মঙ্গলবার, ২৪ এপ্রিল, ২০১৮ ০০:০০ টা

বিশৃঙ্খল গণপরিবহন ব্যবস্থা ও একজন রাজীবের মৃত্যু

বিভুরঞ্জন সরকার

বিশৃঙ্খল গণপরিবহন ব্যবস্থা ও একজন রাজীবের মৃত্যু

রাজীব হোসেন নামের এক জীবনদুঃখী তরুণের মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনাটি আমাদের দেশের সড়ক ও গণপরিবহন ব্যবস্থার চরম নৈরাজ্যের চিত্রটাই প্রকট করে তুলেছে। একশ্রেণির অতিলোভী পরিবহন ব্যবসায়ী এবং কিছুসংখ্যক বেপরোয়া পরিবহন শ্রমিকের চরম স্বেচ্ছাচারী মনোভাবের কারণে যাত্রীদের হয়রানির শিকার হতে হয়, নাকাল-নাজেহাল হতে হয়। মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলে টাকা উপার্জনের এই ব্যবসা নিয়ন্ত্রণের কেউ নেই। গণস্বার্থ দেখার দায়িত্ব যাদের তারা আত্মসমর্পণ করে আছেন পরিবহন-মাফিয়াদের কাছে। প্রতিদিন সড়ক পরিবহনে এত বিপুল অঙ্কের টাকার লেনদেন হয়, যার জন্য অব্যবস্থা দূর করার চেয়ে সেটা বহাল রাখার তৎপরতাই বেশি।

রাজীবের ঘটনাটি এখন সংবাদপত্রের পাঠকদের কাছে অজানা নেই। দুটি বেপরোয়া বাসের রেষারেষি এবং বেপরোয়াভাবে চলার প্রতিযোগিতার এক অসহায় শিকার তিতুমীর কলেজের স্নাতক পর্যায়ের ছাত্র রাজীব হোসেন। গত ৩ এপ্রিল সন্ধ্যায় কারওয়ান বাজার মোড়ে একটি বিআরটিসি বাস এবং স্বজন পরিবহন নামের আরেকটি বাস ওভারটেকিং বা আগে যাওয়ার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হলে রাজীবের ডান হাত কনুই থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তিনি বাস থেকে পড়ে যান। মাথার পেছনের এবং সামনের হাড় ভেঙে যায়। মস্তিষ্কেও আঘাত লাগে। গুরুতর আহত রাজীবকে প্রথমে একটি বেসরকারি হাসপাতালে এবং পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজে নিয়ে চিকিৎসা দেওয়া হয়। রাজীব অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারের সন্তান। বাবা-মা জীবিত নেই। উল্টো তার ছোট দুই ভাইয়ের অভিভাবক রাজীব। নিজের এবং ছোট দুই ভাইয়ের বেঁচে থাকার এবং লেখাপড়ার খরচ রাজীবকেই জোগাড় করতে হয় টিউশনি করে কিংবা অন্য কোনো উপায়ে। রাজীবের দুর্ঘটনার খবরটি প্রচার হলে সারা দেশে মানুষের মধ্যে এক ধরনের আবেগ ও কষ্টবোধের জন্ম নেয়। একটি হাত হারিয়েও রাজীব প্রাণে বেঁচে থাক—এই কামনা-প্রত্যাশা সবার মধ্যে প্রবল হয়ে ওঠে। গাড়ি চালকদের বেপরোয়া এবং কোনো কিছুকে তোয়াক্কা না করার ঔদ্ধত্য দেশে প্রতিদিন অসংখ্য সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ বলে মনে করা হয়। আহত-নিহত মানুষের তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। কিন্তু সড়ক পরিবহন ব্যবসা ও ব্যবসার সঙ্গে যারা জড়িত—প্রতিদিন এত এত মানুষের মৃত্যুতে তাদের বুক একটুও কাঁপে না। তারা মানুষ মেরে হাসিমুখে উল্লাস করার মানসিক দৃঢ়তা অর্জন করেছে। মানুষ মরলেও তাদের মুনাফা কমছে না, তাই তারা নির্বিকার।

আমাদের দেশে পরিবহন খাতের শ্রমিকরা সংগঠিত। রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে তারা বেপরোয়া এবং আইন-কানুনের ঊর্ধ্বে। তারা অপরাধ করবে, নিজের দোষে দুর্ঘটনা ঘটিয়ে মানুষ হত্যা করবে অথচ তাদের আইনের আওতায় আনা যাবে না। দুনিয়ার কোথাও এ ধরনের পাগলামি করা যায় বলে মনে হয় না। আমাদের দেশে বিভিন্ন পেশাজীবীর স্বার্থ দেখার সংগঠন আছে কিন্তু সাধারণ যাত্রীদের স্বার্থ দেখার কেউ নেই। যাত্রীসেবা বলে কোনো কিছুর অস্তিত্ব আমাদের দেশে নেই। বিচ্ছিন্নভাবে কেউ কিছু কাজ করলেও তা পরিবহন শ্রমিক-মালিক এবং স্বার্থান্ধ শ্রমিক নেতাদের সম্মিলিত দাপটের কাছে একেবারেই অসহায়।

যাত্রীদের জিম্মি করে মালিকরা তাদের মুনাফার পাহাড় গড়ছে। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো—শ্রমিক এবং শ্রমিক নেতাদেরও সাধারণ যাত্রীদের পক্ষে না দাঁড়িয়ে মালিকদের লাঠিয়াল হতে দেখা যায়। নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানের এক অঙ্গে বহুরূপ। একসময় জাসদের গলাকাটা রাজনীতি করতেন। আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে এবং মন্ত্রী হয়েও ‘গলাকাটা’ তিনি ছাড়তে পারেননি। আগে গলা কাটতেন হয়তো রাতের অন্ধকারে অস্ত্র দিয়ে। এখন তার শ্রমিক বাহিনী দিনের আলোতে, প্রকাশ্যে মানুষ হত্যা করে গাড়ি চাপা দিয়ে। পরিবহন ব্যবস্থা এখন দুর্বিষহ যন্ত্রণার নাম হয়ে উঠেছে। মানুষের নিন্দা-প্রতিবাদ কোনো কিছুই সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে পারছে না। কারণ চালকরা পণ করেছে, তারা তাদের অভ্যাস বদলাবে না। শুধু দুর্ঘটনায় মানুষ হত্যা নয়, সড়ক পথে পরিবহন শ্রমিকরা এখন এক নতুন উৎপাত শুরু করেছে। সেটা হলো চলন্ত গাড়িতে নারী যাত্রীকে ধর্ষণ এবং হত্যা করা এর মধ্যে এরকম কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে।

টানা ১৩ দিন জীবন-মৃত্যুর লড়াইয়ে মৃত্যুর কাছে পরাজিত হয়েছে রাজীব হোসেন নামের হতদরিদ্র ছাত্র। তার ছোট দুই ভাই মেহেদি হাসান (১৩) এবং আবদুল্লাহ (১১) এখন চরম অসহায় অবস্থায় পড়েছে। যাত্রাবাড়ীর একটি মাদ্রাসার সপ্তম ও ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র বাবা-মা হারা মেহেদি ও আবদুল্লাহর কাছে বড় ভাই রাজীব ছিলেন পরম সহায়, একই সঙ্গে ছাদ এবং বৃক্ষ। কিন্তু এখন তাদের কী হবে? সমাজকল্যাণমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন অবশ্য জানিয়েছেন, তার মন্ত্রণালয় রাজীবের দুই ভাইয়ের দায়িত্ব নিতে চায়। মন্ত্রী জানিয়েছেন, রাজীবের পরিবারকে এককালীন ৫০ হাজার টাকা অনুদান দেবে। তার পরিবারের সঙ্গে আলোচনা করে ছোট দুই ভাইকে মিরপুর শিশুপল্লীতে নিয়ে আসা হবে। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় তারা বড় হবে।

বর্তমান সময়ে ৫০ হাজার টাকার অনুদান খুব বড় কিছু নয়। তবে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় যে বিষয়টি ভেবেছে তা-ই বা কম কী! রাজীব হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকার সময় হাই কোর্ট তার চিকিৎসা ব্যয় মেটানোর নির্দেশ দিয়েছিল। একই সঙ্গে তাকে এক কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ বাবদ প্রদানের নির্দেশ কেন দেওয়া হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছে আদালত। রাজীব আর নেই। আদালত এখন কী নির্দেশ দেবে আমরা জানি না। তবে বিআরটিসি এবং স্বজন পরিবহনের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায়ে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করা দরকার। অন্যায় করলে তার জন্য শাস্তি পেতে হবে—এটা যদি প্রতিষ্ঠিত করা না যায় তাহলে দেশে অন্যায় কমবে কীভাবে?

রাজীবকে বাঁচিয়ে রাখার সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু এ ধরনের দুঃখজনক মৃত্যু যেন আমাদের বারবার বিষাদ আক্রান্ত না করে তার কোনো ব্যবস্থার কথা কি আমরা ভাববো না? সড়ক পরিবহন খাতে যে নৈরাজ্য চলছে তা বন্ধ করার কোনো উদ্যোগ কি আমরা নেব না? মালিক-শ্রমিকদের কাছে মানুষ আর কতদিন জিম্মি হয়ে থাকবে?

একজন প্রভাবশালী মন্ত্রীর একটি বক্তব্য মানুষকে আশাহত করেছে। তিনি ১৮ এপ্রিল সকালে রাজীবের মৃত্যুর জন্য তাকেই দায়ী করে বক্তব্য দিয়ে বলেছেন, ‘হতে পারে ওই ছেলেটাও ভুল করতে পারে। তার দাঁড়ানোটা সঠিক নাও হতে পারে।’ এ ঘটনার সঙ্গে সড়ক ব্যবস্থাপনার কোনো সম্পর্ক নেই উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেছেন, এ ধরনের ঘটনার জন্য চালক এবং যাত্রী দায়ী। তার এই বক্তব্য গণমাধ্যমে প্রচার হওয়ার পর বিরূপ প্রতিক্রিয়া হওয়ায় সন্ধ্যায় এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, তিনি রাজীবকে দায়ী করে কথা বলেননি। তিনি গোপালগঞ্জের যে বাসের হেলপার হাত হারিয়েছে তার কথা বলেছেন। হতে পারে মন্ত্রীর পরের কথাই ঠিক। কিন্তু প্রথম যে বক্তব্যটি প্রচার হয়েছে মানুষের কাছে সেটাই বেশি বিশ্বাসযোগ্য হবে। বক্তব্য প্রচার হওয়ার পর তার ব্যাখ্যা দেওয়াটাকে অনেকেই সন্দেহের চোখে দেখে।

দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষ যখন রাজীবের এমন মৃত্যুতে দুঃখভারাক্রান্ত, তার প্রতি সহানুভূতিশীল, তখন দায়িত্ববান ব্যক্তির কাছে অসংবেদী বক্তব্য কেউ শুনতে চায় না। এটা মানুষকে ব্যথিত করে। হ্যাঁ, এক অর্থে নিজের মৃত্যুর জন্য তো রাজীবই দায়ী। তিনি কেন পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ব্যবহার করলেন? সিট না থাকা সত্ত্বেও বাদুড়ঝোলা হয়ে কেন বাসে উঠলেন? এক বাস আরেক বাসের সঙ্গে রেষারেষি কিংবা প্রতিযোগিতা করতেই পারে, এক বাস আরেক বাসকে ধাক্কা দিয়ে চূর্ণ-বিচূর্ণও করে দিতে পারে। এটা তাদের অধিকার! সাবধান-সতর্ক থাকতে হবে তো যাত্রীদের। জীবন যার রক্ষা করার দায়িত্বও তার।

তবে মন্ত্রী যে বলেছেন এ ধরনের দুর্ঘটনার সঙ্গে সড়ক ব্যবস্থাপনার কোনো সম্পর্ক নেই, সেটাও কি ঠিক? তিনি বলেছেন, ‘দুই গাড়ির রেষারেষি, ওভারটেকিং এবং কার আগে কে যাবে এর কারণে ছেলেটির মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে।’ এখানে সড়ক ব্যবস্থাপনা বলতে কি মন্ত্রী কি শুধু রাস্তার ‘কন্ডিশন’ বুঝে থাকেন? রাস্তায় যেসব যান চলাচল করে সেগুলোর কন্ডিশন, চালক-হেলপারদের দক্ষতা-অভিজ্ঞতা, ওভারটেকিং, রাফ ড্রাইভিংগুলো কি সড়ক ব্যবস্থাপনার বাইরে? ‘নিরাপদ সড়ক’ মানে কিন্তু এসব কিছুর সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনাকেই বোঝায়। আমি অন্তত তাই বুঝি। মন্ত্রীর দায়িত্ব শুধু পরিদর্শন আর কথা বলা নয়, বিদ্যমান অবস্থা পরিবর্তন মন্ত্রীর ভূমিকা দেখতে চায় সাধারণ মানুষ। শুধু কথায় চিঁড়ে ভেজে না—চিঁড়ে ভেজানোর জন্য পানি দরকার হয়। সড়কমৃত্যু রোধ করার জন্য রাস্তাঘাট যেমন নিয়মিত মেরামত করে চলাচল উপযুক্ত রাখতে হবে, তেমনি লক্কড়-ঝক্কড় মার্কা গাড়ি রাস্তা থেকে তুলে নিতে হবে। আর সবচেয়ে বেশি যেটা প্রয়োজন সেটা হলো দক্ষ এবং মানবিক গুণসম্পন্ন চালক ও হেলপার। জীবন দেওয়ার ক্ষমতা যেহেতু এদের নেই, সেহেতু জীবন কেড়ে নেওয়ার সুযোগও কোনোভাবেই থাকতে পারে না। সড়ক ও সেতুমন্ত্রী বিষয়টি একটু আলাদা গুরুত্ব দিয়ে ভাবলে সরকার এবং দল উপকৃত হবে। মানুষের আবেগের প্রতি অন্তত বিশেষ বিশেষ মুহূর্তে সম্মান দেখানো উচিত।

লেখক : সাংবাদিক।

সর্বশেষ খবর