রবিবার, ৬ মে, ২০১৮ ০০:০০ টা

রংপুরে নার্সারি শিল্পে নতুন বিপ্লব

শাইখ সিরাজ

রংপুরে নার্সারি শিল্পে নতুন বিপ্লব

ফসল উৎপাদনের ক্ষেত্রে আজকের দিনে অন্যতম বড় একটি চ্যালেঞ্জ বীজ। অনেক সংকটই কৃষক পেরিয়ে এসেছে। কিন্তু বীজের ক্ষেত্রে তাদের সংকট রয়েই গেছে। আমাদের কাছে হামেশাই কৃষক অভিযোগ করছেন, ভালো বীজ নেই। এবারের ‘কৃষি বাজেট কৃষকের বাজেট’-এর প্রতিটি পর্বের আয়োজনে কৃষকের দাবি ছিল ভালো বীজের। সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে যে বীজ তারা পাচ্ছেন তা ঠিকমতো অঙ্কুরোদ্গম হয় না। অথচ বিএডিসির বীজ নিয়ে কৃষকের এমন অভিযোগ আগে ছিল না। ইদানীং প্রায়ই এ অভিযোগ শোনা যায়। বীজের অঙ্কুরোদ্গম না হওয়া মানে একটা মৌসুমে সব ফসলের লোকসান। আগে থেকেই বলা মুশকিল বীজের অঙ্কুরোদ্গম হবে, না হবে না। আবার নার্সারি থেকে চারা কিনে লাগাতে গিয়ে চারা নষ্ট হওয়ার ঘটনা ঘটে। এ অনিশ্চয়তার ভিতর থেকে কৃষক মুক্তি চায়। কৃষক চায় ভালো বীজ, ভালো চারা। সবজির মানসম্মত চারা তৈরির এক প্রতিষ্ঠানের খোঁজ মিলল রংপুরে। প্রতিষ্ঠানটির নাম নাশিক প্লান্ট অ্যান্ড পট। ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা থেকে রওনা করলাম। রোদ ঝরঝরে এক সকালে পৌঁছলাম সৈয়দপুর বিমানবন্দরে। সঙ্গে ‘হৃদয়ে মাটি ও মানুষ’-এর ধারকদল। আমাদের রিসিভ করতে এসেছেন চটপটে প্রাণোচ্ছল এক যুবক। তার সঙ্গে আগেই ফোনে কথা হয়েছিল। নাম শাহীনুল ইসলাম। সামনাসামনি প্রথমবার দেখা। বয়স ৩৮-৪০ বছর হবে। তবে চোখে-মুখে দারুণ চাঞ্চল্য। গাড়িতে গিয়ে দেখি তার পাঁচ-ছয় বছর বয়সী ছেলেও এসেছে আমাদের অভ্যর্থনা জানাতে। রওনা দিলাম রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার রানীপুকুরে দিকে। পথে যেতে যেতে দেখলাম মাঠের পর মাঠ সবুজ হয়ে আছে। না, সবজি নয়, তামাক গাছে। বিপুল পরিমাণ তামাক চাষ হচ্ছে। তবে তামাকের পাশাপাশি সবজির চাষও বেড়েছে। আশার কথা, সামান্যতম জমিও কৃষকের আর পতিত নেই। এক ফসল শেষে চাষ হচ্ছে আরেক ফসলের।

যেতে যেতে শাহীনুল ইসলাম শোনালেন তার কৃষিপ্রীতির গল্প। শৈশবেই বিটিভিতে ‘মাটি ও মানুষ’ দেখে দেখে কৃষির প্রতি তার আগ্রহ তৈরি হয়। পড়াশোনাও করেন কৃষি বিষয়ে। উচ্চশিক্ষা শেষে শুরু করেন কৃষিকাজ। সব ভালোই চলছিল। কিন্তু বিপত্তি ঘটল বিয়ের বয়সে এসে। তার বাবা-মা বিয়ের জন্য যে পাত্রীকেই পছন্দ করেন ছেলে কৃষিকাজ করেন বলে বিয়েতে রাজি হয় না। অর্থাৎ, কৃষিকাজের জন্যই তার বিয়ে হচ্ছিল না। শেষে তিনি একটা আন্তর্জাতিক বীজ বিপণন প্রতিষ্ঠানে চাকরি নিলেন। বিয়ে হলো। বীজ বিপণন প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে করতে সারা দেশের কৃষি ও কৃষকের সঙ্গে তার পরিচয় ঘটল। নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করে দেখলেন কৃষকের মূল চাহিদা ভালো বীজ। আর একটা বিষয় তিনি বুঝতে পারলেন, কৃষক আসলে শুধু ভালো বীজ নয়, প্রত্যাশা করেন ভালো চারার। যে চারা শতভাগ নিশ্চয়তা দেবে ফলনের। বীজ থেকে চারা তৈরিতে সময় লাগে ন্যূনতম ২০ দিন। কৃষক যদি সরাসরি হাতে ভালো চারা পান তবে তার ২০টি দিন বেঁচে যায়। সেই চিন্তা থেকে সমবয়সী সমমনা আরও পাঁচ বন্ধুকে নিয়ে গড়ে তুললেন এই প্রতিষ্ঠান।

নাশিক প্লান্ট অ্যান্ড পটে যখন পৌঁছলাম তখন সূর্য তেতে উঠেছে। কিন্তু কচি সবুজের এক প্রান্তর দেখে মন ভরে উঠল। এ যেন সনাতন ও প্রচলিত পরিস্থিতি থেকে আরেক ধাপ অগ্রসর এক কৃষি। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কৃষি কতটা গোছানো ও পরিকল্পিত হতে হবে, তাই যেন জানান দিচ্ছে একদল তরুণের গড়ে তোলা প্রতিষ্ঠানটি। কৃষির আগামীকে চিন্তা করেই তারা এমন একটি সহায়ক বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার কাজে হাত দিয়েছেন। ইতিমধ্যে দেখেছেন অপার সম্ভাবনা।

উন্নত দেশগুলো যেভাবে পরিকল্পিত গ্রিনহাউস গড়ে কৃষিকে নিয়ে গেছে গোছানো ও সাহেবি কাজে। এও যেন ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলোর মতোই এক কর্মক্ষেত্র। বলা যায় গাছের চারা তৈরির এক কারখানা। উৎপাদন হচ্ছে লাউ, কুমড়া, করলা, পেঁপে, রেড লেডি পেঁপে, মরিচ, চিচিঙ্গাসহ নানা সবজির চারা। পরিপাটি করে গোছানো, থরে থরে সাজানো সবকিছু। ফসলের চারা উৎপাদনে প্রযুক্তি ব্যবহারের দক্ষতায় এই উদ্যোক্তারা মোটেও পিছিয়ে নেই। তবে এখানে গ্রিনহাউস নয়, চারা তৈরি হচ্ছে নেট হাউসে পরিকল্পিত শেডে, যা অতি রোদ থেকে চারাকে বাঁচিয়ে রাখে।

বীজের পরিবর্তে শতভাগ সুস্থ চারা উপহার দেওয়াই এ উদ্যোগের উদ্দেশ্য। উদ্যোক্তাদের পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর্বগুলো শেষ। এখন বাণিজ্যিক চারা উৎপাদন ও কৃষকের হাতে তুলে দেওয়ার কাজ চলছে। খামারজুড়েই চলছে শিল্পকারখানার মতো কর্মযজ্ঞ। কাজের শুরু থেকে একেবারে রোপণ উপযোগী চারা বাজারজাত পর্যন্ত বেশ কয়েকটি ধাপ।

ছয় তরুণ উদ্যোক্তার চোখে ভবিষ্যৎ কৃষির স্বপ্ন আর হৃদয়ে কৃষির প্রতি অপার ভালোবাসা। শাহীনুল ইসলাম আগেই জানিয়েছিলেন শুরুর দিকের কথা, কতটা কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে আজকের অবস্থানে আসতে। ইন্টারনেটে উন্নত বিভিন্ন দেশের কৃষিব্যবস্থা দেখে সেইমতো কাজ করার চেষ্টা ছিল প্রতিনিয়ত। কিন্তু এই প্রযুক্তিনির্ভর চারা উৎপাদনের প্রথম উপকরণ হচ্ছে চারা রাখার ট্রে। আর ওটাই তৈরি করা মুশকিল হয়ে দাঁড়িয়েছিল। দেশের এমন কোনো প্রতিষ্ঠান নেই যেখানে তিনি ধরনা দেননি। শেষে ব্যক্তি উদ্যোগে গবেষণা করে তৈরি সম্ভব হলো। তারপর বহু চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ২০১৩ সালে জীবনের স্বপ্নের তরী ভিড়ল চারা উৎপাদনের এই উদ্যোগে এসে। কার্যক্রম হাতে নেওয়ার পরও মোকাবিলা করতে হয়েছে অনেক চ্যালেঞ্জ। প্রতিদিনই নতুন নতুন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হচ্ছেন এই তরুণ উদ্যোক্তারা। এর ভিতর দিয়েই রপ্ত করেছেন কৃষির সময়োপযোগী সব ধ্যান-ধারণা ও বাণিজ্যিক হিসাব। ভালো উদ্যোগের ক্ষেত্রে প্রথম প্রথম সবাই একটু বাধা ও উপেক্ষার মুখে পড়েন। এখানেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। প্রথম যখন এখানে চারা তৈরির কাজগুলো শুরু হয়, তখন স্থানীয়দের কাছে তা ছিল হাস্যকর। অনেকেই বিষয়টি নিয়ে নানারকম তাচ্ছিল্য করেছেন। কিন্তু আজ সবার কাছেই এ উদ্যোগ দারুণ লাভজনক ও সম্ভাবনাময়।

অনেক পথ পেরিয়ে এসে এখন এই নাশিকের উদ্যোক্তারা তাদের উৎপাদিত চারার সুস্থতা ও কৃষকের লাভের দিকগুলো নিশ্চিত করতে পারছেন।

মাটির পরিবর্তে কোকোপিট ব্যবহার করা হচ্ছে চারা তৈরির কাজে। গ্রামের বেশকিছু নারীও এখানে কাজ করেন। কারখানার মতোই কাজগুলো ভাগ করা। কেউ ট্রেতে কোকোপিট ভরছেন। কেউ প্লেট দিয়ে সেগুলোয় বীজ রাখার গর্ত তৈরি করছেন। কেউ বীজ বপন করছেন। আলাদা অথচ পূর্ণাঙ্গ একটি কর্মযজ্ঞের সূচনা করছেন নারী দল। নেট হাউস বলেই রোগবালাইয়ের প্রকোপ নেই। আবার তাপমাত্রাও নিয়ন্ত্রণ করা হয়। খামারে বেশ কয়েকজন কৃষকের দেখা পেলাম। যারা দূরদূরান্ত থেকে এসেছেন চারা কিনতে। এখানকার চারা খেতে রোপণ করে ইতিমধ্যে ইতিবাচক ফল পেয়ে গেছেন তারা। কথা হলো তাদের সঙ্গে। তারা জানালেন, এই চারা থেকে ফলন নিশ্চিত। চারা মরে না, দুর্বল হয় না। ২০-২৫ কিলোমিটার দূর থেকে এসে চারা নিয়ে গেলেও চারা রোপণের পর গাছ হয় সুন্দর।

শুধু বিজ্ঞানসম্পন্ন ও আধুনিক উপায়ে চারা উৎপাদনই নয়, চারা বাজারজাত করার জন্যও আধুনিক একটি বাণিজ্যিক অবকাঠামো গড়ে তুলেছেন এই উদ্যোক্তারা। কৃষকের দোরগোড়ায় এই চারা পৌঁছে দেওয়ার জন্য বিভিন্ন স্থানে ইতিমধ্যেই ডিলার চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন। তারা অন্যান্য কৃষি উপকরণের তুলনায় কৃষকের কাছে সুস্থ চারা পৌঁছে দেওয়ার এই কারবারটিকে নিয়েছেন অনেক আন্তরিকভাবে। তারাও একেকজন সফল উদ্যোক্তা।

ইতিমধ্যে উদ্যোক্তা ও ডিলাররা বুঝে গেছেন বীজ ব্যবসার তুলনায় চারা ব্যবসা লাভজনক ও কার্যকর। আর যদি সুস্থ ও উন্নত চারা কৃষকের হাতে তুলে দেওয়া যায়, তাতে কোনো অভিযোগ থাকে না। কৃষকও অনেক বেশি উৎসাহিত হন। ফলে ডিলাররাও আকর্ষণীয় ও সুরক্ষিত উপায়ে চারা বাজারজাত করার জন্য ব্যক্তিগতভাবে নিয়েছেন নানা উদ্যোগ।

এ প্রতিষ্ঠানের নানা কাজে নিয়োজিত হয়েছেন এলাকার তৃণমূল কৃষক পরিবারের সদস্যরা। একেবারে গহিন গ্রামে কৃষিভিত্তিক কাজের সুযোগ পেয়ে এলাকার নারী-পুরুষ অনেকটাই উপকৃত। এই বিরাট আয়োজনের পেছনে রয়েছে সম্মিলিত চিন্তা ও সৃজনশীলতার প্রয়োগ। উদ্যোক্তাদের সবাই বেশ উদ্যমী ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন। বাণিজ্যিক কৃষি সম্পর্কে তাদের সবারই রয়েছে সম্যক ধারণা। এ ক্ষেত্রে দেশি-বিদেশি অভিজ্ঞতা, বিজ্ঞানসম্মত দক্ষতা আর কৃষির প্রতি গভীর মনোনিবেশ রয়েছে তাদের। সময়ের প্রয়োজন মিটিয়েই এগিয়ে চলেছে কৃষি। ভোক্তা চাহিদার সঙ্গে সঙ্গেই কৃষকের চাহিদার দিকগুলো বিবেচনা করে বহুমুখী বাণিজ্যিক উদ্যোগ যুক্ত হচ্ছে। কৃষকের জন্য কৃষিকাজ সহজীকরণের তৎপরতা যেমন চলছে, একইভাবে চলছে সম্ভব সব রকমের লোকসান কমিয়ে আনার কাজটিও। এ ক্ষেত্রে ‘নাশিক প্লান্ট অ্যান্ড পট’ নামের এই উদ্যোগটি দারুণ আশাব্যঞ্জক ও সফল একটি কার্যক্রম। উদ্যোক্তারা যে আত্মবিশ্বাস নিয়ে আগামীর লক্ষ্য পূরণের কথা ভাবছে, তা পূরণ হলে দেশের অনেক কৃষকই আধুনিক এই নার্সারির সেবা গ্রহণ করতে পারবেন। উৎসাহী ও শিক্ষিত তরুণদের হাত দিয়ে এ ধরনের উদ্যোগ আরও সম্প্রসারিত হবে— এমন আশাও করা যায়।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।

            [email protected]

সর্বশেষ খবর