শনিবার, ৩১ মার্চ, ২০১৮ ০০:০০ টা
বায়তুল মোকাররমের খুতবা

দুর্নীতি প্রতিরোধে মহানবী (সা.)-এর শিক্ষা

মাওলানা মিজানুর রহমান
পেশ ইমাম

ইসলাম শান্তি ও সুবিচারের ধর্ম। এখানে নীতি-নৈতিকতার শৃঙ্খলে সমাজ সদস্যদের আচরণ নিয়ন্ত্রিত হয়। পরস্পরের প্রতারণা, ধোঁকাবাজি বা ঠকবাজি করে ধনবান হওয়ার অপপ্রয়াস কোনো দিন স্থায়ী কল্যাণ বয়ে আনে না। দুর্নীতির মাধ্যমে গড়া সম্পদ আপাতদৃষ্টে ব্যক্তিকে সাময়িক সুখ ও প্রশান্তি দিচ্ছে মনে হলেও একদিন তা তার জন্য সীমাহীন অশান্তি ও নিদারুণ দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। পৃথিবীতে আইনের আওতায় তাকে শাস্তি পেতে হয় এবং আখিরাতের আরও কঠিন শাস্তি তার জন্য অপেক্ষা করে। সম্পদ ও প্রতিপত্তি লাভের পেছনে কাজ করে অহঙ্কার, লোভ ইত্যাদি রিপু; আর তা চরিতার্থ করার জন্য ওইসব ব্যক্তি জালিয়াতি, ভেজাল মিশ্রণ, নকলবাজি, ঘুষসহ নানা ছলচাতুরীর আশ্রয় গ্রহণ করে। এসব অপকর্ম ও দুরাচারকেই এক কথায় বলা হয় দুর্নীতি। এ দুর্নীতি সমাজের দুষ্টক্ষত। এ ক্ষত জিইয়ে রেখে সুস্থ সমাজের আশা করা দুরাশা বৈ কিছু নয়।

মানবতার মুক্তিদূত মুহাম্মাদুর রসুলুল্লাহ (সা.) ছিলেন রহমাতুল্লিল আলামিন বা সমগ্র বিশ্বের জন্য রহমতস্বরূপ। সমাজ থেকে শিরক-বিদাতসহ প্রচলিত নানা কুকর্ম-অপকর্ম ও দুর্নীতি দূর করে তিনি সমাজে শান্তিময় পরিবেশ কায়েম করেছিলেন। রসুল (সা.) জনসমক্ষে দুর্নীতির ভয়াবহ কুফল তুলে ধরে সুনীতিচর্চার সুফল ও কল্যাণ হাতে-কলমে শিক্ষা দিয়ে গেছেন।

দুর্নীতি প্রতিরোধে রসুল (সা.) নানামুখী কর্মকৌশল অবলম্বন করেছিলেন। অন্তরাত্মার পরিশুদ্ধি, নীতিসম্মত কাজ তথা সৎকর্মে উৎসাহদান, দুর্নীতির কঠোর পরিণতি সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করা ও সর্বশেষ শাস্তির ব্যবস্থা, তার দুর্নীতিবিরোধী কর্মকৌশল ছিল বিশ্বজনীন ও শতভাগ বাস্তবসম্মত।

মানুষের কর্মের উৎস তার অন্তঃকরণ বা কলব। স্বচ্ছ ও নির্মল অন্তঃকরণে নীতি-নৈতিকতাবিরোধী কোনো পরিকল্পনা অসম্ভব। তাই তিনি সর্বপ্রথম মানুষের অন্তঃকরণ স্বচ্ছ, নির্মল ও পরিশুদ্ধ করার প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘মানবদেহে রয়েছে একটি মাংসপিণ্ড তা সুস্থ থাকলে পুরো দেহ সুস্থ থাকে আর তা বিনষ্ট হলে পুরো দেহ বিনষ্ট। তা হলো কলব বা অন্তঃকরণ। এ প্রসঙ্গে আল্লাহর নিম্নোক্ত বাণীগুলো ব্যাপকভাবে মানুষের মধ্যে প্রাণ পেয়েছে—

‘সফলকাম হয়েছে সেই ব্যক্তি যে তার অন্তর শুদ্ধ করেছে এবং ব্যর্থ হয়েছে সে যে তা অকার্যকর রেখেছে।’ (আল কোরআন ৯১:৯-১০)। মহান আল্লাহ আরও বলেন, ‘ওই ব্যক্তি সফলকাম হয়েছে যে নিজেকে পরিশুদ্ধ করেছে।’ (আল কোরআন ৮৭:১৪)।

এভাবে তিনি মানুষের হৃদয়-মন পরিশুদ্ধ করার মাধ্যমে একে সৎকর্ম ও সদুপদেশ গ্রহণের উপযুক্ত পাত্র হিসেবে গ্রহণ করার জন্য উৎসাহিত করেন যাতে কোনোরূপ নীতিবিরুদ্ধ কাজ অন্তরে প্রশ্রয় পেতে না পারে।

সুন্দর জীবন গঠনের মাধ্যমে ইহ-পরকালের কল্যাণলাভের ক্ষেত্রে নীতিসিদ্ধ ও সৎ কাজ সম্পাদনের বিকল্প নেই। আল্লাহর নিম্নোক্ত বাণী—

‘মুমিন পুরুষ কিংবা নারী যে কেউ সৎকর্ম করবে আমি তাকে নিশ্চয়ই পবিত্র জীবন দেব এবং তাদের কর্মের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার দান করব।’ (আল কোরআন ১৬:৯৭)। এভাবে অসংখ্য আয়াত ও হাদিসের মাধ্যমে তিনি সুনীতি ও সৎকর্মে উৎসাহিত করেছেন। যাতে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই দুর্নীতিকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। এটা ছিল রসুল (সা.)-এর দুর্নীতি প্রতিরোধী অন্যতম কার্যকর কর্মকৌশল।

উত্তম ও সৎ কাজের সুফল সম্পর্কে মানুষকে অবহিত করার পাশাপাশি তিনি দুর্নীতির কঠোর পরিণাম সম্পর্কে সতর্ক করেছেন। দেশে দেশে যারা আল্লাহর বিরুদ্ধাচরণ করে, দুর্নীতি বিস্তারে বাড়াবাড়ি করে তখন আল্লাহতায়ালা তাদের ওপর রুষ্ট হয়ে তাদের নানাভাবে শাস্তি প্রদান করেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন, ‘যারা দেশে সীমালঙ্ঘন করেছে এবং তাতে বড় বেশি দুর্নীতি করেছে, তখন তাদের ওপর তোমার প্রভু শাস্তির কশাঘাত হেনেছেন। নিশ্চয়ই তোমার প্রতিপালক পর্যবেক্ষণ করছেন।’ (আল কোরআন ৮৯:১১-১৪)। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে আজ দুর্নীতির কালো থাবা লক্ষ্য করা যায়। কোনো কাজে নিয়মনীতি বা আইনের বিধান না মেনে নিজের স্বার্থে বেপরোয়া কাজ করে যাওয়াকে এককথায় দুর্নীতি বলা যায়। সিন্ডিকেট করে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, খাদ্যে, ওষুধে, নির্মাণসামগ্রীতে অথবা প্রসাধনীতে কিংবা ভোগ্যপণ্যে ভেজাল মিশিয়ে বিক্রি করা, সরকারি-বেসরকারি চাকরিতে কোনো সুবিধালাভের ক্ষেত্রে ঘুষের লেনদেন ইত্যাদি দুর্নীতির প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এ ছাড়া পরীক্ষায় নকল, দলিল-দস্তাবেজ জালিয়াতি, অবৈধ দখলদারি, অসামাজিক কাজে উৎসাহিত করা, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, আর্থিক অনিয়ম ইত্যাদি নানা অপকর্ম ও দুর্নীতি আজ ব্যাপকভাবে লক্ষণীয়। কোরআন ও হাদিসে এসব কর্মকাণ্ডের পরিণাম বর্ণনা করে তা থেকে বিরত থাকতে উৎসাহিত করা হয়েছে।

আল্লাহতায়ালা অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে আত্মসাৎ করার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে বলেন, ‘তোমরা নিজেদের মধ্যে একে অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না।’ (আল কোরআন ২:১৮৮)। হালাল রুজি ছেড়ে হারাম সম্পদ অর্জন নিষিদ্ধ ঘোষণা করে বলেন, ‘আল্লাহ তোমাদের হালাল ও পবিত্র যা দিয়েছেন তা থেকে আহার কর এবং আল্লাহর অনুগ্রহ ও নিয়ামতের জন্য শোকর কর।’ (আল-কোরআন ১৬:১১৪)।

সর্বশেষ খবর