বৃহস্পতিবার, ২৯ মার্চ, ২০১৮ ০০:০০ টা
মানবাধিকার

সবার জন্য আবাসন

খন্দকার আখতারুজ্জামান

সবার জন্য আবাসন

মানুষের মৌলিক চাহিদার মধ্যে অন্যতম হলো আবাসন। আবাসন মানুষকে আশ্রয়, নিরাপত্তা ও সামাজিক মর্যাদা প্রদান করে, একান্তে বসবাসের সুযোগ করে দেয় এবং স্বাস্থ্য ও স্বাচ্ছন্দ্য প্রদান ছাড়াও কর্ম ও উপার্জনের ভিত্তি রচনা করে। সব নাগরিকের জন্য মানসম্মত গৃহায়ণের ব্যবস্থা করা রাষ্ট্রের একটি সাংবিধানিক দায়িত্ব। সবার সাধ্যের মধ্যে পরিকল্পিত আবাসনের ব্যবস্থা করতেও সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। নিম্ন আয়ের দেশ থেকে বেরিয়ে এসেছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ এখন মধ্যম আয়ের দেশের তালিকায়, তাই সবার জন্য সাধ্যের আবাসন গুরুত্ব পাচ্ছে সর্বাগ্রে। এ ব্যাপারে বেসরকারি আবাসন খাতকে সরকার নানাভাবে উৎসাহিত করছে। সরকারি উদ্যোগেও স্বল্প আয়ের মানুষের আবাসন সমস্যার সমাধানে নেওয়া হয়েছে নানামুখী পদক্ষেপ।

দেশের শতকরা ৭২ ভাগ লোক গ্রামাঞ্চলে বসবাস করে এবং মোট ঘরের শতকরা ৮১ ভাগ গ্রামে অবস্থিত। গ্রামীণ জনগণ সাধারণত নিজেদের উদ্যোগে ঘরবাড়ি নির্মাণ করে আসছে। গ্রামাঞ্চলের শতকরা ৮০ ভাগ ঘরের অধিকাংশই কাঠামোগত দিক থেকে নিম্নমানের। জনসংখ্যার ক্রমবৃদ্ধিতে প্রতি বছর গ্রামাঞ্চলে বিপুলসংখ্যক আবাসন চাহিদা সৃষ্টি হয়, ফলে যত্রতত্র বসতি গড়ে উঠছে কৃষিজমিতে। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বাংলাদেশে গড়ে প্রতিদিন ২৩৫ হেক্টর আবাদযোগ্য জমি হারিয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ গত ২৫ বছরে দেশ ৬০ লাখ একর ফসলি জমি হারিয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে অচিরেই খাদ্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা ঝুঁকির মধ্যে পড়বে এবং বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে হবে।

গ্রামের তুলনায় দেশের শহরাঞ্চলে জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে বিশেষ করে গুটিকয় মহানগরী ও বড় শহরে বাড়তি জনসংখ্যার ক্রমবর্ধমান চাপ পুঞ্জীভূত হচ্ছে।

বাংলাদেশের শহরাঞ্চলে অবস্থিত আবাসন কাঠামোর মধ্যে পাকা কাঠামো ২৭.৬৭ শতাংশ, সেমিপাকা কাঠামো ২৮.৯২ শতাংশ ও অবশিষ্ট ৪৩.৪১ শতাংশ কাঁচা/অস্থায়ী ধরনের। মোট জনসংখ্যার উল্লেখযোগ্য একটা অংশ বস্তি ও ঘিঞ্জি এলাকায় বসবাস করতে বাধ্য হচ্ছে।

সরকারি হিসাবমতে, ১৯৯৩ সালে গৃহায়ণ ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৩১ লাখ ইউনিট। ২০০০ সালে উক্ত ঘাটতি ছিল ৫০ লক্ষাধিক ইউনিট। ২০০১ সালে শুধু নগর এলাকায় গৃহায়ণ ঘাটতি ছিল ১.১৩ মিলিয়ন ইউনিট, ২০১০ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৪.৬ মিলিয়ন ইউনিট। অনুমান করা যায় যে, ২০২১ সাল নাগাদ নগর এলাকায় গৃহায়ণ ঘাটতি হবে ৮.৫ মিলিয়ন ইউনিট। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে, ১৯৬১ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত দেশের জনসংখ্যা ৫৫ মিলিয়ন থেকে বেড়ে ১৫৫ মিলিয়ন হয়েছে, বিপরীতে নগর জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে ২.৬ মিলিয়ন থেকে ৪৩.৪৩ মিলিয়ন। এ হারে জনসংখ্যা বাড়তে থাকলে ২০৫০ সাল নাগাদ মোট জনসংখ্যার ৫০%-এরও বেশি নগর এলাকায় বসবাস করবে। বিপুলসংখ্যক এই জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে আবাসনসহ নগর পরিসেবার চাহিদা বহুলাংশে বৃদ্ধি পাবে।

‘জাতীয় গৃহায়ণ নীতিমালা-২০১৬’-এর লক্ষ্য হলো সর্বস্তরের মানুষের জন্য উপযুক্ত গৃহায়ণব্যবস্থা সহজলভ্য করা ও বসতিসমূহের উন্নতি সাধন করা, যাতে টেকসই উন্নয়ন ও সমতার ভিত্তিতে আবাস ও কর্মস্থলের পরিবেশ উন্নত হয় এবং সবাই স্বাস্থ্যকর, নিরাপদ ও সাশ্রয়ীমূল্যে ন্যূনতম সেবা ও সুযোগসমূহ পায় এবং সবার সমান অধিকার সংরক্ষিত হয়।

স্বল্প, নিম্ন, মধ্যম আয়ের জনগোষ্ঠী, শহরের বস্তিবাসী ও দুস্থ জনগণের জন্য বাসস্থান তৈরি করতে জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে আবাসন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। ‘টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা’ অর্জন ও ‘জাতীয় গৃহায়ণ নীতিমালা-২০১৬’ বাস্তবায়নে চলমান কর্মকাণ্ড বিশেষ ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা হচ্ছে।

জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ স্বল্প আয়ের জনগণের জন্য আনুমানিক ৪০ হাজার ফ্ল্যাট নির্মাণ করেছে। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে জাগৃক কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন অংশীদারিত্বভিত্তিক ‘স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য উন্নত জীবনব্যবস্থা প্রকল্প’ বাংলাদেশের শহর এলাকায় বসবাসরত বিধিবহির্ভূত ও নিম্ন আয়ের জনবসতির জীবনমান উন্নয়নের যুগোপযোগী পদক্ষেপ। বস্তিবাসীদের জন্য আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসংবলিত বহুতলবিশিষ্ট ভাড়াভিত্তিক আবাসিক ফ্ল্যাট প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে, যা বস্তিবাসীর আবাসন সমস্যা সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এ ছাড়া দ্রুত সময়ের মধ্যে আবাসন চাহিদা পূরণকল্পে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ পদ্ধতি অনুসরণ করে সাশ্রয়ীমূল্যের আবাসন প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ শুরু করা হয়েছে।

বাংলাদেশ আজ স্বল্প আয়ের দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশের মর্যাদা অর্জন করেছে এবং ২০৪১ সাল নাগাদ উন্নত দেশে উন্নীত হবে। উন্নয়নের এ প্রেক্ষাপট ও প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা ‘সবার জন্য আবাসন/কেউ গৃহহীন থাকবে না’ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সরকারি-বেসরকারি খাতকে একযোগে কাজ করতে হবে।

লেখক : কলামিস্ট।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর