শনিবার, ৭ এপ্রিল, ২০১৮ ০০:০০ টা

নিজেদের সংকটে সচেতন হচ্ছে কৃষক

শাইখ সিরাজ

নিজেদের সংকটে সচেতন হচ্ছে কৃষক

এবার অষ্টমবারের মতো অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের উপস্থিতিতে কৃষি বাজেট কৃষকের বাজেট আয়োজনের সুযোগ হলো। অত্যন্ত দূরদর্শিতা ও আন্তরিকতার সঙ্গে তিনি কৃষকের দাবি ও চাহিদাগুলো শুনলেন এবং আসন্ন জাতীয় বাজেট প্রণয়নের আগে বিষয়গুলো নিয়ে বিবেচনা ও বিশ্লেষণ করারও আশাবাদ প্রকাশ করলেন। আয়োজনটি ছিল সিলেটের দক্ষিণ সুরমা  উপজেলার কামালবাজারে।  হৃদয়ে মাটি ও মানুষের উদ্যোগে ‘কৃষি বাজেট কৃষকের বাজেট’-এর এ বছরের তৃতীয় আয়োজনে উপস্থিত ছিলেন প্রায় আড়াই হাজার কৃষক ও খামারি। সেখানে উপস্থিত ছিলেন সিলেট-৩ আসনের সংসদ সদস্য মাহমুদ উস সামাদ চৌধুরী, সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার নাজমান আরা খানুম, জেলা প্রশাসক নুমেরী জামান, বিএডিসি সিলেটের নির্বাহী পরিচালক (সেচ) প্রনজিৎ কুমার দে, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক আবুল হাশেমসহ সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিরা।

এবার সিলেটে ‘কৃষি বাজেট কৃষকের বাজেট’-এর আয়োজনের অনেকগুলো উদ্দেশ্য ছিল। এক. গতবার হঠাৎ বন্যায় হাওরের ক্ষতিগ্রস্ত কৃষির জন্য কৃষকের কী দাবি, চাহিদা, পাশাপাশি স্থানীয় সরকারের অঙ্গসংগঠনগুলো কী ভাবছে তা জানা। দুই. এর আগে দুবার কৃষি বাজেট কৃষকের বাজেট আয়োজনে সিলেটের বিস্তীর্ণ অনাবাদি এলাকার প্রসঙ্গ উঠে আসে। অনাবাদি জমিগুলো আবাদের আওতায় আনার জন্য বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। আদৌ সে বিষয়টি এগিয়েছে কি-না, সে সম্পর্কে কৃষকের মতামত জানা। যে কোনো সময়ের চেয়ে বাংলাদেশের কৃষক এখন নিজের চাহিদা, অধিকার নিয়ে সচেতন। শুধু সচেতনই নয়, মতপ্রকাশে কৃষক এখন অনেকটাই জড়তামুক্ত ও আত্মবিশ্বাসী। সুযোগ পেলে সে কণ্ঠ তুলতে কোনো সংকোচ বোধ করে না। তারই প্রমাণ মিলছে ‘কৃষি বাজেট কৃষকের বাজেট’-এ। কৃষক স্থানীয় প্রতিনিধিদের সামনে অকপটে বলে যাচ্ছে তার সমস্যার কথা, অভিযোগের কথা, বলিষ্ঠ কণ্ঠে তুলছে তার দাবি।

সিরাজগঞ্জ, মানিকগঞ্জের কৃষকদের মতো সিলেটের কৃষকদেরও মূল সমস্যা সবজি সংরক্ষণে ও মূল্য না পাওয়া। কৃষক বললেন, টমেটোর তেমন দাম পাচ্ছেন না। টমেটোর সস উৎপাদন করে এমন একটি প্রতিষ্ঠান টমেটো কিনতে চায় চার টাকা কেজি দরে। অথচ এক কেজি টমেটোর উৎপাদন খরচ আট টাকা। তাই কৃষকের দাবি, টমেটো সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা, টমেটোর দাম সরকারিভাবে নির্ধারণ করা এবং টমেটোর বিকল্প বাজারজাতকরণের ব্যবস্থার ক্ষেত্রে সরকারকে এগিয়ে আসার। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা দরকার, ২০০৫ সালে আমি মৌলভীবাজারে কমলগঞ্জের টমেটো চাষিদের দুর্দশার চিত্র তুলে ধরি টেলিভিশনের অনুষ্ঠানে। সেখানে কৃষকের টমেটোর উৎপাদন খরচ দূরের কথা এক এক মণের এক ঝুড়ি টমেটো ২০ টাকাতেও বিক্রি হয়নি। ঝুড়িটির দামই ২০ টাকার ওপরে। অনেক কৃষক কমলগঞ্জ বাজারেই তার স্বপ্নের ফসল ঢেলে দিয়ে চলে যায়। এক যুগ পরেও টমেটো চাষিদের একই দুর্দশা রয়ে গেছে।

অধিকাংশ কৃষকের অভিযোগ, সরকারিভাবে যে প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে তা প্রকৃত কৃষক পাচ্ছেন না। এ বিষয়ে মনিটরিংসহ কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান কৃষক। সব কৃষকই জমিতে জৈবসার ব্যবহার করতে চান। কিন্তু জৈবসারের জোগান নেই। যে কৃষক জৈবসার উৎপাদন করছে সে বিপণন করতে পারছে না। কৃষকদের দাবি জৈবসার উৎপাদনে কৃষকদের প্রশিক্ষণ ও সমন্বয়ের উদ্যোগ নেওয়ার।

কৃষি যন্ত্রপাতির ওপর সরকার কৃষককে ৫০ শতাংশ ভর্তুকি দিচ্ছে। এই ভর্তুকি—হাওর এলাকার জন্য ৭০ শতাংশ। এ বিষয়ে হাওর এলাকার কৃষকদের সন্তুষ্টি থাকলেও কয়েকজন কৃষক অভিযোগ করেছেন, এই ভর্তুকির সুযোগ ক্ষুদ্র কৃষক পাচ্ছে না, পাচ্ছে বড় কৃষক। শতকরা ৯৫ ভাগ কৃষক যান্ত্রিক কৃষির সঙ্গে যুক্ত হলেও এ সংযুক্তি ট্রাক্টর, সেচ ও ফসল মাড়াইয়ের মেশিন ব্যবহারের মধ্যে সীমাবদ্ধ। শতকরা দুজন কৃষকও ধান কাটার মেশিন এবং বীজ বোনা বা রোপণের যন্ত্র ব্যবহার করে না। হাওরের মতো এলাকায় যেখানে আকস্মিক বন্যায় তলিয়ে যায় হেক্টরের পর হেক্টর পাকা ধানের খেত, শ্রমিক সংকট যেখানে উচ্চমাত্রায় সেখানে কৃষিতে যন্ত্রের ব্যবহার দিতে পারে খানিকটা সমাধান। হাওরের কৃষকের দাবি ছিল জলবায়ু সহিষ্ণু ফল-ফসলের বীজ। যা প্রকৃত অর্থেই সময়োচিত একটা দাবি। বীজ নিয়েও কৃষকের রয়েছে নানা অভিযোগ। তারা বলছেন, বিএডিসির বীজে কাঙ্ক্ষিত ফলন পাওয়া যায় না। সিলেট তথা হাওর অঞ্চলের মাটি উপযোগী হাইব্রিড বীজ উৎপাদনের তাগিদ দিয়ে কৃষক বলেন, সিলেট অঞ্চলের মাটি দেশের অন্য অঞ্চলের চেয়ে ভিন্ন, তাই সে অঞ্চলের মাটি উপযোগী বীজ প্রয়োজন। উপস্থিত কৃষকদের শতকরা পাঁচজন মাটি পরীক্ষা করে কৃষি আবাদ করেন বলে জানালেন। তবে মাটি পরীক্ষার বিষয়টিতে কৃষক তেমন সচেতন নয়। সরকারের কৃষি দফতর কৃষকদের মাটি পরীক্ষা করে মাটি উপযোগী ফল ফসল চাষে সচেতন করে তুলতে পারে। এতে করে কৃষক ফসল ভালো পাবে। বালাই দমনে জৈবপ্রযুক্তি ব্যবহার করেন শতকরা দুজন কৃষক। ফল-ফসলে কীটনাশক ব্যবহারে কৃষক যেমন স্বাস্থ্যগতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, একইভাবে ফল-ফসল পরিণত হচ্ছে অনিরাপদ খাদ্যে। এ বিষয়ে দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। খাদ্য নিরাপত্তার পাশাপাশি নিরাপদ খাদ্যের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে না নিলে টেকসই উন্নয়নের অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জন কঠিন হয়ে যাবে।

গতবার হাওরের আকস্মিক বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক জোরালো দাবি জানাচ্ছে শস্যবীমার। পাশাপাশি দাবি তুলছে কৃষকদের কল্যাণ তহবিল গঠনের। সংকট ও দুর্যোগে সরকারকে দ্রুত পাশে চায় কৃষক। সেটা শুধু অর্থের সহযোগিতা নয়, পরামর্শ দিয়ে যেন তাদের আন্তরিক সহযোগিতা করা হয় এই দাবি তাদের।

সারা দেশেই গোখাদ্য নিয়ে বিপাকে রয়েছেন খামারিরা। হাওরাঞ্চলে এ সমস্যা আরও প্রকট। বর্ষা এলেই গবাদিপশু কমমূল্যে বিক্রি করে দিতে হয়। পরীক্ষামূলকভাবে কোথাও কোথাও হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে কাঁচা ঘাস উৎপাদন শুরু হলেও এ বিষয়ে সরকারের যথোপযুক্ত পরিকল্পনা ও ব্যাপক সহযোগিতা প্রয়োজন বলে মনে করছে কৃষক ও খামারিরা। খামারিরা দুধের দাম পাচ্ছে না বলে অভিযোগ করেছে।

মাছ চাষিরা চায় ভালো রেণুর নিশ্চয়তা। সরকারি হ্যাচারি থেকে ভালো রেণু পাচ্ছে না, জানিয়েছে তারা। কৃষি ঋণ নিয়ে ব্যাংকগুলোর প্রতি নানা অভিযোগ সব কৃষকের। ঋণ নিতে গেলে হয়রানির স্বীকার হয় তারা। ঘুরতে হয় দিনের পর দিন। যার কারণে উচ্চ সুদে এনজিও থেকে ঋণ নিতে তাদের বাধ্য হতে হয়।

হাওর এলাকার এক সম্ভাবনাময় কৃষি খাত হচ্ছে হাঁস পালন। কিন্তু হাওর এলাকায় কোনো হাঁস প্রজনন কেন্দ্র নেই। খামারিদের দাবি ছিল সরকারিভাবে হাঁস প্রজনন খামার গড়ে তোলা হোক।

সিলেটে ইউনিয়ন ডিজিটাল তথ্যকেন্দ্র সম্পর্কে জানেন শতকরা ৯০ জন কৃষক। তথ্যকেন্দ্রে সেবা নিতে যান শতকরা ৭৫ জন। কিন্তু কৃষি তথ্যসেবা নেওয়ার বিষয়টি সম্পর্কে কৃষক অবগত নন। শতকরা পাঁচজন কৃষক কৃষি তথ্য নিতে যান। কৃষিভিত্তিক অ্যাপ সম্পর্কে ধারণা রাখেন শতকরা দুজন, অ্যাপ ব্যবহার করেন শতকরা একজনেরও কম। কৃষি বাজেট কৃষকের বাজেট এর গত কয়েক বছরের তুলনায় কৃষকের তথ্য সম্পর্কিত জানা-বোঝা ও ব্যবহারের হার আশাব্যঞ্জকভাবেই বাড়ছে।

কৃষকদের নানা দাবি, অভিযোগ ও সফলতার কথা শুনে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, এবার নিয়ে আট বছর ধরে তিনি ‘কৃষি বাজেট কৃষকের বাজেট’-এর সঙ্গে রয়েছেন। এই প্রাক-বাজেট আলোচনা প্রণয়নে সহায়ক। তিনি কৃষকদের সমস্যা সমাধানে বিভিন্ন প্রকল্পের কথা উল্লেখ করেন। টমেটো বা সবজি নিয়ে কৃষকের দুর্ভোগের বিষয়টি নিয়ে উদ্যোগ নেওয়া হবে বলে জানান মন্ত্রী। ভালো মানের হাইব্রিড বীজের বিষয়ে মান পরীক্ষার ব্যাপারটি নিয়ে কৃষিমন্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করবেন বলেও জানান তিনি। অর্থমন্ত্রী উল্লেখ করেন, মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য কমাতে কৃষি বাজারের জন্য ‘কৃষি ভবন’ নির্মাণের বিষয়টি তার ভাবনায় রয়েছে। বাসিয়া নদীর বাঁধ নিয়ে কৃষকদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে তিনি এ ব্যাপারে পানি উন্নয়ন বোর্ড ও বিএডিসির যৌথ উদ্যোগের পরামর্শ দেন।  কৃষি প্রণোদনা অকৃষক পাচ্ছেন কৃষকদের এমন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি ৩/৪টা সভার মাধ্যমে কৃষক বাছাই করার পরামর্শ দেন সংশ্লিষ্টদের।  ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক শনাক্তকরণও একই প্রক্রিয়ায় হতে পারে বলে মত দেন তিনি। খামারিদের বিদ্যুৎ ভর্তুকির আওতায় আনার ব্যাপারটি তিনি বিবেচনায় রাখবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।

[email protected]

সর্বশেষ খবর