্য একদল তাঁবেদার কি এই দেশে জন্ম নেয়নি? তাই বলে মৌলিক গণতন্ত্রকে কি আমরা গণতন্ত্র বলে মেনে নিয়েছিলাম? মৌলিক গণতন্ত্রকে আমরা গণতন্ত্র বলে মেনে নিতে পারিনি বলেই আমরা পার্লামেন্টারি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করেছিলাম। ১৯৭১ সালে বাঙালি নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ মেনে নিয়েছে কিন্তু পাকিস্তানের গণতন্ত্রবিহীন স্বৈরশাসন মাথা পেতে মেনে নেয়নি। অর্থাৎ বাঙালির গণতন্ত্র পাওয়ার আকাঙ্ক্ষার চরম বহির্প্রকাশ ঘটেছিল স্বাধীনতা যুদ্ধের মধ্য দিয়ে। ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয় পাকিস্তানিরা মেনে না নেওয়ায় পাকিস্তানে গণতন্ত্রের অন্তিম ঘণ্টা বেজে উঠেছিল। গণতন্ত্র পাওয়ার আশা নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার কারণে বাঙালি হতাশ না হয়ে মুক্তির সংগ্রাম শুরু করেছিল। অর্থাৎ গণতন্ত্র চর্চার প্রত্যাশা বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের একটি নিয়ামক। বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল পার্লামেন্টারি গণতন্ত্র চর্চার প্রতিশ্রুতি নিয়ে। অথচ ১৯৭৫ সালে আওয়ামী লীগ বাকশাল প্রতিষ্ঠা করে দেশে গণতন্ত্র চর্চার পথ রুদ্ধ করে দিয়েছিল। পাকিস্তানের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা জানি, যে দেশে গণতন্ত্র চর্চার পথ রুদ্ধ হয় সেখানে প্রাসাদ ষড়যন্ত্র দানা বাঁধতে সময় লাগে না। ১৯৭৫ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি বাকশাল গঠনের পর ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা পর্যন্ত বাকশাল সামান্য কয়েক মাস ক্ষমতায় ছিল। অথচ এই কয়েক মাসের মধ্যে বাকশালে প্রাসাদ ষড়যন্ত্র কি ভয়ানক দানা বেঁধেছিল। প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের নেতৃত্বে ছিলেন বাকশাল নির্বাহী কমিটির পাঁচ নম্বর সদস্য খন্দকার মোশতাক আহমেদ। বাকশাল কেন্দ্রীয় কমিটির ২৭ নম্বর সদস্য তাহেরউদ্দিন ঠাকুরও ষড়যন্ত্রকারীদের একজন। বাকশাল নেতৃত্বের আরও কতজন বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে সক্রিয় অংশ নিয়েছিল আর কতজন নীরবে সমর্থন দিয়েছিল সেই সত্য সবটা জানা সম্ভব হয়নি। তবে বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর বাকশালের বহু নেতা ডিগবাজি খেয়ে বিএনপিতে গিয়েছিল সে তালিকা কৌতূহলী পাঠক গুগলে সার্চ দিয়ে জেনে নিতে পারেন।

আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশের বুদ্ধিজীবী সমাজকে মাঝে মাঝে উপহাস করেন। তাঁর এই উপহাস অত্যন্ত যৌক্তিক বলেই মনে হয়। একবারের বিরতিসহ বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ১৫ বছর ধরে দেশ চালাচ্ছেন। সুদীর্ঘ সময় দেশের প্রধানমন্ত্রী থাকার সুবাদে তিনি জানেন বুদ্ধিজীবী সমাজের কত অংশ সৎ আর কতজন ইন্টেলেকচ্যুয়াল প্রোস্টিটিউশনে মেতে আছে। সে কারণে তিনি বুদ্ধিজীবীদের কাজকর্মকে নির্মম ভাষায় পরিহাস করেন। গণতন্ত্রের প্রতি অবিচল থাকার মতো সাহসী মানুষ আমাদের বুদ্ধিজীবী সমাজে বিরল। কাজেই সেখানেও আশার আলো নিভে গেছে।

আসন্ন সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে দেশে রাজনীতির পানি এখন বেজায় ঘোলা। এত ঘোলা পানিতে কে শিকার কে শিকারি চিনে নেওয়া বড় দায় হয়ে গেছে। রাজনীতির পানি আর বেশি ঘোলা হতে দেওয়া উচিত হবে না। একটা দেশের জন্য নিয়মিত অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচন চর্চা রাজনীতিতে ফিটকিরির কাজ করে। দেশে নিয়মিত নির্বাচন হলে রাজনীতির ঘোলা পানি স্বচ্ছ হতে সময় লাগবে না। কে নির্বাচিত হবেন সেটি বড় কথা নয়। দেশে নির্বাচন হলে রাজনীতিবিদরা জনগণের দুয়ারে যাবেন। সেই সঙ্গে সিংহাসন পূজারি চাটুকার বাহিনী সিংহাসন থেকে চোখ সরিয়ে জনগণের মুখের দিকে তাকাবেন। আশা করি, আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি উভয় দলই রাজনীতির পানি আর ঘোলা না করে একটি অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য আন্তরিক চেষ্টা চালাবে।

লেখক : কথাসাহিত্যিক।

 

সর্বশেষ খবর