বুধবার, ১১ এপ্রিল, ২০১৮ ০০:০০ টা

বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা বিষয়ে আমার কিছু ভাবনা

অধ্যাপক ড. ফজলুল হালিম চৌধুরী

বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা বিষয়ে আমার কিছু ভাবনা

বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষায় নানাবিধ সমস্যা রয়েছে। দেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদগণ আমাদের শিক্ষাঙ্গনের চরম দুরবস্থা, সন্ত্রাস, সেশনজট, আসন স্বল্পতা, দুর্বল ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। বস্তুত এসব সমস্যা আমাদের কাছে অপরিচিত নয়-সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, কমিশন ইত্যাদির মাধ্যমে এসব সমস্যা সমাধানের জন্য অনেক সুচিন্তিত সুপারিশও উপস্থাপিত হয়েছে। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য আজ পর্যন্ত শিক্ষাঙ্গনে সুশৃঙ্খল পরিবেশ ফিরিয়ে আনার উদ্দেশ্যে কোনো বলিষ্ঠ এবং দৃঢ় প্রতিজ্ঞ পদক্ষেপ যথাযথভাবে নেওয়া হয়নি। ফলে চরম হতাশায় ভুগছেন আমাদের শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীরা। কেবল যে শিক্ষা ও গবেষণার মানের দ্রুত অবনতি ঘটছে তাই নয়- ধীরে ধীরে দেশবাসী বিশ্বাস হারিয়ে ফেলছে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা, বিশেষ করে উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থার ওপর। জাতির ভবিষ্যৎ হয়ে উঠছে অনিশ্চিত।

আলোচনা করা যাক কলেজ শিক্ষা প্রসঙ্গে। পরিকল্পিতভাবে কলেজ শিক্ষার মানোন্নয়ন এবং কলেজে শিক্ষার সুযোগ সম্প্রসারণের জন্য প্রয়োজনীয় অনুদান দেওয়ার দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের ওপর ন্যস্ত করার প্রস্তাব বেশ কয়েকবার সরকারের কাছে পাঠানো হয়েছিল-কিন্তু সরকারের কাছে সেটা গ্রহণযোগ্য হয়নি। ১৯৮০ সালে বাংলাদেশ সরকারের অনুরোধে ইউএনডিপি-ইউনেস্কোর ১৩ সদস্যের একটি আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ দল বাংলাদেশের আর্থসামাজিক পরিস্থিতিতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যথাযথ বিকাশের উদ্দেশ্যে একটি রিপোর্ট সরকারের কাছে পেশ করেন। এ রিপোর্টে মত প্রকাশ করা হয় যে কলেজে বিজ্ঞান শিক্ষা ব্যবস্থায় পাঠ্যসূচি নির্বাচনের ব্যাপারে অনমনীয়তা পরিহার করে বৈচিত্র্যের প্রতিফলন ঘটিয়ে গতানুগতিক পাঠ্যসূচির পুনর্বিন্যাস করা বাঞ্ছনীয়। বিজ্ঞান বিষয়ের সিলেবাসে মৌলিক বিজ্ঞানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রযুক্তির ওপর জোর দেওয়া এবং তৃতীয় বিষয়টিতে সম্পূর্ণরূপে উপযুক্ত প্রযুক্তি সম্পর্কে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করার পক্ষেও অভিমত প্রকাশ করা হয়। কমিটি আশা প্রকাশ করে যে, এ জাতীয় কোর্সের মাধ্যমে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীরা অধিক কর্মোপযোগী হবে এবং দেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করা তাদের পক্ষে সহজতর হবে। অন্যান্য অনেক রিপোর্টের মতো এ রিপোর্টটিও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা হয়নি। বহু যুগ আগে যে পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যসূচি চালু করা হয়েছিল সেটা এখনো চলছে এবং বেকার তৈরির কারখানা হিসেবে কলেজগুলো কাজ করে যাচ্ছে।

একবিংশ শতাব্দীর দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই চলছে জ্ঞান, বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির বিকাশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার প্রস্তুতি। শিক্ষাকে উন্নয়ন এবং দারিদ্র্য দূরীকরণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের জন্য দক্ষ জনশক্তি সৃষ্টির উদ্দেশ্যে নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রম, পাঠ্যসূচি ও গবেষণা কর্মসূচি বিস্তারিত পরীক্ষা- নিরীক্ষার পর নতুনভাবে, নতুন আঙ্গিকে ঢেলে সাজানো হচ্ছে। নতুন নতুন পদ্ধতি চালু করা হচ্ছে, নতুন নতুন উপকরণের মাধ্যমে শিক্ষাব্যবস্থাকে করে তোলা হচ্ছে আরও আকর্ষণীয়, অর্থবহ এবং ফলপ্রসূ। আধুনিক ব্যবস্থাপনা পদ্ধতির মাধ্যমে একদিকে যেমন বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক স্বায়ত্তশাসনকে জোরদার করা হচ্ছে, অন্যদিকে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বস্তরে জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থাপনার ওপরও বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হচ্ছে। আশা করা হচ্ছে যে, কাছে ভবিষ্যতে নতুন নতুন প্রযুক্তি, যথা সুপার কনডাকটিভিটি, সৌরশক্তি, বায়োটেকনোলজি ও জেনেটিন ইঞ্জিনিয়ারিং, কম্পিউটার ও তথ্যপ্রযুক্তি ইত্যাদি, সাধারণ মানুষের কল্যাণে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে সক্ষম হবে। জনসংখ্যা বিস্ফোরণ এবং পরিবেশের ভারসাম্যের সংকট থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার উপায় উদ্ভাবনের পরীক্ষা- নিরীক্ষাও চলছে সর্বত্র। ছোট ও মাঝারি শিল্প প্রসারের উদ্দেশ্যে তরুণ উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণ ও পরামর্শদানের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়, শিল্প প্রতিষ্ঠান এবং সরকারের মিলিত প্রচেষ্টায় স্থাপন করা হচ্ছে বিজ্ঞান পার্ক। আমরা কি প্রযুক্তি বিকাশের এ প্রক্রিয়ায় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করব নাকি অতীতের মতো শুধু দর্শকের ভূমিকাই পালন করে যাব?

তবে আমরা সবাই জানি যে, উচ্চশিক্ষার সংস্কার ও আধুনিকীকরণ করতে হলে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন বিশেষ করে সেটা যদি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক হয়। বাংলাদেশের মতো পৃথিবীর অনেক দেশেই শিক্ষা মন্ত্রণালয় বরাদ্দকৃত অর্থ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় অনেক টানাপড়নের মধ্যে কোনোরকমে তাদের দায়িত্ব পালন করার চেষ্টা করে একাডেমিক কর্মসূচির সম্প্রসারণ অথবা গবেষণার সরঞ্জাম সরবরাহ করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেটে উল্লেখযোগ্য বরাদ্দ রাখা সম্ভব হয় না। তাহলে এর প্রতিকার কি? সরকারের উচ্চতম মহলে, বিশেষ করে রাজনৈতিক পর্যায়ে যদি সত্যিকার অর্থে বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি শিক্ষা ও গবেষণার উন্নয়ন ও সম্প্রসারণের দৃঢ় অঙ্গীকার থাকে তাহলে আমাদের সীমিত সম্পদ নিয়েও আমরা অগ্রগতির পথে এগিয়ে যেতে পারি যেমনটা করা হচ্ছে প্রতিবেশী রাষ্ট্রে। ভারতবর্ষে কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়/বিভাগ নিজ নিজ বিষয়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি উন্নয়ন সম্পর্কিত কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত রয়েছে যার মধ্যে বেশ কয়েকটা সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর অধীনে। এসব মন্ত্রণালয়/বিভাগের দায়িত্বে নিয়োজিত সচিবদের মধ্যে বেশিরভাগই বিজ্ঞানী। সুনির্দিষ্ট প্রকল্প এবং বিশেষজ্ঞদের সুপারিশের ভিত্তিতে এসব সরকারি মন্ত্রণালয়/বিভাগ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি উন্নয়নে নিয়োজিত সব প্রতিষ্ঠানসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতী শিক্ষকদের গবেষণারও ব্যয়ভার বহন করে থাকে। প্রকৃতপক্ষে এ ধরনের অনুদানের সদ্ব্যবহার করে ভারতবর্ষের বেশ কিছু উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে।

উচ্চশিক্ষায় সংকট দূর করতে হলে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ে মনোযোগ দেওয়া ছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উচ্চশিক্ষার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করাও প্রয়োজন। তবে স্থায়ীভাবে বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে শান্ত ও অনুকূল পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হলে কিছু দীর্ঘমেয়াদি ও সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নিতে হবে। এটা সর্বজনস্বীকৃত যে ক্যাম্পাসে ছাত্র সংগঠনগুলো তাদের নিজ নিজ রাজনৈতিক দলের অঙ্গ সংগঠন হিসেবে এসব দলের কর্মসূচি বাস্তবায়নের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। তবে এর জন্য প্রথমেই ছাত্র-সংগঠনগুলোকে তাদের নিজস্বতা নিয়ে কাজ করতে হবে। ছাত্ররা অবশ্যই রাজনীতি-সচেতন হবে। যেহেতু তারা আদর্শবাদী, আবেগপ্রবণ সেহেতু অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে তারা সোচ্চার হবে এটা অত্যন্ত স্বাভাবিক। একটা কথা বোধ হয় আমাদের সবারই মনে রাখা প্রয়োজন যে, বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হয় মূলত জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার কেন্দ্র হিসেবে, জুনিয়র স্কলার এবং সিনিয়র স্কলারদের জ্ঞান ও চিন্তা বিনিময়ের স্থান হিসেবে। এখানে রাজনীতির চর্চা আনুষঙ্গিক, সংস্কৃতি ও খেলাধুলা চর্চার মতো। কোনো অবস্থাতেই সার্বক্ষণিক দলীয় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালানোর স্থান বিশ্ববিদ্যালয় নয়। নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে তাদের স্বার্থ সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়ার দায়িত্বও ছাত্র সমাজের। একটি ছাত্র যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষ সম্মান শ্রেণিতে ভর্তি হয় তখন তার সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি অলিখিত চুক্তি হয়ে যায়। এ চুক্তি অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব হলো নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তার সব কোর্স শেষ করে পরীক্ষা নেওয়ার ব্যবস্থা করা এবং উত্তীর্ণ হলে তাকে ডিগ্রি প্রদান করা আর ছাত্রের দায়িত্ব হলো এমন কিছু না করা যেটা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কর্মসূচি বাস্তবায়নের পথে বাধার সৃষ্টি করতে পারে।

উপরোক্ত বিষয়গুলোতে মনোযোগ দেওয়ার পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক স্বায়ত্তশাসন জোরদার করা এবং দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বস্তরে জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থাপনা চালু করার বিষয়েও গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। এ প্রসঙ্গে কিছু বলার আগে আমি আমার একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা সম্পর্কে অবহিত করতে চাই। ১৯৮২ সালে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের আমন্ত্রণে আমি সে দেশের বেশকিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের একাডেমিক কর্মসূচি এবং ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি দেখার সুযোগ পাই। তুলনামূলক বিশ্লেষণের উদ্দেশ্যে আমি এমন একটি আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয় বেছে নিয়েছিলাম যেটার ছাত্র ও শিক্ষক সংখ্যা ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও শিক্ষক সংখ্যার প্রায় সমান। উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আলোচনার সময় এক পর্যায়ে তিনি জানতে চাইলেন যে, আমার সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়জন কর্মকর্তা তাদের সমস্যা নিয়ে দেখা করতে পারে। আমি কেবল বিভাগীয় চেয়ারম্যান, ডিন, প্রভোস্ট, ইনস্টিটিউটের পরিচালক এবং অফিসপ্রধানদের সংখ্যা হিসাব করে উত্তর দিয়েছিলাম যে, ৭৫ জন কর্মকর্তার তাদের বিভাগের সমস্যা নিয়ে আমার সঙ্গে আলোচনা করার অধিকার রয়েছে। আমার উত্তর শুনে তিনি অবাক বিস্ময়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন এবং বললেন যে ‘হয় আপনি একজন অতি মানব আর না হয় আপনি আপনার দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালন করছেন না।’ আলোচনা প্রসঙ্গে তিনি আমাকে জানালেন যে মাত্র সাত/আটজন কর্মকর্তার তার সঙ্গে দেখা করার অধিকার রয়েছে, এরা সবাই ভাইস প্রেসিডেন্ট অথবা ওই পর্যায়ের কর্মকর্তা। বিভাগীয় কর্মসূচি বাস্তবায়নের সম্পূর্ণ দায়িত্ব বিভাগের চেয়ারম্যানের এবং এ ব্যাপারে তারা সংশ্লিষ্ট ডিনের কাছে দায়ী থাকেন। প্রেসিডেন্ট আমাকে আরও জানালেন যে, তার প্রধান কাজ হচ্ছে দেশি এবং বিদেশি বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কর্মসূচি পর্যালোচনা করা এবং নতুন কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহ করা। ১৬ হাজার ছাত্রের এ বিশ্ববিদ্যালয়ে রীতিমতো ক্লাস হচ্ছে, ইন-কোর্স এবং সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা হচ্ছে এবং পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যে ফল প্রকাশ করা হচ্ছে।

১২টি বিভাগ, ৮৭৭ জন ছাত্র, ৬০ জন শিক্ষক, তিনটি অনুষদ ও তিনটি ছাত্রাবাস নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয় ১৯২১ সালে। যাত্রালগ্নে এ বিশ্ববিদ্যালয়টির একাডেমিক কর্মকাণ্ডের ব্যবস্থাপনার জন্য যেসব অর্ডিন্যান্স প্রণয়ন করা হয়েছিল এবং যে ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি চালু করা হয়েছিল সেগুলোর তেমন কোনো মৌলিক পরিবর্তন আজ পর্যন্ত হয়নি। বাকি তিনটি সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুকরণে। ফলে ব্যবস্থাপনা পদ্ধতির মধ্যে তেমন কোনো পরিবর্তন অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েও আসেনি। কয়েকশ সদস্য নিয়ে গঠিত একাডেমিক পরিষদের বিবেচনার জন্য যেসব বিষয় উপস্থাপিত হয় তার শতকরা ৮০ ভাগই বিভাগ অথবা অনুষদ পর্যায়ে মীমাংসিত হতে পারে। একাডেমিক পরিষদ কেবল নীতিনির্ধারণী বিষয় নিয়ে আলোচনা করবে এবং সিদ্ধান্ত নেবে। কোনো একটি বিভাগের এম.ফিল অথবা পি-এইচ.ডি ছাত্রের গবেষণার বিষয়বস্তু পরীক্ষা অথবা থিসিসের পরীক্ষক নিয়োগের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে সব অধ্যাপককে ডাকার দরকার পড়ে না, অনুষদভিত্তিক বোর্ড অব অ্যাডভান্সড স্টাডিজই এ দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে এবং আরও বেশি সময় নিয়ে পালন করতে পারে। সুনির্দিষ্ট নীতিমালা অনুযায়ী ছাত্র ভর্তির ব্যবস্থা, অনুষদের অন্তর্ভুক্ত সব বিভাগের পাঠ্যকর্ম প্রণয়ন ও কোর্সের অগ্রগতির তত্ত্বাবধান, নির্দিষ্ট সময়ে অনুষদের সব বিভাগের পরীক্ষা গ্রহণ ও যথাসময়ে সব পরীক্ষার্থীর ফল প্রকাশ, বিভাগে বিভাগে নতুন পদ সৃষ্টি ও শিক্ষক নিয়োগেরও ব্যাপারে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ প্রভৃতি সব বিষয়েই ডিনকে পূর্ণ দায়িত্ব নিতে হবে। বিভিন্ন পর্যায়ে তদারকি ব্যবস্থা এবং দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে সহায়ক হবে বলে আমি মনে করি।

একাডেমিক প্রশাসন সম্পর্কে যে কোনো আলোচনায় আমাদের প্রথমেই চিন্তা করতে হবে বিভাগগুলো সম্পর্কে, কারণ বিভাগগুলোই একাডেমিক কর্মকাণ্ডের প্রাণকেন্দ্র। বিভাগের প্রশাসনিক ব্যবস্থায় যদি কোনো দুর্বলতা, কিংবা অনিশ্চয়তা থাকে, তাহলে একাডেমিক কর্মকাণ্ডের মান, সময়সূচি ও সামগ্রিক অগ্রগতি ব্যাহত হতে বাধ্য। বিভাগের যাবতীয় কাজকর্ম যে পূর্ণগণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে পরিচালিত হওয়া দরকার, এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় শিক্ষকদের অংশগ্রহণ যে একান্ত আবশ্যক, এ সম্পর্কে দ্বিমত থাকার কোনো অবকাশ নেই। কিন্তু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায়ও প্রত্যেক প্রশাসনিক ইউনিটের এমন একজন প্রধান থাকা দরকার, যিনি নেতৃত্ব দিতে পারেন, উদ্যোগ নিতে পারেন এবং সুষ্ঠুভাবে দায়িত্ব সম্পাদন করার নিশ্চয়তা বিধান করতে পারেন।

১৯৭৩ এর আদেশ চালু হওয়ার আগে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সাধারণত বিভাগের প্রবীণতম শিক্ষককেই বিভাগীয় প্রধান নিয়োগ করতেন এবং বিভাগীয় প্রধান বিভাগের কাজকর্ম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে দায়ী থাকতেন। শিক্ষক নিয়োগ, নতুন পদ সৃষ্টি, নতুন একাডেমিক কর্মসূচি প্রবর্তন, ছাত্র ভর্তি, প্রকাশনা, শিক্ষক প্রশিক্ষণ প্রভৃতি সব বিষয়েরই তিনি এককভাবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে পরামর্শ দিতেন। অনেকেই বলেন যে, যেহেতু কো-অর্ডিনেশন কমিটি ও একাডেমিক কমিটি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শিক্ষকদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হয়েছে, সুতরাং চেয়ারম্যানের পদে আবর্তনের প্রয়োজন নেই। চেয়ারম্যানের ভূমিকা পালনে প্রবীণতম শিক্ষকই যে যোগ্যতম বিবেচিত হবেন, এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। তবে যেহেতু প্রবীণ নেতৃত্বের প্রশ্ন রয়েছে, সেহেতু শিক্ষকদের মধ্য থেকেই যেন চেয়ারম্যান নিয়োগ করা যায়, সে ব্যবস্থা চালু করা বাঞ্ছনীয়। উপরোক্ত বিষয়গুলো পর্যালোচনা করে নীতিনির্ধারণ করলে বাংলাদেশে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে উচ্চশিক্ষার ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হবে বলে আমি আশা করি।

লেখক : প্রয়াত অধ্যাপক, ফলিত রসায়ন বিভাগ, প্রাক্তন স্থায়ী সদস্য, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন এবং সাবেক

উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

 

[গতকাল ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. ফজলুল হালিম চৌধুরীর ২২ তম মৃত্যুবার্ষিকী। লেখাটি ড. শামসুজ্জোহা স্মারক বক্তৃতা : ১৯৯৩-এ ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি : কিছু ব্যক্তিগত ভাবনা’ শিরোনামে প্রয়াত অধ্যাপক ড. ফজলুল হালিম চৌধুরী প্রদত্ত বক্তৃতার পরিমার্জিত অংশবিশেষ। লেখকের কন্যা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিমের কাছে থেকে লেখাটি সংগৃহীত।]

সর্বশেষ খবর