শনিবার, ১২ মে, ২০১৮ ০০:০০ টা

ব্লু ইকোনমির অমিত সম্ভাবনা বাংলাদেশে

শাইখ সিরাজ

ব্লু ইকোনমির অমিত সম্ভাবনা বাংলাদেশে

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যার অধ্যাপক ড. আবদুল আজিজ বছর দুয়েক আগে আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন কক্সবাজার যেতে। কক্সবাজার আমি বহুবার গিয়েছি। জানতে চাইলাম, নতুন কী দেখাবেন? উত্তর দিলেন, ‘আসেন, আপনার জন্য ব্যতিক্রম কিছু নিয়ে অপেক্ষা করছি।’ যাব যাব করে দুই বছর কেটে যায়! গত মার্চের মাঝামাঝি একদিন গিয়ে হাজির হলাম কক্সবাজারে। কিন্তু তিনি তখন কক্সবাজারে নেই। তবে যা তিনি দেখাতে চেয়েছিলেন, তা দেখে এসেছি। সে গল্পই বলব আজ প্রিয় পাঠকদের।

সমুদ্র। এক অনন্য, অসীম আধার। এতে আছে নানান সম্পদ, আছে অমিত সম্ভাবনার বিচিত্র উপকরণ। তেমনই একটি সামুদ্রিক শৈবাল। জাপান, চীন, কোরিয়া, ফিলিপিনস বিভিন্ন দেশে শৈবাল এক অনন্য অর্থকরী সবজি। কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের যৌথ উদ্যোগে কক্সবাজারে শৈবাল চাষের প্রকল্প আমাকে দেখাতে চেয়েছিলেন অধ্যাপক আবদুল আজিজ।

কক্সবাজার বিমানবন্দরের পাশে মহেশখালী চ্যানেলের নুনিয়াছড়া সৈকতে গিয়ে দেখি সেখানে রীতিমতো অন্যরকম এক কর্মযজ্ঞ। শাঁ করে বিমান উঠে যাচ্ছে আকাশে, আবার নামছেও আকাশ থেকে। আর তার পাশেই চলছে নতুন এক অর্থনীতির চাষবাস নিয়ে গবেষণা। সেখানেই কথা হলো শৈবাল চাষি মো. করিমের সঙ্গে। শৈবাল নিয়ে খুব ব্যস্ত সে। জোয়ার নেমে যাবে। তার আগেই শৈবালগুলোকে নির্দিষ্ট স্থানে রেখে আসতে হবে। তাই নেই ফুরসত। কাজ করতে করতেই জানাল শৈবালের গল্প।

অনেক আগে থেকেই আমাদের দেশে সামুদ্রিক শৈবালের চাহিদা ছিল। আজও আদিবাসী জনগোষ্ঠী সামুদ্রিক শৈবাল খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে। এটা দেখে কক্সবাজারের এই তরুণ মহেশখালী চ্যানেল থেকে শৈবাল সংগ্রহ করে রাখাইন সম্প্রদায়ের কাছে বিক্রি শুরু করে। সে দেখল জালে জড়িয়ে রাখা শৈবাল ১০-১৫ দিন পরে পরিমাণে তিন থেকে চার গুণ বেড়ে যাচ্ছে। এটাকেই সে পেশা হিসেবে বেছে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। তখন সে শৈবালের বীজসহ (ওয়ার্ম টিউব) তুলে ফেলত। ফলে শৈবাল ক্রমে কমে আসছিল। কিন্তু এখন সে কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের এই প্রকল্প থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে শৈবাল চাষ পদ্ধতি শিখে নিয়েছে। শুধু করিমই নয়, এখন এ কাজে যুক্ত হয়েছেন তার মা, বোনসহ অনেকে।

ইতিহাস বলে, ১৬৭০ সালে টোকিও সমুদ্রে সর্বপ্রথম শৈবাল চাষ শুরু হয়। সে চাষ বাণিজ্যিক রূপ নেয় ১৯৪০ সালে। তারপর জাপান, চীন, কোরিয়া, ফিলিপিনস বিভিন্ন দেশে শৈবাল এক অনন্য অর্থকরী সবজি। নানারকম পুষ্টি উপাদান, ভিটামিন, খনিজ ও আয়োডিনের বিশাল আধার এই সামুদ্রিক শৈবাল। জাপান প্রতি বছর ২ বিলিয়ন ডলারের শৈবাল উৎপাদন করে। বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থার হিসাবে সারা বিশ্বে ২৫ হাজার মেট্রিক টন শৈবাল উৎপাদন হয়; যার বাণিজ্যিক মূল্য ৬.৫ বিলিয়ন ডলার। সে হিসাবে বাংলাদেশের উপকূলীয় তটরেখার দৈর্ঘ্য প্রায় ৭১০ কিলোমিটার। ১৯টি জেলার ১৪৭টি উপজেলায় মোট ২৫ হাজার বর্গ কিলোমিটার বিস্তৃত এলাকায় শৈবাল চাষ হতে পারে কৃষি তথা ব্লু ইকোনমির নতুন ধারা। ২০০৫ সালে আমি ‘হৃদয়ে মাটি ও মানুষ’-এর প্রোগ্রাম ধারণ করার জন্য জাপানে যাই। সেখানে টোকিও সাগরের দীর্ঘ বালুতটজুড়ে সামুদ্রিক শৈবালের চাষ হতে দেখেছি। জাপানের রেস্তোরাঁয় অনেক খাবারেই শৈবালের উপস্থিতি পেয়েছি। ২০১৫ সালে নেদারল্যান্ডসে গিয়ে নর্থ সির পাড়ে দেখেছি শৈবাল চাষ।

বাংলাদেশের একমাত্র প্রবালদ্বীপ সেন্ট-মার্টিনস প্রাকৃতিকভাবে জন্ম নেওয়া সামুদ্রিক শৈবালের বিপুল ভাণ্ডার। প্রাপ্ত তথ্যমতে, সেখানে প্রায় ১০২ গ্রুপের ২১৫ প্রজাতির শৈবাল রয়েছে। কিন্তু দিন দিন পর্যটকের ভিড় আর স্থানীয়দের অসচেতনতায় হারিয়ে যাচ্ছে প্রাকৃতিকভাবে জন্ম নেওয়া অনেক শৈবালের প্রজাতি।

কক্সবাজারের মহেশখালী চ্যানেলে নুনিয়াছড়া সৈকতের টাইডাল তটরেখায় চাষ হচ্ছে হিপনিয়া (Hypnea) প্রজাতির শৈবালের। কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট এখানকার কৃষকদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে শৈবাল চাষের। আগে শৈবাল সংগ্রহের সময় টিউব ওয়ার্ম যেটাকে স্থানীয়ভাবে বীজ বলা হয়, সেটাসহ তুলে নিয়ে আসত। ফলে শৈবাল আর জন্মাত না। এখন তারা এ বিষয়টিতে সচেতন। এখানকার এই মানুষদের মাঝে স্বপ্নের বীজ বোনা হয়েছে। তারাও পাচ্ছেন আয়ের এক নতুন সন্ধান। শুধু পুরুষই নয়, এখানে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন ৫০ জন নারী সদস্যও। তারাও চাষ করছেন অর্থকরী এই সবজি। তৈরি হচ্ছে কর্মসংস্থানের এক বিপুল সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র। শৈবাল চাষি মো. করিম জানাল শৈবাল চাষের অর্থনৈতিক লাভের হিসাব। কাঁচা শৈবাল প্রতি মণ ২০০০ টাকা, শুকনো ৬০০০-৭০০০ টাকা মণ দরে বিক্রি করছে। আর বীজ বিক্রি করছে ৭০-৮০ টাকা কেজি দরে। বছরের চার মাস শৈবাল চাষে যুক্ত হয়ে আড়াই লাখ টাকার মতো আয় করেছে, বলে মো. করিম। শুধু রাখাইনদের কাছে নয়, সামুদ্রিক শৈবাল কিনতে আসে মিয়ানমার থেকেও। কৃষক মুজিবুর রহমান বলেছেন, শৈবাল নিয়ে তিনি আশাবাদী, শৈবাল তার ভাগ্য বদলে দেবে। তিনি লাভের মুখ দেখছেন।

সেখানে উপস্থিত ছিলেন রাখাইন সম্প্রদায়ের নিনি, মার্শা ও মুমু। তারা জানলেন সিউইড খাওয়ার প্রক্রিয়া। শৈবাল পরিষ্কার করে তাজা অবস্থায় সালাদ হিসেবে খাওয়া যায়। এ ছাড়া সুপে, আচারে, পিঠায়, চানাচুরসহ নানা খাবারেও এটি ব্যবহার করা যায়। তারা শৈবালের সঙ্গে শুঁটকি মাছ, পিয়াজ-কাঁচা মরিচ মাখিয়ে ভাতের সঙ্গে খান। খুব উপাদেয়। সামুদ্রিক শৈবালের সম্ভাবনা ও চাষের কৌশল নিয়ে জানালেন এই প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আ স ম মাহবুবুর রহমান খান। তিনি জানালেন, উৎপাদিত শৈবাল শুধু খাবার হিসেবেই নয়, সামুদ্রিক শৈবাল থেকে এগার, কেরাজিনা এবং এলজিনেট উৎপন্ন হয়, যা শিল্পকারখানায় এবং ওষুধশিল্পে মূল্যবান কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহূত হয়।

ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা মোস্তাক আহমেদ জানালেন, সামুদ্রিক শৈবালে প্রচুর অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট, বিটা কেরোটিনযুক্ত ভিটামিন-এ, ভিটামিন বি-১২, ভিটামিন সি, ডি, ই ও কে রয়েছে। সবজি হিসেবে এটি হতে পারে অনন্য এক খাবার উপকরণ। শুধু দেশেই নয়, চাষকৃত শৈবাল দখল করতে পারে বৈদেশিক বাজার।

নুনিয়াছড়া থেকে গেলাম কক্সবাজারের সিউইড ল্যাবরেটরিতে। সেখানে চলছে সামুদ্রিক শৈবাল নিয়ে গবেষণা। সায়েন্টিফিক অফিসার ওমর ফারুক মাসুক ও মোস্তাফিজুর রহমান কাজ করছেন। চলছে টিস্যুকালচার, আলো নিয়ে পরীক্ষা। রয়েছে আল্ট্রা ভায়োলেট চেম্বার। হচ্ছে শৈবালের বীজ উৎপাদন নিয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা।

ঢাকায় ফিরে কথা হয় অধ্যাপক আজিজের সঙ্গে। তিনি শৈবালের শিল্প সম্ভাবনা নিয়ে বলেন, ‘আমরা যদি ১০০ একরের মতো উপকূলস্থ জায়গায় শৈবাল চাষ করতে পারি, তাহলে সেখানে দৈনিক যে পরিমাণ শৈবাল উৎপাদন হবে তা দিয়ে একটি ইন্ডাস্ট্রি চলতে পারে। ‘এগার-এগার’ যা আমরা টনে টনে বিদেশ থেকে আমদানি করছি প্যাথলজি ও ওষুধশিল্পের জন্য, তা নিজেরাই উৎপাদন করতে পারি।’

প্রিয় পাঠক! সামুদ্রিক শৈবাল মেটাতে পারে আমাদের পুষ্টির চাহিদা। পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের এক ক্ষেত্র হতে পারে এটি। সামুদ্রিক মাছ ধরার পাশাপাশি বিকল্প কর্মসংস্থানের উপায় হতে পারে সামুদ্রিক শৈবাল চাষ। বিশেষ করে নারীদের জন্য একটি লাভজনক কর্মক্ষেত্র তৈরি হতে পারে। গড়ে উঠতে পারে সম্ভাবনাময় বিশাল এক শিল্প। সরকারসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগের শিল্পোদ্যোক্তারা এগিয়ে এলে ব্লু-ইকোনমির এক নতুন সম্ভাবনাময় পৃথিবীর দরজা উন্মোচন হতে পারে; যা আমাদের জাতীয় অর্থনীতিকে করবে সমৃদ্ধ। খাদ্য নিরাপত্তার পাশাপাশি টেকসই অর্থনীতির একটি খাত হিসেবে বিস্তৃতি লাভ করতে পারে সামুদ্রিক শৈবাল চাষ।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।

            [email protected]

সর্বশেষ খবর