বুধবার, ১১ এপ্রিল, ২০১৮ ০০:০০ টা

তারুণ্যের দ্রোহে কোটা কমিয়ে আনুন

পীর হাবিবুর রহমান

তারুণ্যের দ্রোহে কোটা কমিয়ে আনুন

গোটা দেশ যখন চৈত্রের শেষে বাংলায় নববর্ষ বরণ উৎসবের ব্যাপক প্রস্তুতি নিচ্ছে, বৈরী প্রকৃতির আঘাত আসার আগেই কৃষকের চোখে-মুখে যখন স্বপ্নের ফসল ধান ঘরে তোলার আকুতি, কালবৈশাখী ঝড়ের আনাগোনা যখন প্রকৃতিতে, ঠিক তখন কোটা সংস্কারের দাবিতে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড-খ্যাত এককালের সব আন্দোলন-সংগ্রামের সূতিকাগার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ঘিরে তারুণ্যের প্রতিবাদী দ্রোহের ঝড় দেখা গেছে। প্রতিবাদমুখর এমন উত্তাল ছাত্র আন্দোলন একবার দেখেছিল সেনা-সমর্থিত ওয়ান-ইলেভেন সরকার। সেই সরকারের বিরুদ্ধে পুঞ্জীভূত সব ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটেছিল সেই ছাত্র আন্দোলনে। সেবার একজন ছাত্রের প্রতি অসদাচরণের অভিযোগে সেই বিদ্রোহ বারুদের মতো জ্বলেই ওঠেনি, ফখরুদ্দীন ও মইন উদ্দিনের সব ক্ষমতাকে কার্যত ভেঙে দিয়েছিল। মানুষের ভয়-আতঙ্ক কেটে গিয়েছিল, সেই এক বিদ্রোহে।

এবার গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় শেখ হাসিনার রাজনৈতিক সরকারের শাসনামলে গোটা দেশ অবাক বিস্ময়ে দেখেছে তারুণ্যের শক্তি একবার বিদ্রোহ করলে মাথা নোয়াতে জানে না। শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভরত প্রতিবাদী ছাত্রছাত্রীদের উত্তাল আন্দোলনের মুখে পুলিশ রাবার বুলেট-টিয়ার শেল ও লাঠিচার্জ দিয়ে তারুণ্যকে শাহবাগ থেকে তুলে দিতে চাইলে হিতে বিপরীত হয়। দুই পক্ষের তুমুল সংঘর্ষই বাধেনি, দ্রোহের আগুনে জ্বলে ওঠে ছাত্রসমাজ। ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটে শাহবাগ ও চারুকলা হয়ে টিএসসি পর্যন্ত। দিনের বেলায় শুরু হওয়া এই বিক্ষোভ, এই সংঘর্ষ গভীর রাত পর্যন্ত গড়িয়ে যায়। রাত ২টা পর্যন্ত সেই বিক্ষোভ উত্তাল করে রাখে ছাত্র আন্দোলনকে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বুঝতে পারেন অন্ধ হলেও প্রলয় বন্ধ থাকে না। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে কঠোর দমননীতির পথ পরিহার করে রাজনৈতিক উদ্যোগ নেন। দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকে আন্দোলনরত ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে শান্তিপূর্ণ সমাধানে যেতে বলেন। ওবায়দুল কাদের যেখানেই আপদ, দিন হোক রাত হোক সেখানেই নানক— এই উদাহরণ সামনে এনে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে তৃণমূল থেকে কেন্দ্রের নেতৃত্ব দিয়ে উঠে আসা আওয়ামী লীগের যুগ্মসাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক এমপিকে রাতের ক্যাম্পাসে পাঠিয়ে দেন। সেখানে নানক আন্দোলনরত ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে আলোচনা করে সোমবার ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে বৈঠকের সময় চূড়ান্ত করেন। সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও ছাত্রদের বক্তব্য নিয়ে কোটাব্যবস্থা পরীক্ষা-নিরীক্ষার তাগিদ দেন।

এদিকে ছাত্র আন্দোলন সব বিশ্ববিদ্যালয়ে ততক্ষণে ছড়িয়ে গেছে। দেশজুড়ে ছাত্রসমাজ বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে। টিএসসিতে বিক্ষুব্ধ আন্দোলনরত ছাত্রছাত্রীদের রেখে তাদের ২০ জন সচিবালয়ে বিকালে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে বৈঠক করেন। সেখানে সরকারি দলের নেতৃবৃন্দ, উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তা ও ২০ সদস্যের প্রতিনিধি দলের সদস্য উপস্থিত ছিলেন। সেখানে ওবায়দুল কাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অভিমত জানিয়ে বলেন, কোটা সংস্কারের দাবি সরকার ইতিবাচকভাবে নিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী এটি পরীক্ষা-নিরীক্ষার নির্দেশ দিয়েছেন। উভয় পক্ষের আলোচনায় দাবি বাস্তবায়নে সরকারকে এক মাস সময় দেওয়া হয়। যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে তাদের নিঃশর্ত মুক্তি ও আহতদের সরকারিভাবে চিকিৎসার সিদ্ধান্ত হয়। একই সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির বাসভবনে হামলা ও ভাঙচুরকারীদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনার বিষয়ে একমত হন। ৭ মে পর্যন্ত আন্দোলন স্থগিতের সিদ্ধান্ত হয়।

আন্দোলনকারী নেতারা যখন বৈঠক করছিলেন, তখন বিক্ষুব্ধ ছাত্রছাত্রীরা টিএসসি এলাকায় শান্তভাবে বসে ছিলেন। ফিরে এসে নেতারা যখন আন্দোলন স্থগিতের ঘোষণা দিলেন, আন্দোলনকারী ছাত্রছাত্রীরা প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠেন। বৈঠকে গৃহীত সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করে দাবি মেনে না নেওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে তারা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় সড়কে ব্যারিকেড গড়ে তোলেন। অবশ্য রাতে তারা রাজপথ ছেড়ে চলে যান।

এদিকে আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশি হামলা ও গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে রবিবার রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবন ঘেরাওকালে তার বাড়িতে যে হামলা-ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের মতো নারকীয় তাণ্ডব ঘটেছে তার নিন্দার ঝড় উঠেছে। এমনকি চারুকলায় নববর্ষের মঙ্গল শোভাযাত্রার জিনিসপত্র ভাঙচুরের ঘটনায় প্রশ্ন উঠেছে, আন্দোলকারীদের ভিতরে অন্য কোনো শক্তির প্রবেশ ঘটেছে কিনা? সরকার কোটা সংস্কার প্রশ্নে ছাত্রসমাজই নয়, মানুষের আবেগ-অনুভূতি উপলব্ধি-অনুধাবন করতে কতটা দেরি করেছে ছাত্রছাত্রীদের বিদ্রোহ তা বুঝিয়ে দিয়েছে। কিন্তু ভিসির বাসভবনে এমন ভয়াবহ তাণ্ডব রাজনৈতিক ইতিহাসে কখনো হয়নি।

দেশের অর্থনীতির উন্নয়ন, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ইস্যু, বঙ্গবন্ধুর খুনি ও যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসিসহ শেখ হাসিনা সরকারের সব সাফল্যের সঙ্গে যে সাফল্যটি সবচেয়ে বড় আকারে বিবেচনা করা হয়, তা হলো তিনি তাঁর এই শাসনামলে কোনো রাজনৈতিক অসন্তোষ বা বিদ্রোহ-আন্দোলন ঘটতে দেননি। সরকারবিরোধী প্রধান রাজনৈতিক দলও হরতাল-অবরোধের পথ পরিহার করে অহিংস নীতি অবলম্বন করেছে। ব্যবসায়ীরাও এতে দারুণ খুশি। কিন্তু কোটা নিয়ে ছাত্রসমাজসহ নানা মহলে যখন এর সংস্কার বা তুলে দেওয়ার দাবি উঠেছে, তখনো সরকারের উপর মহল থেকে রাজনৈতিক সমাধানের পথ নেওয়া হয়নি। আরও আগে নেওয়া হলে, আলোচনার দরজা খুলে দিলে রাজপথে অসন্তোষ দাবানলের মতো ছড়িয়ে যেত না।

সরকারি চাকরিতে কোটা প্রথা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারীদের পক্ষে-বিপক্ষে নানা কথাই উঠে আসছে। ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়া থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকেই মুক্ত মতামত রাখছেন। কেউ বলছেন কোটা প্রথা বহাল থাকবে, কেউ বলছেন সংস্কার হতে হবে, কেউ বলছেন তুলে দিতে হবে। সরকারের উপর মহল থেকেও কোটা প্রথা বহাল রাখার পক্ষে অভিমত দেওয়া হয়েছে। শিক্ষার্থীরা মেধার ভিত্তিতে চাকরিতে নিয়োগের দাবিতে রাজপথে নামার পর মানুষের মধ্যে প্রকৃত চিত্রপট উঠে এসেছে গণমাধ্যমের সুবাদে। সেখানে দেখা যাচ্ছে, বর্তমান সরকারি চাকরিতে ৫৬ শতাংশ কোটার ভিত্তিতে নিয়োগ পেয়ে থাকে। এই হার যথাক্রমে মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পোষ্যদের ৩০, নারী ১০, জেলা কোটা ১০, আদিবাসী ৫ ও প্রতিবন্ধী ১ শতাংশ। এতে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগের সুযোগ পান মাত্র ৪৪ শতাংশ।

ব্যক্তিগতভাবে আমি শুধু সরকারি চাকরিই নয়, প্রায় সব ক্ষেত্রেই ঘোষিত ও অঘোষিত কোটা প্রথা তুলে দেওয়ার পক্ষপাতী। সংবিধান জনগণকে ক্ষমতার মালিকই করেনি, রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতির ১৯ অনুচ্ছেদের(১)-এ বলা হয়েছে, সব নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতার নিশ্চিত করতে রাষ্ট্র সচেষ্ট হবে। স্বাধীনতার ৪৭ বছর পরও মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান ও নাতি-নাতনিদের জন্য কোটা থাকতে পারে না। মুক্তিযোদ্ধারা অবশ্যই জাতির বীর সন্তান। দেশের স্বাধীনতায় ও মুক্তিযুদ্ধে তাদের গৌরবময় সাহসী ভূমিকা ও বীরত্বের জন্য নিজেরা যেমন অহংকার করতে পারেন তেমনি দেশ যত দিন থাকবে ইতিহাস তাদের অমরত্ব দেবে। সেদিন জীবন বাজি রেখে মৃত্যুকে পায়ে পায়ে সঙ্গে নিয়ে মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য তারা যুদ্ধ করেছেন। কোনো করুণা লাভের জন্য নয়। সেদিন যে সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়নি তার জন্য স্বাধীন আবাসভূমি রেখে গেছেন। কোটা প্রথা দিয়ে তাঁর মেধার লড়াইকে রুদ্ধ করার জন্য নয়। যে দেশে উচ্চশিক্ষিত ক্ষমতাধর সচিবরা ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ধরা পড়েন; যে দেশে নানা গলিপথে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা হারিয়ে যায় ভুয়া মুক্তিযোদ্ধারা ঠাঁই পায়, সেই দেশে এই কোটা ৪৭ বছর পর কার জন্য? মুক্তিযুদ্ধের প্রতি, বীরদের প্রতি জাতির আবেগ-অনুভূতি ভালোবাসা এবং আলবদর, রাজাকারদের প্রতি যে ঘৃণা রয়েছে রাজনৈতিক স্বার্থে কথায় কথায় তা ব্যবহার করে এর গভীরতা হালকা করার অর্থ হয় না। এতে বীরদের হৃদয়ও ক্রন্দন করে ওঠে। ভুয়া মুক্তিযোদ্ধারা যেখানে তালিকায় ঠাঁই পায়, সেখানে এই কোটা প্রথা প্রহসন হয়ে দাঁড়ায়। প্রকৃত বীর যোদ্ধারা মানুষের হৃদয়ে সম্মানিত হয়ে আছেন, থাকবেন। কিন্তু সব নাগরিকের জন্য সমঅধিকার কেড়ে নেওয়া তাদের নামে যেমন গৌরবের নয়, তেমনি ন্যায্যও নয়।

সাংবিধানিকভাবে যেখানে সব নাগরিকের সমান অধিকার রাষ্ট্র নিশ্চিত করবে, সেখানে কোটা প্রথা থাকতে পারে না। এমনকি আজকের নারীরা সমঅধিকারে বিশ্বাসী। তাদের জন্য চাকরি ক্ষেত্রে কোটা প্রথাও অসম্মানের। জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত মহিলা আসনে প্রতিনিধিত্ব নারীর জন্য সম্মানের নয়। সংরক্ষিত কোটার মহিলা এমপি ও সরাসরি ভোটে বিজয়ী এমপিকে কোনো মহলই সমান মর্যাদার চোখে দেখছে না।

যে দেশে যখন যারা ক্ষমতায় তারা প্রশাসনকে দলীয়করণ করে, নিয়োগ প্রক্রিয়াকে দলীয়করণ করে, কখনো-সখনো নিয়োগ বাণিজ্যের দরজা খুলে দেয়। যে দেশে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান থেকে সদস্য পর্যন্ত শাসক দল তার অনুগত আজ্ঞাবহ অন্ধ দাসদের দিয়ে সাজায়, যে দেশে বিসিএস পরীক্ষায় প্রশাসন ক্যাডারে সুযোগ প্রশ্নবিদ্ধ হয় তার স্বচ্ছতা নিয়ে, সেখানে কোটা প্রথা সাধারণ নাগরিক পরিবারের বা রাজনৈতিক ক্ষমতাসীন দলগুলোর বাইরে থাকা ছাত্রছাত্রীদের জন্য আরেকটি বড় বাধা। মেধাবীদের মেধার লড়াই হোঁচট খাচ্ছে দলবাজি, স্বজনপ্রীতি, নিয়োগ বাণিজ্য ও কোটা প্রথার কাছে। এতে তারুণ্যের মধ্যে দিনে দিনে হতাশা বাড়ছে। ক্ষোভ বাড়ছে।

যুগে যুগে এই দেশে সব বিপ্লব আন্দোলন-সংগ্রামে ছাত্রসমাজই রুদ্রমূর্তি নিয়ে দাবানলের মতো জ্বলে উঠেছে। ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধিকার-স্বাধীনতার পথে সুমহান মুক্তিযুদ্ধে জাতির মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুুজিবুর রহমানের ডাকে ছাত্রসমাজ গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস রচনা করেছে। পরিবার-পরিজনসহ ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট কালরাতে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রে ঘাতকের বুলেটে মানবসভ্যতার ইতিহাসে ঘটে যাওয়া বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হওয়ার পর গোটা দেশে যে অন্ধকার সময় নেমে এসেছিল, সামরিক শাসনকবলিত সেই বাংলাদেশে গণতন্ত্রের বাতি নিয়ে অনেকের সঙ্গে রাজপথের নেতৃত্বের মহিমায় আবির্ভূত হয়েছিলেন আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গণতন্ত্রমুক্তির সেই আন্দোলন বারুদের মতো নগর থেকে লোকালয়ে জ্বালিয়ে ছিল ছাত্রসমাজ। গণতন্ত্রমুক্তির সেই আন্দোলন-সংগ্রামে আত্মদান থেকে এমন কোনো ত্যাগ নেই যা ছাত্রসমাজ সাহসিকতার সঙ্গে করেনি। এই সময়ের তারুণ্য যারা গত কয়েক বছরে ভোটার হয়েছে, তারা বিএনপি-জামায়াতের অভিশপ্ত শাসনামল দেখেনি, যারা দেখেছে তাদের কাছে ধূসর-স্মৃতিহীন হয়ে গেছে। কিন্তু নয় বছর ধরে আওয়ামী লীগের শাসনামলে তারা ব্যাপক উন্নয়ন কর্মযজ্ঞের পাশাপাশি সরকারি দলের কারও কারও উন্নাসিক আচরণ, চারদিকে অনেকের আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ হওয়ার চেহারা দেখেছে, ব্যাংকিং খাতে লুটপাট, শেয়ারবাজারে ডাকাতির খবর জেনেছে। উচ্চ আদালত নির্দেশ দেওয়ার পরও ডাকসুসহ ছাত্র সংসদ নির্বাচন আয়োজনের কোনো উদ্যোগ-আলামত নেই। এতে সরকারবিরোধী মনোভাবও ভিতরে ভিতরে ঠাঁই পাচ্ছে।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেওয়া বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ ’৭৩-এর সুবাদে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা দলবাজি করছেন। দলীয় আনুগত্যের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে প্রশাসনিক পদ-পদবি এমনকি অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিক নিয়োগ লাভ করে ভোগবাদী হয়ে উঠছেন। সর্বস্তরে তাদের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় কর্মচারীরাও নির্বাচনী অধিকার ভোগ করছেন। দিনে দিনে দেনা এতটাই বেড়েছে যে, ২৭ বছর ধরে ছাত্রসমাজ অধিকারহারা হয়ে বসে আছে। ডাকসুসহ বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচন বন্ধ করে রাখা হয়েছে। গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক শাসনব্যবস্থায় ছাত্র সংসদ নির্বাচন বন্ধ রাখা হলেও মার্শাল ল জমানায় বন্ধ করেনি। স্বাধীনতার ৪৭ বছর ধরে কোটা প্রথা যেমন বাড়ছে, অলিগলি পথে যেমন মেধাহীনরা মেধাবীদের পেছনে ফেলে বাগিয়ে নিচ্ছে সরকারি চাকরি তেমনি দিনে দিনে ছাত্রসমাজের অসন্তোষ ও ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হতে হতে আজ বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। আজকের নির্বাচিত ডাকসু থাকলে উপাচার্যের বাসভবনে এমন নারকীয় হামলা হতো না। চারুকলায় এই বর্বরতা ঘটত না। সোমবার রাতে আন্দোলনকারীদের হাতে সাংবাদিকরা মার খেতেন না। আলোচনার টেবিলে সমাধান লাভের পর আবার কেউ পাল্টা আন্দোলনের হুমকি দিত না।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা রাজপথে যখন নেমেছিল, জীবনযাত্রা অচল করে দিয়েছিল। শান্তিপূর্ণ এমন ছাত্র আন্দোলন বাংলাদেশে আর কখনো হয়নি। সেটিও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক উদ্যোগে শান্তিপূর্ণ সমাধান পেয়েছিল। এবারও এই দেশে সব আন্দোলন-সংগ্রামের সূতিকাগার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ঘিরে শাহবাগে দ্রোহের আগুনে জ্বলে ওঠা ছাত্রছাত্রীরা শান্তিপূর্ণ অবস্থান নিয়েছিল। পুলিশ সেখানে জোর করে তাদের তুলে দিতে গিয়ে সংঘর্ষ বাধায়। আর সেখান থেকে বিদ্যুত্গতিতে বারুদের মতো জ্বলে ওঠে তারুণ্য। তারুণ্যের এই দ্রোহ এই বিদ্রোহ ইতিহাসের উত্তরাধিকারিত্বই বহন করে।

আজকের সরকারের প্রধানমন্ত্রী থেকে সিনিয়র মন্ত্রীদের ষাটের দশকের উত্তাল ছাত্র রাজনীতির অভিজ্ঞতা ও চিত্রপট চোখের সামনে রয়েছে। জিয়া-এরশাদের শাসনামলের অভিজ্ঞতা তো অনেকের রয়েছে। এই দেশের জন্মের আন্দোলন-সংগ্রাম থেকে সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনে নেতৃত্বদানে অভিজ্ঞতা রয়েছে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী স্বাধীনতা-সংগ্রামী আওয়ামী লীগের।

উপমহাদেশের ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ আজকে ক্ষমতায়। আওয়ামী লীগ নেতারা জানেন এবং বোঝেন আজ যদি বিএনপি ক্ষমতায় থাকত আর তারা বিরোধী দলে থাকতেন তাহলে এই ছাত্র বিক্ষোভকে রাজনীতির দাবার চালে মহাপ্রলয়ে রূপ দিতেন। আন্দোলনের রাজনীতির লেখাপড়ায় বিএনপি যেখানে পাঠশালায়, আওয়ামী লীগ সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের পর্ব শেষ করা। অর্থাৎ আন্দোলনের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের কাছে বিএনপি এক নাবালক শিশুমাত্র। এখানে বিক্ষুব্ধ ছাত্রসমাজ প্রধানমন্ত্রীর কাছে তাদের দাবি পূরণের আশ্বাস চাইছে। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার প্রতি তারা এখনো ভরসা রাখছে। আমাদের বিশ্বাস, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাত্রসমাজের আবেগ-অনুভূতির জায়গাটি ধারণ করে একটি সমাধানের পথ দেবেন। যে সমাধান ছাত্রছাত্রীদের হাসিমুখে পড়ার টেবিলে ফিরিয়ে দেবে।

তারুণ্যের দ্রোহকে রাজনৈতিকভাবে সমাধান দিতে হবে। সরকার ও রাজনৈতিক শক্তিকে উপলব্ধি করতে হবে, রাষ্ট্রকে নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করতে হলে সংবিধান ও আইনের আলোকে নাগরিকদের প্রাপ্য অধিকার বুঝিয়ে দিতে হবে। পৃথিবীর কোনো উন্নত দেশ কোটা প্রথাকে মেধার ওপরে জায়গা দেয়নি। আমরাও দিতে পারি না।

যখন যে দল ক্ষমতায় আসে সরকরি প্লট নাগরিকদের জন্য লটারির মাধ্যমে পাওয়ার সুযোগ করে দেয়। সংবিধান জনগণকে ক্ষমতাবান করলেও দেখা যায়, সেখানে ভাগ্যবিড়ম্বিত সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিকের কপালে লটারিতে নাম না ওঠার কারণে একটি প্লট জোটে না। কিন্তু সরকারের কোটা প্রথায় বৈষম্যের সৃষ্টির কারণে লটারি ছাড়াই অনেকের ভাগ্যে প্লট জুটে যায়। এমনকি যখন যে দল ক্ষমতায় তাদের অনুগত অন্ধ লেখক, সাংবাদিক, শিল্পী, সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদরাও সেই সুযোগ লাভ করে থাকেন।

সারা জীবন রাজনীতি করেন, নির্যাতন ভোগ করেন, দলের জন্য শ্রম দেন, মানুষের সুখ-দুঃখে পাশে থাকেন। কিন্তু কোনো মন্ত্রী-এমপি মারা গেলে আবেগ কোটায় তাদের স্ত্রী-সন্তানরা মনোনয়ন বাগিয়ে নেন। রাজনৈতিক কর্মীদের মূল্যায়ন হয় না। এই পরিবার কোটা কার্যকর করা ঠিক নয়। যদি না রাজনীতিতে ভূমিকা রাখা যোগ্য স্ত্রী-সন্তান না থাকেন। অনেকের বেলায় উপর থেকে সেই কোন জমানায় দলের এমপি-মন্ত্রী হওয়া মরহুমদের সন্তানকে এনে চাপিয়ে দেওয়া হয় তৃণমূল নেতৃত্বে।

চাকরি ক্ষেত্রে কোটা প্রথা সংস্কার দাবিতে ছাত্রসমাজের জ্বলে ওঠা আন্দোলনে সরকারের প্রতি অসন্তুষ্ট নাগরিকদের সক্রিয় ভূমিকা না থাক মানসিক সমর্থন টের পাওয়া যাচ্ছে। তারুণ্যের দ্রোহকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাজনৈতিকভাবে সমাধানই দেবেন না, রাষ্ট্রীয়ভাবে সমাজ জীবনে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় অনন্যসাধারণ ভূমিকা রাখবেন। বঙ্গবন্ধুকন্যার কাছে মানুষের এই প্রত্যাশাটুকু থাকতেই পারে। কোটা প্রথায় অনগ্রসরদের তুলে আনতে গিয়ে মেধাবীদের পিছিয়েই নয়, হতাশা-ক্ষুব্ধ করা হচ্ছে। এই কোটা প্রথা তুলে না দিন, কমিয়ে আনুন। অনাকাঙ্ক্ষিত অঘটন ঘটার আগেই তারুণ্যের দ্রোহকে শান্ত করুন। তাদের দাবি ও আন্দোলন যৌক্তিক এবং ন্যায্য। তারুণ্যের শক্তিকে উপেক্ষা করা রাজনৈতিক সরকারের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।

লেখক : প্রধান সম্পাদক, পূর্বপশ্চিমবিডি.নিউজ।

সর্বশেষ খবর