শনিবার, ১৪ এপ্রিল, ২০১৮ ০০:০০ টা

মেরাজের শিক্ষা ও করণীয়

মুফতি আমজাদ হোসাইন হেলালী

মেরাজের শিক্ষা ও করণীয়

আলোচ্য শিরোনামটিকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। এক. মেরাজের শিক্ষা। দুই. উম্মতের করণীয়। মেরাজের শিক্ষা, ইতিহাস ও হিকমত কী? এ সম্পর্কে মহান রব্বুল আলামিন সূরা বনি ইসরাইলের ১ নম্বর আয়াত নাজিল করেছেন। ইরশাদ হচ্ছে, ‘পরম পবিত্র ও মহিমাময় সত্তা তিনি, যিনি স্বীয় বান্দাকে রাতের বেলায় ভ্রমণ করিয়েছিলেন মাসজিদুল হারাম থেকে মাসজিদুল আকসা পর্যন্ত; যার চারদিকে আমি পর্যাপ্ত বরকত দান করেছি, যাতে আমি তাঁকে কুদরতের কিছু নিদর্শন দেখিয়ে দিই। নিশ্চয়ই তিনি পরম শ্রবণকারী ও দর্শনশীল।’ আলোচ্য আয়াতে আল্লাহতায়ালা জ্ঞানের গভীর ভাণ্ডার নাজিল করেছেন, যা জ্ঞানী সম্প্রদায় ঠিকই বুঝতে পারে। উক্ত আয়াতের সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা বুঝলে মেরাজের শিক্ষা সহজে বুঝে আসবে ইনশা আল্লাহ। আয়াত শুরু হয়েছে ‘সুবহান’ শব্দ দ্বারা। এ শব্দটি আল্লাহর গুণবাচক নাম। অর্থ মহিমাময়, আল্লাহর স্তুতিগান, অতিশয় পবিত্র। এ শব্দের মাধ্যমে আল্লাহ বান্দাকে শিক্ষা দিচ্ছেন যে, অত্যাশ্চর্য কোনো বিষয় সামনে এলে ‘সুবহানাল্লাহ’ বলে রব্বুল আলামিনের গুণকীর্তন করতে হয়। এ শব্দের মাধ্যমে বোঝানো হচ্ছে সামনে যে বিষয়টি আলোচনা করা হবে তা দুনিয়ার মধ্যে অত্যাশ্চর্য বিষয়। এমন আশ্চর্য বিষয় ঘটানো কোনো মাখলুকের পক্ষে কস্মিনকালেও সম্ভব নয়। মেরাজের অনেক শিক্ষার মধ্য থেকে এটাও একটা শিক্ষা যে, আমাদের সামনে অতি আশ্চর্যজনক কোনো ঘটনা ঘটলে আমরা সঙ্গে সঙ্গে ‘সুবহানাল্লাহ’ বলব। পরবর্তী শব্দ ‘আসরা’ এসেছে। এটি ‘ইসরা’ শব্দ থেকে নির্গত। এর আভিধানিক অর্থ রাতে নিয়ে যাওয়া। পরিভাষায় ‘আসরা’ বলা হয়, মাসজিদুল হারাম থেকে মাসজিদুল আকসা পর্যন্ত নিয়ে যাওয়াকে। আর মাসজিদুল আকসা থেকে আসমান পর্যন্ত নিয়ে যাওয়াকে মেরাজ বলা হয়। এখানে আমরা বুঝতে পারলাম, ইসরা ও মেরাজ দুই জায়গা থেকে ভ্রমণ করানোর নাম। আমাদের সমাজে অনেকে ইসরা ও মেরাজের মধ্যে পার্থক্য করতে না পেরে গোলমাল পাকিয়ে ফেলেন। এরপর ‘বিআবদিহি’ শব্দ উল্লেখ করা হয়েছে। অর্থ ‘নিজের বান্দাকে’। এ শব্দটি একটি বিশেষ প্রেমময়তার প্রতি ইঙ্গিত বহন করে। কেননা আল্লাহতায়ালা স্বয়ং কাউকে ‘আমার বান্দা’ বললে এর চেয়ে বড় সম্মান-মর্যাদা তাঁর জন্য আর কিছুই হতে পারে না। এখানে হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অতি সম্মান ও মর্যাদা প্রকাশ করা হয়েছে। তিনি আল্লাহতায়ালার অসাধারণ একজন বান্দা ও রসুল। সুতরাং এই অসাধারণ বান্দা ও রসুল জমিনবাসীর কাছে যা কিছু বলেন, সবকিছুই আল্লাহর পক্ষ থেকে আদিষ্ট হয়ে অকাট্য প্রমাণাদির ভিত্তিতে সঠিক ও সত্য বলেন। তিনি যেমন আল্লাহর অসাধারণ বান্দা ও রসুল, অনুরূপ তাঁর বাণীগুলোও অসাধারণ। এই ইয়াকিন ও বিশ্বাস রাখাও মেরাজের শিক্ষা। পরবর্তী শব্দ ‘লাইলান’। এ শব্দটি ‘নাকিরা’ অর্থাৎ অনির্দিষ্ট সময় বা কালকে বোঝায়। এ শব্দটি ব্যবহার করে এদিকেও ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, হজরত রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে উপর জগৎ ভ্রমণ করিয়েছেন রাতের কিছু অংশে, পুরো রাতে নয়। এ কথাটি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করাও মেরাজের শিক্ষা। তাই তো রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মেরাজের ঘটনা যখন হজরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) শুনলেন সঙ্গে সঙ্গেই তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে নিলেন। কারণ তিনি জানেন নবীজি যেহেতু আল্লাহর অসাধারণ বান্দা ও রসুল তাই তিনি যা কিছু বলেন এবং করেন তার সবই সঠিক ও সত্য। এখানে যাচাই-বাছাইয়ের কোনো প্রয়োজন নেই। মেরাজের পুরো ঘটনা সশরীরে হয়েছে। এ কথাটি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করাও মেরাজের অন্যতম শিক্ষা। ইসরা ও মেরাজ অকাট্য আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে। সূরা নাজমেও মেরাজ সম্পর্কে রব্বুল আলামিন আলোকপাত করেছেন। অনেক মুতাওয়াতির হাদিস দ্বারাও প্রমাণিত। সম্মান ও গৌরবের স্তরে পৌঁছা এই ইসরা ও মেরাজ কবে বা কত তারিখে হয়েছে এ সম্পর্কে ইতিহাসের কিতাবে বিভিন্ন তারিখ পাওয়া যায়। ইমাম কুরতুবি (রহ.) বলেছেন, তাফসির গ্রন্থে মেরাজের সঠিক তারিখ সম্পর্কে বিভিন্ন রেওয়ায়েত পাওয়া যায়। মুসা ইবনে ওকবার রেওয়ায়েত এই যে, ঘটনাটি হিজরতের ছয় মাস আগে সংঘটিত। হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, হজরত খাদিজার (রা.) ওফাত ও নামাজ ফরজ হওয়ার আগেই হয়েছিল। ইমাম জুহরি বলেন, হজরত খাদিজার (রা.) ওফাত ও নবুয়তপ্রাপ্তির সাত বছর পর হয়েছিল। কোনো কোনো রেওয়ায়েত রয়েছে, মেরাজের ঘটনা নবুয়তপ্রাপ্তির পাঁচ বছর পর ঘটেছে। ইবনে ইসহাক বলেন, মেরাজের ঘটনা তখন ঘটেছিল, যখন ইসলাম আরবের সাধারণ গোত্রসমূহে বিস্তৃতি লাভ করেছিল। এসব রেওয়ায়েতের সারমর্ম এই যে, মেরাজের ঘটনাটি হিজরতের কয়েক বছর আগে সংঘটিত হয়েছিল। ইমাম হরবি বলেন, ইসরা ও মেরাজের ঘটনা রবিউস সানির ২৭তম রাতে হিজরতের এক বছর আগে ঘটেছে। ইবনে কাসেম সাহাবি বলেন, নবুয়তপ্রাপ্তির ১৮ মাস পর এ ঘটনা ঘটেছে। মুহাদ্দিসরা বিভিন্ন রেওয়ায়েত উল্লেখ করার পর কোনো সিদ্ধান্ত লিপিবদ্ধ করেননি। কিন্তু সাধারণভাবে খ্যাত এই যে, রজবের ২৭তম রাত মেরাজের রাত। মুহাদ্দিসরা যেভাবে আলোচনা করেছেন সে অনুযায়ী ইয়াকিন ও বিশ্বাস করাও মেরাজের শিক্ষা। এ ছাড়া মেরাজের আরও শিক্ষা রয়েছে যা এই সংক্ষিপ্ত নিবন্ধে লেখা সম্ভব নয়। এক. উম্মতের করণীয়। উম্মতের প্রধানতম করণীয় হলো ইসরা ও মেরাজ সশরীরে হয়েছে তার ওপর ইমান আনা। দুই. রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মেরাজে গিয়ে যা কিছু দেখেছেন যেমন জান্নাত, জাহান্নাম, আল্লাহতায়ালার কুদরতের বিভিন্ন নিদর্শন, পাপীদের বিভিন্ন আজাব ইত্যাদি বিশ্বাস করা। কারণ নবী দেখা মানেই উম্মতের দেখা। উম্মতের নতুনভাবে দেখার কোনো প্রয়োজন নেই। তিন. নবীজি মেরাজে গিয়ে আল্লাহর পক্ষ থেকে উম্মতের জন্য যে মহাপুরস্কার হাদিয়াস্বরূপ নামাজ নিয়ে এসেছেন তা বিশ্বাস করা।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর