শিরোনাম
শনিবার, ৩১ মার্চ, ২০১৮ ০০:০০ টা

পরিবর্তিত কৃষির জন্য কৃষককে প্রস্তুত করতে হবে

শাইখ সিরাজ

পরিবর্তিত কৃষির জন্য কৃষককে প্রস্তুত করতে হবে

যে ধলেশ্বরী এদ্দিন মানিকগঞ্জের কৃষি ও কৃষকের আশীর্বাদ ছিল, সেই ধলেশ্বরীই অভিশপ্ত হয়ে উঠেছে মানিকগঞ্জের কৃষকের কাছে। কারণ শিল্পকারখানার বর্জ্য ধ্বংস করে দিচ্ছে নদীটিকে। পানিদূষণের পাশাপাশি দূষিত হচ্ছে পরিবেশ, মাটি, আবাদি জমি। এর মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে কৃষকের স্বাস্থ্যের ওপর। এ ছাড়া গজারিয়া বিলের পানি নিষ্কাশিত না হওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বীজতলা। এ অভিযোগ মানিকগঞ্জের কৃষকদের।

হৃদয়ে মাটি ও মানুষের উদ্যোগে প্রাক-বাজেট আলোচনা ‘কৃষি বাজেট কৃষকের বাজেট’-এর এ বছরের দ্বিতীয় আয়োজন ছিল মানিকগঞ্জের জাগীর ইউনিয়ন পরিষদ প্রাঙ্গণে। উপস্থিত ছিলেন প্রায় তিন হাজার কৃষক ও কৃষির সঙ্গে সম্পৃক্ত বিভিন্ন পেশার মানুষ। উপস্থিত ছিলেন আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী জাহিদ মালেক স্বপন, মানিকগঞ্জ জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট গোলাম মহিউদ্দিন, অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট পঙ্কজ ঘোষ, জাগীর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মো. জাকির হোসেন, মানিকগঞ্জ পৌরসভার সাবেক মেয়র মো. রমজান আলী, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. হাফিজুর রহমান, পল্লীবিদ্যুতের ডিজিএম মো. বদরুল আলম, বিএডিসির ক্ষুদ্র সেচ প্রকল্পের সহকারী প্রকৌশলী মো. মোক্তার হোসেনসহ সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শীর্ষস্থানীয় কর্তাব্যক্তি।

মানিকগঞ্জ বৈচিত্র্যময় কৃষির এক অনন্য ক্ষেত্র। ধলেশ্বরীর বয়ে আনা পলিতে উর্বর ছিল মানিকগঞ্জের মাটি। ধান, পাট, সরিষার চাষে অনেক আগে থেকেই মানিকগঞ্জের সুনাম রয়েছে। এখন যুক্ত হয়েছে নানা জাতের সবজি, ভুট্টা, মসলা, মাছ, পোলট্রি, গরু মোটাতাজাকরণসহ কৃষির অন্যসব খাত, উপ-খাতও। তাই এবারের ‘কৃষি বাজেট কৃষকের বাজেট’-এ মানিকগঞ্জের কৃষক তুলে ধরেছেন বহুমাত্রিক কৃষির বিভিন্ন সমস্যা ও সম্ভাবনার চিত্র।

বিদ্যুৎ নিয়ে কৃষকের অভিযোগ তেমন না থাকলেও, বিদ্যুৎ সুবিধার বাইরে থাকা কৃষকের অভিযোগ বিদ্যুতে যদি ২০% ভর্তুকি সরকার দেয়, তবে ডিজেলে যারা সেচ ব্যবহার করেন তারা ভর্তুকি সুবিধা পান না। এখানেও পোলট্রি খামারিদের সেই একই অভিযোগ, তাদের বিল কেন বাণিজ্যিক বিদ্যুতের আওতায়? এক কৃষক জানালেন, রেজিস্ট্রেশনকৃত পোলট্রি খামারের বিল আসে কৃষিজাত ক্ষুদ্রশিল্পের আওতায়। তবে মানিকগঞ্জে ২ হাজার পোলট্রি খামারি থাকলে রেজিস্ট্রেশনকৃত বড়জোর ২০০ জন। বাকিদের বিদ্যুৎ বিল বাণিজ্যিক। রেজিস্ট্রেশন করা না থাকায় বার্ডফ্লুর মতো বড় ধরনের ক্ষতির মুখোমুখি হলেও সরকারি প্রণোদনা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন সেসব খামারি।

ইউরিয়া সারের বস্তার গায়ে দাম লেখা থাকলেও, অন্যসব সারের বস্তা ও অনেক কীটনাশকের প্যাকেটের গায়ে দাম লেখা থাকে না বলে অভিযোগ কৃষকের। তারা বলছেন, শুধু ধান, পাট বা আখের দাম সরকারের পক্ষ থেকে নির্ধারণ করে দেওয়া হলেও অন্যসব ফল-ফসলের দাম নির্ধারিত না হওয়ায় তাদের উৎপাদিত ফল-ফসলের দাম নির্ধারণ করছেন মধ্যস্বত্বভোগী পাইকাররা। ফলে তারা ন্যায্য মূল্য পাচ্ছেন না।

উপস্থিত কৃষক জানালেন তারা চান জৈবসার ব্যবহার করতে। কিন্তু চাহিদা অনুযায়ী জৈবসার তারা পাচ্ছেন না। এজন্য প্রয়োজন সরকারি উদ্যোগ। কেঁচো সারসহ জৈবসার উৎপাদনের সরকারি প্রকল্পের দাবি জানিয়েছেন কৃষক। বালাইদমনের জৈবপ্রযুক্তি প্রসারে তারা চান সরকারি সহযোগিতা ও উন্নত প্রযুক্তি।

শুধু প্রযুক্তি নয়, তথ্যের দিক দিয়েও একজন কৃষক এখন অনেক সচেতন। মানিকগঞ্জে বসে খোঁজ রাখছেন পৃথিবীর অন্যসব দেশে কী চাষ হচ্ছে, কৃষক কী সুবিধা ভোগ করছে এসব বিষয়ে। এক কৃষক অভিযোগ করলেন, ব্রিটেনে কৃষক পাঁচ টাকায় সাড়ে চার টাকা ভর্তুকি পান, আর বাংলাদেশের কৃষক কেন পাচ্ছেন মাত্র ৫০ পয়সা?

সিরাজগঞ্জের কৃষকের মতো মানিকগঞ্জের কৃষকেরও অভিযোগ ছিল বিএডিসির বীজ নিয়ে। তাদের অভিযোগ, কোম্পানির বীজ থেকে চারা পাওয়া যায়, কিন্তু বিএডিসির বীজ থেকে চারা গজায় না। মাটি পরীক্ষা করে কৃষিকাজ করেন শতকরা দুজন কৃষক। বেশ কয়েকবার মাটি জমা দিয়েও ফলাফল পাননি, জানালেন কৃষক।

কৃষিযন্ত্রে শতকরা ৫০ ভাগ ভর্তুকি পেয়ে কৃষক খুশি। উপস্থিত কৃষকের ট্রাক্টর বা পাওয়ার টিলারে জমি চাষ করেন শতকরা ৯৫ জন কৃষক। ফসল মাড়াইযন্ত্র ব্যবহার করেন শতকরা ৯২ জন কৃষক। কিন্তু ফসল কাটায় রিপার মেশিন বা রোপণে ড্রাম সিডার ব্যবহার করেন শতকরা একজনেরও কম। দেশের সব অঞ্চলেই কৃষিশ্রমিকের অভাব কৃষকের জন্য একটা বড় সমস্যা। কৃষি যান্ত্রিকীকরণে শ্রমিক সমস্যার সমাধান হতে পারে। কৃষক স্বাস্থ্যের দিক দিয়ে একদম সচেতন নয়। পেশাগত স্বাস্থ্য সমস্যা প্রতিরোধে কৃষকদের আরও সচেতন করতে হবে। কোনো কৃষক গামবুট, গ্লাভস, মাস্ক ইত্যাদি ব্যবহার করেন না। কীটনাশক ব্যবহারের সময় মাস্ক ব্যবহার সম্পর্কেও সচেতন নন কৃষক। এমনকি কাঁধের গামছা দিয়েও মুখ ঢেকে নেন না তারা। এ ব্যাপারে কৃষকদের সচেতন করে তুলতে স্বাস্থ্য ও কৃষি বিভাগ সম্মিলিত প্রকল্প নিতে পারে। গতবারের বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক জোরালো দাবি জানাচ্ছেন শস্যবীমার। তারা বলছেন জলবায়ু পরিবর্তনের এই সময়ে শস্যবীমার সুবিধা না পেলে কৃষিতে বিনিয়োগ বাড়বে না। ফলে কৃষি ক্ষতিগ্রস্ত হবে, ক্ষতিগ্রস্ত হবে কৃষক। উল্লেখ্য, সরকার সাধারণ বীমা করপোরেশনের মাধ্যমে পরীক্ষামূলকভাবে দেশের কয়েকটি এলাকায় শস্যবীমা শুরু করলেও তার বর্তমান অবস্থা কী। অন্যদিকে দেশের সব এলাকার কৃষক এই সুবিধা সম্পর্কে আদৌ জানেন না।

সারা দেশেই গোখাদ্য নিয়ে বিপাকে পড়েছেন খামারিরা। মানিকগঞ্জেও তাই। কৃষক বলছেন, গরুর খাবার কিনতে যে পরিমাণ খরচ, সে অনুপাতে পাচ্ছেন না দুধের দাম। সিরাজগঞ্জের খামারিদের মতোই তারা বলছেন, ১ লিটার বোতলজাত পানির দরে বিক্রি করতে হচ্ছে প্রতি লিটার দুধ। অথচ শহরে নানা প্রতিষ্ঠান দইসহ দুগ্ধজাত খাবার বিক্রি করছে তিন গুণ দামে। খামারি কৃষক এর ফল পাচ্ছেন না। মাছ চাষিরা দাবি রেখেছেন মানিকগঞ্জে সরকারি হ্যাচারি স্থাপনের। ময়মনসিংহ থেকে রেণু সংগ্রহ করে আনতে রেণুর দাম যেমন বেড়ে যায়, অন্যদিকে মৃত্যুর হারও বেশি হয়।

মানিকগঞ্জে ইউনিয়ন ডিজিটাল তথ্য কেন্দ্র সম্পর্কে জানেন শতকরা ৮৫ জন কৃষক। তথ্য কেন্দ্রে সেবা নিতে যান শতকরা ৬৫ জন। শতকরা ১০ জন কৃষক কৃষিতথ্য নিতে যান। কৃষিভিত্তিক অ্যাপ সম্পর্কে ধারণা রাখেন শতকরা পাঁচজন, অ্যাপ ব্যবহার করেন শতকরা একজন। কৃষি বাজেট কৃষকের বাজেটের গত কয়েক বছরের তুলনায় কৃষকের তথ্য সম্পর্কিত জানা-বোঝা ও ব্যবহারের হার আশাব্যঞ্জকভাবেই বাড়ছে।

কৃষকের নানা দাবি, অভিযোগ ও সফলতার কথা শুনে স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী জাহিদ মালেক স্বপন কৃষি কর্মকর্তাদের আন্তরিকভাবে কৃষকের পাশে থাকার অনুরোধ জানান। শিল্পকারখানার বর্জ্য যেন ক্ষতির কারণ হয়ে না দাঁড়ায় সে বিষয়টি তিনি খতিয়ে দেখবেন বলে কৃষকদের আশ্বস্ত করেন। তিনি বলেন, কৃষক যেন সহজে বীজ ও উৎপাদিত কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য পান সে বিষয়টির প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখবেন এবং শস্যবীমার বিষয়টি সরকারের কাছে গুরুত্বসহকারে তুলে ধরবেন। আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক গত দুই বছরের মতো এবারও ‘কৃষি বাজেট কৃষকের বাজেট’-এ উপস্থিত থাকতে পেরে নিজের উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন। তিনি ‘ভবিষ্যৎ কৃষি প্রযুক্তি কৃষি’ এ বিষয়ে একমত পোষণ করে বলেন, সরকার সারা দেশে ৫ হাজার ২৭২টি ডিজিটাল তথ্যসেবা কেন্দ্র স্থাপন করেছে। প্রতিটি কেন্দ্রে রয়েছেন দুজন করে সার্ভিস প্রোভাইডার। ১৬১২৩ নম্বর ফোন দিয়ে একজন কৃষক সহজেই যুক্ত হতে পারেন তথ্যসেবা নিতে। তিনি আশাবাদ প্রকাশ করেন, প্রযুক্তি ও ইন্টারনেট ব্যবহার করে আগামীর কৃষি হবে ডিজিটাল কৃষি আর কৃষক হবেন স্মার্ট কৃষক।

প্রতিদিন পাল্টে যাচ্ছে কৃষির ধরন। কৃষি উৎপাদন শিল্প উৎপাদনে রূপ নিচ্ছে। সাধারণ ও প্রান্তিক কৃষকের কাছে বড় বিনিয়োগমুখী ওই কৃষিশিল্প স্থাপন করা কঠিন। তাই কৃষি দিনে দিনে তার হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। যে চলে যাচ্ছে অন্য পেশায়। কৃষির এই পরিবর্তিত সময়টি অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং। একদিকে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, অন্যদিকে কৃষি-ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখা। এ দুই প্রশ্নেই কৃষকের শক্তি বৃদ্ধি করা অনেক বেশি প্রয়োজন। বিষয়গুলো নিয়ে এখনই নীতি-নির্ধারণীর জায়গা থেকে ভাবা উচিত।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।

[email protected]

সর্বশেষ খবর