শুক্রবার, ২০ এপ্রিল, ২০১৮ ০০:০০ টা
জন্মশতবার্ষিকীর শ্রদ্ধা

ভাষাসংগ্রামী শওকত আলী

মহিউদ্দিন আল আমান শাহেদ

ভাষাসংগ্রামী শওকত আলী

আজ ২০ এপ্রিল, ভাষাসংগ্রামী ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক শওকত আলীর জন্মশতবার্ষিকী। ১৯১৮ সালের এদিনে তিনি পুরান ঢাকার গেন্ডারিয়ায় এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। শমশের আলী ও মেহেরুননেসা খানমের জ্যেষ্ঠ সন্তান ছিলেন তিনি। পুরান ঢাকার সরকারি মুসলিম হাইস্কুলে তার শিক্ষাজীবন শুরু হয়। এ স্কুলে অধ্যয়নকালে তিনি ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। অষ্টম শ্রেণির ছাত্র থাকাকালে শওকত আলী রাজনৈতিক সম্মেলনে যোগ দিতে দিল্লি যান। রাজনীতির ময়দানে সাহসিকতা ও সাংগঠনিক দক্ষতার পরিচয় দিয়ে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তরুণ এই নেতা সব মহলে পরিচিত হয়ে ওঠেন। গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর স্নেহভাজন রাজনৈতিক শিষ্য ছিলেন তিনি। ভাষা আন্দোলন, স্বাধিকার-স্বাধীনতা আন্দোলনসহ প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে তার ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের প্রাথমিক পর্যায়েই তিনি এ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। ১৯৪৭ সালের প্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ, ১৯৪৮ সালের দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ এবং ’৫২ সালের সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের কেন্দ্রীয় কার্যকরী কমিটির সদস্য ছিলেন শওকত আলী। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে প্রথম ধর্মঘট পালিত হয়। এ ধর্মঘট সফল করতে যারা সেদিন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, শওকত আলী, খালেক নেওয়াজ খান, শামসুল হক, অলি আহাদ প্রমুখ। ভাষা আন্দোলন চলাকালে সবচয়ে বেশি পুলিশি নির্যাতনের শিকার হন তিনি এবং ভাষা আন্দোলন করার কারণে তিনি বহুদিন কারাগারে আটক ছিলেন।

জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের অত্যন্ত কাছের মানুষ ও রাজনৈতিক সহযোদ্ধা ছিলেন শওকত আলী। দুই পরিবারের মধ্যেও ছিল নিবিড় আত্মিক সম্পর্ক। অনেক আনন্দময় স্মৃতি জড়িয়ে আছে দুই পরিবার ঘিরে। প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনাকে আমরা ছোটবেলায় হাসু আপা নামেই চিনতাম। শেখ রাসেল আর আমি প্রায় এক বয়সী। আমরা একে অন্যের খেলার সাথী ছিলাম। আমাদের দুই পরিবারের মধ্যে ভালোবাসার সেতুবন্ধ আজীবন অটুট থাকবে।

বঙ্গবন্ধু তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে শওকত আলী সম্পর্কে একাধিকবার স্মৃতিচারণা করেছেন। বঙ্গবন্ধু কলকাতা থেকে তৎকালীন পূর্ববাংলায় এসে আমাদের ১৫০ চক মোগলটুলীর বাসভবনে কিছুদিন অবস্থান করেন। এ প্রসঙ্গে অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন— ‘শামসুল হক সাহেব ও শওকত সাহেব আমাকে পেয়ে খুবই খুশি। শওকত আমাকে নিয়ে কী যে করবে ভেবেই পায় না। তার একটা আলাদা রুম ছিল। আমাকে তার রুমেই জায়গা দিল। আমি তাকে শওকত ভাই বলতাম। সে আমাকে মুজিব ভাই বলত।’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃষ্ঠা-৮৩)।

শওকত আলীর ১৫০ চক মোগলটুলীর বাসভবনটি একটি ঐতিহাসিক বাড়ি (লীগ অফিস নামেই সুপরিচিত ছিল)। এ বাড়িটি ছিল ভাষা আন্দোলন, স্বাধিকার ও স্বাধীনতা আন্দোলনের কর্মীবাহিনীর মিলন ক্ষেত্র। রাজনীতিচর্চার সূতিকাগার হিসেবে পরিচিত ছিল এ বাড়িটি। ভাষা আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ সাংগঠনিক কার্যক্রম এখান থেকেই পরিচালিত হতো। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদ, শামসুল হক, মোহাম্মদ তোয়াহা, জহিরউদ্দিন, খালেক নেওয়াজ খান প্রমুখ এ বাড়িতে থেকেই রাজনীতিচর্চা করতেন। আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক কার্যক্রম এ বাড়ি থেকেই শুরু হয়। আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠার পর এ সংগঠনগুলোর প্রথম অফিস ছিল ১৫০ চক মোগলটুলী। আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন শওকত আলী। আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার পর নতুন এ দলটিকে ঢাকা শহরে সংগঠিত করার ক্ষেত্রে শওকত আলী যে অবদান রেখেছেন তা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। ১৯৫৩ সালের সাপ্তাহিক ‘সৈনিক’ পত্রিকায় শওকত আলীকে নিয়ে লেখায় উল্লেখ করা হয়— শওকত আলী রিলিফ কমিটির সম্পাদক ও ঢাকা ন্যাশনাল গার্ডের নওয়াবে সালার অফিস সেক্রেটারি ও সিলেট রেফারেন্ডামের গ্রুপ লিডার ছিলেন। তিনি বর্তমানে ঢাকা সিটি আওয়ামী লীগের চিফ অর্গানাইজার (সাপ্তাহিক সৈনিক, ২১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫৩, পঞ্চম বর্ষ, ৯৪ সংখ্যা)। আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষের দায়িত্বও পালন করেন তিনি। ১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের গোপন ঘাঁটি ছিল এ বাড়িটি। এ বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের গোপন বৈঠকসহ নানাবিধ কার্যক্রম পরিচালিত হতো। কয়েকবার এ বাড়িটি পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার, আলবদর বাহিনী দ্বারা আক্রান্ত হয়। তারা বিভিন্ন কৌশলে শওকত আলীকে হত্যার অপচেষ্টা চালায়। লোভ-লালসার ঊর্ধ্বে থেকে পরোপকারী এই মানুষটি আজীবন সাধারণ মানুষের পাশে থেকে রাজনীতি করে গেছেন।             ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সকালে বঙ্গবন্ধুর সপরিবারে নিহত হওয়ার দুঃসংবাদে শওকত আলী মারাত্মক ব্রেন স্ট্রোকে আক্রান্ত হন এবং চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৮ আগস্ট ১৯৭৫ এ ইন্তেকাল করেন। তাকে জুরাইন কবরস্থানে দাফন করা হয়।

ভাষা আন্দোলনে কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের জন্য সরকার শওকত আলীকে ২০১১ সালে মরণোত্তর ‘একুশে পদকে’ ভূষিত করে এবং ঢাকা সিটি করপোরেশন মহান ভাষা আন্দোলনে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১০ সালে শওকত আলীর নামে ধানমন্ডিস্থ ৪/এ সড়কটির নামকরণ করে। তিনি জাতির গর্বিত সন্তানদের একজন। তার জন্মশতবর্ষে আমাদের শ্রদ্ধা।

লেখক : ভাষাসংগ্রামী শওকত আলীর ছেলে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর