শুক্রবার, ১৬ মার্চ, ২০১৮ ০০:০০ টা

দেশ ও জাতি থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা মুক্তচিন্তা নয়

মইনুল হোসেন

দেশ ও জাতি থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা মুক্তচিন্তা নয়

কী পরিস্থিতিতে ড. জাফর ইকবাল আক্রান্ত হলেন এবং এই দুর্ভাগ্যজনক ঘটনার মোটিভই বা কী এ ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত নই। তিনি একজন মুক্তচিন্তার অধিকারী বলে আমরা জানি। ধর্মীয় উগ্রপন্থিদের হুমকির মুখে তাকে সরকারের পুলিশি নিরাপত্তা প্রদান করার দরকার হয়। মুক্তচিন্তার অধিকারী কিন্তু ইসলামী চিন্তার পরিপন্থী কেউ কেউ এই ধর্মীয় উগ্রপন্থিদের হাতে নিহত হয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।  সাধারণ মুসলমানরাও মৌলবাদী মুসলমানদের বিষয়ে চিন্তিত। তবুও মুসলমানরা উগ্রপন্থাকে উগ্রপন্থা দ্বারা মোকাবিলা করা সমর্থন করতে পারেন না। আশ্চর্যের বিষয় যারা নিজেদের মুক্তচিন্তার অধিকারী বলে দাবি করেন তারা অগ্রাধিকার হিসেবে ইসলামের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। আমাদের মুক্তজীবন ও স্বাধীনতার ক্ষেত্রে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা আছে, যা নিয়ে প্রকৃত মুক্তচিন্তার অধিকারীরা উদ্বিগ্ন ও সম্পৃক্ত না হয়ে পারেন না। কিন্তু এসব ব্যাপারে তাদের সেই সম্পৃক্ততা দেখা যায় না।

একজন মুক্তচিন্তার অধিকারী তাকেই বলা যায়, যিনি স্বাধীনভাবে যুক্তিসঙ্গত ভিত্তির ওপর চিন্তা-ভাবনা করেন এবং সেভাবে নিজস্ব মতামত গঠন করেন। যে চিন্তার উদ্দেশ্য অন্যের একান্ত ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করা এবং ধর্মীয় অরাজকতাকে উসকানি দেওয়া তাকে মুক্তচিন্তা বলা যায় না। মুক্তচিন্তাকে উদার মন-মানসিকতার বিষয় হিসেবেই আমরা দেখতে চাই। যিনি মুক্তচিন্তার অধিকারী তার নিশ্চয়ই বিশেষ কোনো মতবাদকে বা ধর্মকে পরিত্যাগ করার স্বাধীনতা থাকে। তাই বলে কারও জন্য অপমানজনক বা উত্তেজক কোনো মত সুস্থ চিন্তা হতে পারে না। যিনি মুক্তচিন্তার অধিকারী তার অবশ্যই অন্যের চিন্তা, বিশ্বাস ও মতের প্রতি সহনশীল হওয়া উচিত। ন্যায়সঙ্গতভাবে একজন মুক্তচিন্তার অধিকারী মানুষ অন্যের মতের ওপর প্রাধান্য দাবি করতে পারেন না এবং অন্যের চিন্তা ও বিশ্বাসের প্রতি অসহিষ্ণুতা দেখাতে পারেন না।

একজন মুক্তচিন্তক যদি মুক্তচিন্তাকে তার অধিকার বলে দাবি করেন সেক্ষেত্রে তার এটাও চিন্তা করা উচিত যে, সব অধিকারেরই একটা সীমাবদ্ধতা আছে। কোনো সামাজিক ব্যক্তিই অন্যের চিন্তায় হস্তক্ষেপ করার জন্য নিজেকে মুক্তচিন্তক বলে দাবি করতে পারেন না। কোনো অধিকারই একতরফাভাবে পূর্ণাঙ্গ হতে পারে না। মার্কিন পণ্ডিত মেরি এ্যান গ্লেনডনের মতে এ ধরনের মতবাদ একচ্ছত্র মতবাদেরই ছায়া মাত্র। তিনি খুব বিরাট পণ্ডিত না হতে পারেন, কিন্তু তার ব্যাখ্যার এই বাস্তব দিকটি অনস্বীকার্য যে, একজন আরেকজনের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের প্রয়োজনে অন্যের বিশ্বাসের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা অবশ্যই সমাজের দাবি।

দ্বিমত করার কোনো কারণ নেই যে, ধর্ম হলো একটা বিশ্বাস এবং স্বর্গীয় জ্ঞানের বিষয়। একজন ধর্মে বিশ্বাস করতেও পারেন নাও করতে পারেন। আমি মনে করি না ধর্ম নিয়ে যৌক্তিক গবেষণা চালানো সম্ভব। কারণ ধর্ম হলো বিশ্বাসের ব্যাপার এবং এ জ্ঞান ঐশ্বরিক। তবে ধর্ম নিয়ে ধর্মীয় লাইনে গবেষণা হতে পারে।

একজন আন্তরিক চিন্তকের ক্ষেত্রে আমি গুরুত্ব দিয়ে বলব যে, বর্তমান যুগে শান্তি ও প্রগতির বিকাশে ধর্ম কোনো বাধা হতে পারে না। আমাদের দেশের ধর্মীয় মৌলবাদ অগ্রগতির পথে কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে না। সম্পদ ও ক্ষমতার নীতি-চরিত্রবিবর্জিত লোভই আমাদের উন্নতি-অগ্রগতির পথে প্রধান অন্তরায়। অপরিসীম মূল্য ও ত্যাগের বিনিময়ে আমরা যে স্বাধীনতা অর্জন করেছি একশ্রেণির স্বার্থান্বেষী বুদ্ধিমান ব্যক্তির ষড়যন্ত্রের কারণে তা ব্যর্থ হতে চলেছে। কর্তৃত্ববাদী শাসকদের একগুঁয়ে চিন্তা অগণতান্ত্রিক শাসনকে ইন্ধন জোগায় এবং দেশকে রক্তক্ষয়ী সংঘাতের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। একটি কায়েমি স্বার্থবাদী শ্রেণির হাতে পড়ে দেশ থেকে গণতন্ত্র, নীতি-চরিত্র ও সহনশীলতার মূল্যবোধ হারিয়ে যাচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যেন তাদের নিজস্ব খেয়াল-খুশি মতো দেশ চালানোর চিরস্থায়ী অধিকার। তাদের কাছে জনগণ বা জনগণের মতামতের কোনোই মূল্য নেই। মুুক্তচিন্তার অধিকারীরা শুধু ধর্মীয় বিশ্বাসের বিরোধী হবেন কেন? সব ধরনের অন্যায়ের ব্যাপারে প্রতিবাদী হবেন না কেন?

মুক্তচিন্তার অধিকারীদের পক্ষ থেকে দেশের স্বাধীনতা বা জনগণের অধিকার নিয়ে জোর গলায় কোনো কিছু বলতে দেখা যায় না। দেশের লাগামহীন দুর্নীতি বা স্বৈরশাসন সম্পর্কেও তাদের মুখ থেকে কোনো কথা বের হয় না। সরকারের চরম ব্যর্থতাকে লুকিয়ে রাখার মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে তাদের কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। তাদের যত মাথাব্যথা ইসলামকে নিয়ে। জনগণের অধিকার, সুবিচার বা কল্যাণের বিষয়টি তাদের চিন্তায় গুরুত্ব পায় না। মুক্তচিন্তার অধিকারের কথা বললে এটাও স্বীকার করতে হবে যে, ইসলাম সম্পর্কে নিন্দা করা বা অবমাননামূলক মন্তব্য সর্বজনীন ধর্মীয় অধিকারের সরাসরি লঙ্ঘন। কারও ধর্মকে অবমাননা করা মুক্তচিন্তার অধিকার মুক্তচিন্তকদের এমন দাবি কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। তাদের চিন্তা উদ্দেশ্যমূলক মনে হওয়াই স্বাভাবিক।

সৃষ্টিকর্তার প্রতি অবিশ্বাসভিত্তিক সমাজতন্ত্র হলো বামপন্থি চিন্তাধারা এবং এই চিন্তার অনুসারীরা ধর্মের যৌক্তিক অস্তিত্বে অবিশ্বাসী। কমিউনিস্ট চিন্তাধারায় মুক্তচিন্তারও কোনো সুযোগ নেই। সুতরাং কেউ যদি বামপন্থি রাজনীতির চর্চা করতে চান, তবে তা প্রকাশ্যে করা ভালো। মুক্তচিন্তা নিশ্চয়ই সিচন্তা, কোনোভাবেই প্রতারণার বিষয় হতে পারে না। বামপন্থি রাজনীতির ছদ্মাবরণে মুক্তচিন্তার অধিকার দাবি সততা নয়।

একজন মুক্তচিন্তক আরেকজনের মুক্তচিন্তায় বিশ্বাস করবেন না, মুক্তচিন্তকদের এটাও এক ধরনের স্ববিরোধিতা। ব্লগাররাই আমাদের জনগণের ধর্মীয় মূল্যবোধে আঘাত করছে। কারও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার পেছনে কী ধরনের উচ্চমার্গের চিন্তা-চেতনা থাকতে পারে তা বোধগম্য নয়। কিন্তু আমাদের সরকার এই ব্লগারদেরই বিশেষ নিরাপত্তা দিয়ে থাকে। একজন মানুষের জীবনের নিরাপত্তা দেওয়া অবশ্যই সরকারের দায়িত্ব। তবে যারা কথা বলার অধিকার বা বাকস্বাধীনতার চর্চা করতে চায় তাদেরও নিরাপত্তা দিন। তাদের জন্য বন্দুকধারীদের নিরাপত্তার প্রয়োজন হবে না। সরকার অভয় দিলেই হবে। মৌলবাদী বামপন্থিরা মুক্তচিন্তার স্লোগানকে কর্তৃত্ববাদী স্বৈরশাসনকে জায়েজ করে সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে ধর্মীয় উগ্রবাদকে উসকানি দেওয়ার কাজে ব্যবহার করে থাকে। গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে মানুষকে বঞ্চিত করার ক্ষেত্রে কর্তৃত্ববাদী শাসনকে সহায়তা করাই যেন তাদের কাজ।

মুক্তচিন্তার নামে ধর্মীয় উগ্রবাদকে যারা উসকানি দেয় তাদের সম্পর্কে আমাদের সবার সতর্ক থাকতে হবে। ষাটের দশকে ড. সুকার্নোর শাসন আমলে কমিউনিস্ট অভ্যুত্থানে রক্তের হোলিখেলার ঘটনা এক্ষেত্রে স্মরণ করা যেতে পারে।

বহির্বিশ্বে বাংলাদেশকে বলা হয় মডারেট মুসলিম রাষ্ট্র। এ কথা সত্য, আমাদের মধ্যেও কিছু ধর্মীয় উগ্রবাদী রয়েছেন। যদিও সব ধর্মেই এ ধরনের উগ্রবাদের অস্তিত্ব কমবেশি বিদ্যমান। অন্যদের দ্বারা প্ররোচিত না হলে তাদের ব্যাপারেও শান্তি ও সহনশীলতায় ইসলামী মূল্যবোধ নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। তবুও ইসলামে বিশ্বাসীদের কোনোভাবেই ব্লগারদের দ্বারা প্ররোচিত হওয়া উচিত নয়। বাংলাদেশে যেসব ব্লগার বিভিন্নভাবে ইসলামের বিরুদ্ধে হিংসা-বিদ্বেষ প্রচার করে এদের প্রায় সবাই বামপন্থি। অবিশ্বাসী হওয়ার জন্য কোনো বিশ্বাসী মুসলমানের ওপর হামলার কোনো নজির নেই। ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসীরাও মনে করেন ধর্ম যার যার ব্যক্তিগত পছন্দের বিষয়।

অতীতে আমরা সব ধর্মে বিশ্বাসীরা শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান করে আসছিলাম। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর কিছু লোক ভারত থেকে এসে নিজেদের মুক্তিযোদ্ধা দাবি করে ইসলামকে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু বানায়। তাদের মতে ধর্মই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির প্রধান বাধা। দেশের আর কোনো সমস্যা নয়। তারা সরকারের অংশীদার এবং সরকারের পক্ষ থেকে বিশেষ নিরাপত্তাভোগী। তারা নিজেদের মুক্তিযোদ্ধা বলে প্রচার করেন। অন্যদের স্বাধীনতায় তারা বিশ্বাস করেন না।

সাধারণ মুসলমানদের অভিযোগ হলো, এই ব্লগাররা ইসলামবিরোধী পশ্চিমা শক্তিসমূহের পক্ষে কাজ করেন। পশ্চিমাদের ভাষায়ই তারা ইসলামের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ প্রচার করেন। পশ্চিমা বিশ্বে নিজেদের প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার সহজ পথ হিসেবে তারা ইসলামকে বিতর্কিত করার পন্থা বেছে নিয়েছেন।

আমরা উগ্র বামপন্থাকে নিরুৎসাহিত করি, পাশাপাশি ইসলামী গোঁড়াপন্থিদের অশান্তি সৃষ্টিরও নিন্দা করি। মুক্তচিন্তকদের কোনোভাবে অন্যদের হাতের পুুতুল হিসেবে ব্যবহূত হতে দেখতে চাই না। জাতীয় স্বার্থে, জাতীয় স্বাধীনতা ও জনগণের অধিকার রক্ষায় মুক্তচিন্তার অধিকারী ব্যক্তিদের গঠনমূলক ভূমিকার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছি। ব্যক্তির অধিকার হরণকারী রাজনৈতিক গোঁড়ামিই আমাদের দেশের উন্নতি ও অগ্রগতির পথে বিরাট বাধা।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারক-বাহক হয়ে যারা জনগণকে অধিকারহীন করছেন তাদের ব্যাপারে মুক্তচিন্তার লোকেরা নীরব থাকতে পারেন না। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ছিল সমগ্র জনগণের। যারা মুক্তিযুদ্ধের নাম অহরহ ব্যবহার করছেন তাদের কয়জনের কী ভূমিকা ছিল স্বাধীন চিন্তার লোকেরা তো স্বাধীনভাবে তা বলতে পারেন। মু্ক্তচিন্তার অধিকারীদের দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থ রক্ষার ব্যাপারে অংশীদার হতে হবে। এ দেশ তো তাদেরও। সবার জন্য স্বাধীন ও সুন্দর জীবন গড়া তো মুক্তচিন্তার অধিকারী ব্যক্তিদের সবিশেষ দায়িত্ব হওয়া উচিত। ব্যক্তির স্বাধীনতা ও অধিকার হরণকারীদের সহযোগী হওয়া সিচন্তার লোকদের গর্ব হতে পারে না।  তরুণদের বিপদগামী হওয়া থেকে রক্ষা করা নিশ্চয়ই মহৎ দায়িত্ব।  কিন্তু দেশকে বিপদগামী হতে দিলে যে আমরা সবাই বিপদে থাকি, সে বিষয়টি মুক্তচিন্তার লোকদের কাছে গুরুত্ব পেলে জাতি উপকৃত হতো।

            লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা।

সর্বশেষ খবর