শুক্রবার, ১৬ মার্চ, ২০১৮ ০০:০০ টা
স্মরণ

আমার গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি সেই শ্রেষ্ঠ মানুষটির প্রতি

এমাজউদ্দীন আহমদ

আমার গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি সেই শ্রেষ্ঠ মানুষটির প্রতি

বন্ধুবর খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন সম্পর্কে লিখতে বসেই মনে পড়ে তার সততার কথা। তার দৃঢ়চিত্তের কথা, তার সহজ সরল জীবনের কথা। স্মরণ করি একজন অকৃত্রিম বন্ধুর কথা।  ইংরেজি সাহিত্যের শ্রেষ্ঠতম দিকপাল উইলিয়াম শেকসপিয়র (William Shakes Peare) তার As You Like It নাটকের পঞ্চম অ্যাক্টের এক লাইনে লিখেছেন : “The fool doth think he is wise, but the wise man knows himself to be fool.” [‘একজন মূঢ় নিজেকে মনে করে জ্ঞানী হিসেবে কিন্তু জ্ঞানী ব্যক্তি নিজেকে কখনো প্রাজ্ঞ বা জ্ঞানী বলে জাহির করে না’] সংকটের পরশমণিই কোনো নেতার চরিত্রের বৈশিষ্ট্য সুনির্দিষ্ট করে থাকে। সংকটকালেই নেতার সঠিক নেতৃত্বের দলটি একটার পর একটা বিকশিত হয়। খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনের রাজনৈতিক জীবনেরও সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল কালের সূচনা হয় রাজনৈতিক দল হিসেবে বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী দল যখন কঠিন দুর্যোগকালে অবৈধ তত্ত্বাবধায়ক সরকার কর্তৃক দেশনেত্রী খালেদা জিয়ার গ্রেফতার হওয়ার সময় দেশের এ বৃহত্তম রাজনৈতিক দলের মহাসচিবের দায়িত্ব গ্রহণের পর। সেই অবৈধ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দেশকে বিরাজনীতিকরণ এবং ‘মাইনাস টু’ (Minus two) করার হীন ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে বিশেষ করে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে রাজনীতি থেকে অপসারণের লক্ষ্যে তাকে, তারেক রহমান, আরাফাত রহমানসহ বিএনপির জনপ্রিয় নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার করে তাদের ওপর অমানবিক নির্যাতন শুরু করে। বেগম খালেদা জিয়াকে বাদ দিয়ে বিএনপির তৎকালীন মহাসচিব মরহুম আবদুল মান্নান ভূঁইয়া দলীয় সংস্কারের যে প্রস্তাব উপস্থাপন করেন ওই সংকটময় মুহূর্তে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনকে বিএনপির মহাসচিব হিসেবে নিয়োগদান করেন এবং গ্রেফতার হওয়ার প্রাক্কালে, সময়টা এমন ছিল যে দেশের বিভিন্ন মহল, সংস্থা, সরকারের শত প্রলোভন এবং উপরোধ ছিল খোন্দকার দেলোয়ারকে বেগম জিয়ার নেতৃত্বের মূলধারা থেকে সরিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে। এমন চাপ সৃষ্টি করা হয়েছিল যে, তিনি নিজেই অস্থির হয়ে পড়েছিলেন এবং অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী হন। সে অবস্থায়ও তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, আমি মরে যাব তবুও খালেদা জিয়ার পক্ষ ত্যাগ করব না। আমার ওপর অর্পিত দায়িত্ব আমি পালন করব। ওই সময় এমন ঘোষণা তাকে নেতৃত্বের এমন এক স্তরে উন্নীত করে যা ছিল অনেকটা হিমালয়তুল্য। সৎ চিন্তা প্রণোদিত, যথার্থ রূপে রাজনৈতিক। ওই সময় তার সুযোগ্য নেতৃত্বের অভিব্যক্তি জাতীয়তাবাদী দলের সব সদস্য শুধু অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখেছিলেন তাই নয়, তার সাহস, তার ধৈর্য, তার বিচক্ষণতায় বিমুগ্ধ হয়ে দলের সদস্যরা তাকে অভিনন্দন জানিয়ে তার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে শর্তহীনভাবে তার কাছে ছুটে গিয়েছিলেন। যখন বেগম খালেদা জিয়া জেল থেকে বেরিয়ে এলেন তার আগ পর্যন্ত খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনই ছিলেন দলের নেতা। দলের মুখপাত্র, দলের দিকনির্দেশক। দলের প্রাণপুরুষ।

খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনের সারাটা জীবন সংশ্লিষ্ট ছিল জাতীয় রাজনীতির সঙ্গে। রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে তিনি আত্মপ্রকাশ করেন ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনকালে। একজন যোগ্যতর কর্মী হিসেবে। ১৯৭০ সালে ন্যাপের (NAP) প্রার্থী হিসেবে সংসদের নির্বাচনে তিনি অংশগ্রহণ করেন। তার নির্বাচনী এলাকা ঘিওর-দৌলতপুর থেকে তিনি নির্বাচিত হন। দ্বিতীয়, পঞ্চম, ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম জাতীয় সংসদে। তিনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য পদটি অলংকৃত করেন। তিনি জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ রূপে দায়িত্ব পালন করেন। শেকসপিয়রের Much Ado About Nothing নাটকের তৃতীয় অঙ্গে যা লিখিত হয়েছে বন্ধুবর খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন সম্পর্কেও আমি তা-ই বলতে চাই। শেকসপিয়র লিখেছেন :

From the crown of his head to the

sole of his foot, he is all mirth;

he is all people. [তার মাথার মুকুট থেকে শুরু করে জুতার তলা পর্যন্ত সবটুকু ছিলেন আনন্দোচ্ছলতা : জনগণের আনন্দোচ্ছ্বাস।]

বাংলাদেশের রাজনীতির এ উজ্জ্বল নক্ষত্র বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সম্মেলনে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনের জন্য ফ্রান্স, জাপান, সুইডেন, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, শ্রীলঙ্কা এবং ভারত সফর করেন। দেশসেবা, জনসেবা এবং জাতীয়তাবাদী চেতনা বিস্তারে বিদেশে-বিভুঁইয়ে যেমন ছুটেছেন তেমনি নিজের নির্বাচনী এলাকা ঘিওর-মানিকগঞ্জে শিক্ষা বিস্তার, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, চিকিৎসা, বিদ্যুৎ, কৃষি উন্নয়নে ব্যাপকভিত্তিক ভূমিকা গ্রহণ করেন। মসজিদ-মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা, মঠ-মন্দির তৈরি করে হয়ে উঠেছিলেন সবার চোখের মণি। লাখ লাখ মানুষের শ্রদ্ধা, ভালোবাসা এবং আবেগে সিক্ত হয়ে তিনি না ফেরার দেশে চলে গেছেন, কিন্তু আজও তিনি বেঁচে আছেন অসংখ্য মানুষের মনের মণিকোঠায়। তাকে শ্রদ্ধা জানানোর শ্রেষ্ঠতম পন্থা হলো তার সাহস, সৃজনশীলতা এবং অত্যন্ত উঁচুমানের মননশীলতাকে অনুসরণ করা, তার পদাঙ্ক অনুসরণ করা, তার পদাঙ্ক অনুসরণ করে রাজনীতিকে জনকল্যাণের উত্তম যৌথ কর্ম হিসেবে গ্রহণ করা।

 

আমার সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। বয়সের সমতা হয়তো পরস্পরকে কাছে টানার পক্ষে ছিল। ভাই বলে উভয় উভয়কে সম্বোধন করতাম। সংকটকালে যখন তিনি অসুস্থ অবস্থায় সেই জটিল দায়িত্ব পালন করেছিলেন, তখন কতবার যে তার হাতে হাত দিয়ে বলেছি, ‘ভাই আপনি সঠিক পথে আছেন। দেখবেন আল্লাহতায়ালা আপনার উদ্যোগকে সাফল্যমণ্ডিত করবেন। যেদিন তিনি চলে গেলেন, তখন মনে হয়েছিল আমার নিজের ভাই যেন শান্তির অন্বেষায় চলে গেছেন।  ভীষণভাবে মুষড়ে পড়েছিলাম। তারপরেও মনে হয়েছিল আল্লাহতায়ালা যেন ক্লান্ত, শ্রান্ত মানুষটাকে আপন ছায়ায় শান্তির নিলয়ে নিয়ে গেছেন। তিনি থাকুন চির শান্তির শ্রেষ্ঠতম আলয়ে।

লেখক : প্রফেসর ইমেরিটাস, সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

সর্বশেষ খবর